শব্দ শুনে উৎস টের পান না? জানেন, কেন এমনটা ঘটে আমাদের সঙ্গে?
Doppler effect: সাধারণত ২ থেকে ১২ মেগাহার্জ কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট উচ্চ কম্পাঙ্কের একটি শব্দ তরঙ্গ গর্ভবতী মহিলাদের পেটে পাঠানো হয়, যা গর্ভস্থ ভাসমান ভ্রূণ থেকে প্রতিফলিত হয়।
প্রতিদিন অফিস যাওয়ার সময় যখন মেট্রোর চলমান সিঁড়ি দিয়ে উঠি, কিছু লোকজন হুড়মুড়িয়ে উঠতে থাকেন, কারণ কানে বাজে মেট্রো আসার আওয়াজ। পড়িমড়ি করে উপরে উঠে বোকা হয়ে যান- যা! মেট্রো কই, এ তো উল্টোদিকের মেট্রো। আসলে শব্দের উৎস (ট্রেনের আওয়াজ) ও শ্রোতার ভেতরে এক অদ্ভুত সম্পর্ক রয়েছে, যা নির্ভর করে প্রধানত উৎস ও শ্রোতার মধ্যে কাজ করা আপেক্ষিক বেগের উপর। বহু যুগ আগে যার হিসাব কষেছিলেন এক অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী, ক্রিস্টিয়ান আন্ড্রেজ ডপলার। তিনি দেখিয়েছেন কী করে শব্দের উৎসের প্রকৃত ও আপাত বেগ নির্ণয় করা যায়। উৎস ও শ্রোতার ভেতরে আপাত বেগের তারতম্যর দরুণ শব্দের তীব্রতার এই যে বেশি কম- বিজ্ঞানের পরিভাষায় তাকে বলে 'ডপলার ক্রিয়া' বা 'ডপলার এফেক্ট'। এই আবিষ্কারের কথা ডপলার উনবিংশ শতকে রয়্যাল সোসাইটির এক বিজ্ঞান সম্মেলনে প্রথম প্রকাশ করেন।
শব্দ এক প্রকার মেকানিকাল ওয়েভ বা যান্ত্রিক তরঙ্গ। মানে, মাধ্যমের ভেতরকার চাপের পরিবর্তন হলে তরঙ্গের বেগেরও পরিবর্তন হয়। অন্য আর সব তরঙ্গের মতো শব্দ তরঙ্গের তীব্রতা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ব্যাস্তানুপাতিক, অর্থাৎ কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক (বেগ = তরঙ্গদৈর্ঘ্য × কম্পাঙ্ক)। কেবলমাত্র শব্দের উৎস বা শ্রোতা গতিশীল হলে, অথবা দুটোই গতিশীল হলে শব্দের প্রকৃত কম্পাঙ্ক শ্রোতার কানে পরিবর্তিত হয়ে ধরা দেয়। উৎস ও শ্রোতার ভেতরকার আপেক্ষিক বেগের তারতম্য যত বাড়বে, শ্রোতা তত বেশি পরিবর্তিত কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পাবেন। কী অদ্ভুত!
কেবল শব্দের ক্ষেত্রেই আমরা এই ডপলার ক্রিয়া দেখতে পাই এমন নয়। এক্স রে, গামা রে, প্রভৃতি তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ, এমনকী রেডিও তরঙ্গের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। এই ডপলার ক্রিয়ার দরুন কোনও তরঙ্গের মূল কম্পাঙ্কের হেরফেরকেই বিজ্ঞানীরা বলেন 'ডপলার শিফ্ট' বা 'ডপলার সরণ'। তরঙ্গের উৎস যখন দর্শক বা শ্রোতা থেকে দ্রুত গতিতে দূরে চলে যায়, তখন দর্শক বা শ্রোতা কম কম্পাঙ্কের তরঙ্গ দেখতে বা শুনতে পান, আবার উৎস যখন দর্শক বা শ্রোতার দিকে অতি দ্রুত এগিয়ে আসে তখন আবার বেশি কম্পাঙ্কের তরঙ্গ, দর্শক দেখতে বা শুনতে পান। কেবলমাত্র দর্শক বা শ্রোতার একেবারে কাছেই যদি তরঙ্গের জন্ম হয়, তবেই এর কম্পাঙ্কের বিশেষ তারতম্য হয় না। বিজ্ঞানের পরিভাষায় তরঙ্গ উৎসের এই ক্রমাগত কাছে এগিয়ে আসাকে বলে 'পজিটিভ ডপলার শিফ্ট', আর তরঙ্গ উৎসের দূরে চলে যাওয়াকে বলে 'নেগেটিভ ডপলার শিফ্ট'।
আরও পড়ুন- সময়ের উল্টোদিকেও রয়েছে ‘পদার্থ’? যে খোঁজ বদলে দিতে পারে আমাদের সব বোঝাপড়া
খুবই সহজ গাণিতিক সমীকরণ ব্যাবহার করে, ডপলার এই কম্পাঙ্কের তারতম্যের হিসেবনিকেশ করেন। তাঁর সমীকরণ ছিল,
কম্পাঙ্কের পরিবর্তন = (উৎস এবং শ্রোতার মধ্যে আপেক্ষিক বেগ / শূন্য মাধ্যমে তরঙ্গের বেগ) × উৎস নিঃসৃত তরঙ্গের কম্পাঙ্ক
অর্থাৎ উপরের সমীকরণ অনুসারে উৎস এবং শ্রোতার ভেতরকার আপেক্ষিক বেগ যত বাড়বে, ততই ডপলার শিফ্ট বাড়বে। আর এই ডপলার শিফ্ট যেহেতু বেগের সমানুপাতিক, আবার বেগের মান ও দিক দুই-ই আছে, তাই দু'ধরনের (পজিটিভ ও নেগেটিভ) ডপলার শিফ্ট দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই ডপলার ক্রিয়া সম্পর্কিত গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে হয়। সেক্ষেত্রে একটা সাইন কনভেনশন বা দিকের রীতিনীতি মেনে চলতে হয়- উৎস যখন শ্রোতা বা দর্শকের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, তখন আপেক্ষিক বেগ ধনাত্মক, আর উৎস শ্রোতা বা দর্শকের থেকে একই বেগ নিয়ে দূরে যেতে আরম্ভ করলে আপেক্ষিক বেগ ঋণাত্মক। ফলত প্রথম ক্ষেত্রে, ডপলার শিফ্ট ধনাত্মক, অর্থাৎ দর্শক বা শ্রোতা প্রকৃত কম্পাঙ্কের থেকে বেশি কম্পাঙ্কের তরঙ্গ দেখতে বা শুনতে পান, আবার দ্বিতীয়ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো। ঋণাত্মক ডপলার শিফ্টের বেলায় দর্শক বা শ্রোতার কাছে প্রকৃত কম্পাঙ্ক থেকে ডপলার শিফ্ট সমান কম কম্পাঙ্কের তরঙ্গ অনুভূত হয়।
এ না হয় বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকের আলোচনা, বোঝা গেল কিন্তু কী লাভ এই সব অঙ্ক কষে? বিজ্ঞান সব সময় লাভের ফসল ঘরে তোলে। চলমান কোনও পদার্থকে কোনও এক প্রকার তরঙ্গ দিয়ে আঘাত করলে, তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়। সেই প্রতিফলিত তরঙ্গের কম্পাঙ্কের হিসাব করে আমরা ডপলার শিফ্ট মাপতে পারি। সেই থেকে কম্পনের ধরন সম্বন্ধে একটা ধারণা পাওয়া যায়। আমাদের প্রত্যহ জীবনযাত্রার সঙ্গে যুক্ত অনেক আধুনিক যন্ত্র এই নীতির উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে- যেমন মুভিং টার্গেট ইন্ডিকেটর বা এম.টি.আই রাডার, যার সাহায্যে গতিশীল গাড়ির গতির অভিমুখ ও মান, দুই-ই নির্ণয় করা যায়। রাস্তায় যান নিয়ন্ত্রণে এর উপকারিতা অপরিসীম।
আরও পড়ুন- পারমাণবিক শক্তি মানেই পারমাণবিক বোমা নয়: আজীবন বলতেন বিজ্ঞানী বিকাশ সিনহা
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এর বহুমুখী অবদান রয়েছে। এখন তো আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা ছাড়া কোনও অপারেশনের কথা ভাবাই যায় না। গর্ভবতী মহিলাদের পেটের ভ্রূণের অবস্থা জানতেও এই পরীক্ষা করা হয়। সাধারণত ২ থেকে ১২ মেগাহার্জ কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট উচ্চ কম্পাঙ্কের একটি শব্দ তরঙ্গ গর্ভবতী মহিলাদের পেটে পাঠানো হয়, যা গর্ভস্থ ভাসমান ভ্রূণ থেকে প্রতিফলিত হয়। সেখান থেকে কম্পাঙ্কের তারতম্যের পরিমাপ করে, ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নেন ভ্রূণ কী অবস্থায় আছে। বর্তমান সময়ের ডাক্তারি মহলে বিভিন্ন ধরনের ডপলার পরীক্ষার কথা সর্বজনবিদিত। যেমন কালার ডপলার পরীক্ষা, যেখানে শব্দ তরঙ্গকে বিভিন্ন রংয়ের রেখার সাহায্যে কম্পিউটারে দেখা হয়, যা থেকে ডাক্তাররা রক্তের গতিবিধি জানতে পারেন। আবার স্পেক্ট্রাল ডপলার পরীক্ষায় রক্তনালির ব্লকেজ থাকলে ধরা পড়ে, যা কিনা হৃদরোগের চিকিৎসায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাডাও ইসিজি বা ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম মারফত জানা যায় শিরা, ধমনীর ভেতরকার রক্তের প্রবাহ যা থেকে আমাদের হৃদযন্ত্রের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানা যায়।
এই ডপলার ক্রিয়ার মূলনীতির উপর ভিত্তি করেই আবহাওয়াবিদ্যা ও মহাকাশবিদ্যা চর্চার অনেক গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র তৈরি হয়েছে । আবহবিদ্যার ক্ষেত্রে সেই যন্ত্রগুলি কাজ করে ঝোড়ো মেঘের গতি অনুসরণে। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, ‘ডপলার রাডার’-এর কথা। এর মাধ্যমে আমরা বায়ুপ্রবাহের বেগ, দিক, এমনকী বৃষ্টির সম্ভাবনা বা তুষারপাতের পরিমাণ বিষয়ে আন্দাজ করতে পারি। এই নীতির উপর ভিত্তি করেই নির্মিত ট্র্যাকিং ডিভাইসের সাহায্যে আমরা পেতে পারি বিভিন্ন অত্যাধুনিক স্যাটেলাইট, রকেট ও মিসাইলের অবস্থান, গতিপথের হদিশ।
উৎস ও শ্রোতার মধ্যে আপেক্ষিক বেগের দরুন, শ্রোতা যেমন পরিবর্তিত কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পান, তেমনই মহাবিশ্বের বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তুগুলোর মধ্যে আপেক্ষিক বেগের দরুন আলোর বর্ণের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই মহাবিশ্বে যে এত গ্যালাক্সি রয়েছে, যারা প্রতিনিয়ত একে অপরের দূরে সরে যাচ্ছে, তার প্রমাণও মিলেছে এই ডপলার নীতির মাধ্যমে। গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর দূরে সরে যাচ্ছে মানে, তাদের ভেতরকার আপেক্ষিক বেগ পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলস্বরূপ তাদের থেকে আসা আলোর কম্পাঙ্ক কমছে, আর তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য যাচ্ছে বেড়ে। তার মানে আলোর বর্ণালি ক্রমশ লালের দিকে এগিয়ে চলছে, বিজ্ঞানে যার পোশাকি নাম রেড শিফ্ট বা লোহিত সরণ। উল্টোটাও দেখা যেতে পারে, অর্থাৎ আলোর বর্ণালি ক্রমশ নীলের দিকে সরে আসে, যাকে বিজ্ঞানীরা ডাকেন ব্লু শিফ্ট বা নীল সরণ নামে। আলোক বর্ণালির এহেন আচরণ থেকেই আমরা জানতে পেরেছি গ্যালাক্সিগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, আমাদের এই মহাবিশ্ব যে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছরের পুরনো, তারও খবর আমরা এই ডপলার শিফ্ট বা ডপলার সরণ থেকেই তো জেনেছি। আজ থেকে প্রায় দুই শতাব্দী আগে, ডপলারের এই আবিষ্কারই আধুনিক জ্যোতির্পদার্থবিদ্যাকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে।