ভালো খবর ভুলে যাই, কেন খারাপ খবরেই আমরা বেশি বিচলিত হই?

Brain and Negativity: একটি নেতিবাচক তথ্য বা ঘটনা একটি ইতিবাচক বা নিরপেক্ষ তথ্য বা ঘটনার চেয়ে বেশি ওজনদার।

সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছেন। পাতায় পাতায় খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, বিভিন্ন গোলযোগের খবরে ছয়লাপ। তবে শুধু এগুলো নয়, সঙ্গে কিছু ভালো খবরও আছে বৈকি! মানে এই ধরুন, বৃক্ষরোপণ উৎসব, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কীভাবে কাদের কাদের উন্নতি করে যাচ্ছে, অমুক জায়গার তমুক হাসপাতাল গরিবদের জন্য সপ্তাহে একবেলা বিনামূল্যে স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন করবে, আরও কত কী। অথচ দেখুন, সেসব নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা নেই। আমাদের মনের অজান্তেই আমাদের মস্তিষ্ক গিলতে থাকে খারাপ বা নেতিবাচক খবরগুলিকে। অথচ একইসঙ্গে সবসময়ই বহু মানুষ বহু মানুষকে বলে চলেন "সবকিছুতে পজিটিভ থাকতে হবে"!

ধরা যাক, মানুষের উন্নতির জন্য কিছু সংবাদপত্র যদি একটা 'সুখবর' ভার্সন ছাপে! মানে, সেখানে কোনও নেতিবাচক খবরই থাকবে না। তাহলে কি মানুষজন বদলে যেত? সেই চেষ্টা কি মানব ইতিহাসে করা হয়নি আগে? হয়েছে, কিন্তু আমজনতা সেই খবর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ব্যাপারটা অনেকটা পতঙ্গ আর অগ্নিশিখার মতোই, "পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়, ধাইলি অবোধ হায়!" নেতিবাচক খবর শুধু পড়া নয়, সেটা নিয়ে চর্চা না করা পর্যন্ত আমাদের আশ মেটে কই! কিন্তু কেন নেতিবাচক খবর আমাদের এত ভাবায়, আমরা এত বেশি তা নিয়েই মগ্ন হয়ে পড়ি?

আরও পড়ুন- জম্বিদের মস্তিষ্ক কেমন? তিন ‘মৃতের’ মাথা পরীক্ষা করে শিউরে ওঠা তথ্য জানালেন গবেষকরা

আসলে আমাদের মস্তিষ্কের নেতিবাচক জিনিসের প্রতি পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। সে সবসময়ই ইতিবাচক বিষয়গুলির চেয়ে নেতিবাচক জিনিস এবং ঘটনাকে অগ্রাধিকার দেয়। নিজেই ভালো করে ভেবে দেখুন, এমনটা হামেশাই প্রত্যক্ষ করেছেন আপনিও। যেমন ধরুন, পাড়ার শ্যামলের বিয়েতে হয়তো আপনার পোশাক দেখে শতকরা নিরানব্বই ভাগ মানুষ বলেছেন, "বাহ! বেশ লাগছে তো!" শুনে অপনার ভালো লেগেছে। কিন্তু শেষপাতে আইসক্রিম খাওয়ার সময়, মাঝেরপাড়ার তপন বলে ফেলেছেন, "কী সব পোশাক পরেছেন দাদা? এই বয়সে এসব মানায়?" ওমনি মেজাজ চটকে গেল। আপনি কিন্তু আগের নিরানব্বই জনের সবার নাম বা চেহারা মনেও রাখেননি কিন্তু তপনের কথাটা আজও কোনও বিয়েবাড়ি যাওয়ার সময় কানে বাজে। প্রকৃতপক্ষে, একটি নেতিবাচক তথ্য বা ঘটনা একটি ইতিবাচক বা নিরপেক্ষ তথ্য বা ঘটনার চেয়ে বেশি ওজনদার। আর একবার সেই নেতিবাচক তথ্য আমাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করলে তা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।

মানসিকভাবে খারাপ অভিজ্ঞতাগুলি আমাদের মস্তিষ্কের একাগ্রতা বা ফোকাসকে সংকীর্ণ করে। ওদিকে ইতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলি এটিকে প্রশস্ত করে৷ সহজভাবে বললে, ইতিবাচক উপলব্ধির ক্ষেত্রে আমাদের মস্তিষ্ক আশেপাশের থেকে যতটা পারে ধারণা শোষণ করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে, নেতিবাচক উপলব্ধির বেলায় আমাদের মস্তিষ্ক, সেই উপলব্ধির উৎস সম্পর্কে বেশি চিন্তা ভাবনা শুরু করে, তখন আমাদের চারপাশে কী ঘটছে তার কোনও খেয়াল থাকে না। শুধু যে কারণে মনখারাপ বা যেটি আমাদের বিরক্ত করে রেখেছে, সেটিই মাথার ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা থিয়েটার হলের মতো। ইতিবাচক আবেগগুলি অনেকটা হলঘরের আলোর মতো, তারা যখন একসঙ্গে জ্বলে ওঠে তখন থিয়েটার হলের সব কিছু দৃশ্যমান হয়। আবার যখন নেতিবাচক আবেগগুলি সেগুলিকে ম্লান করে দেয় এবং স্পটলাইট চালু করে, আমরা শুধু সেটাই দেখি, যা মঞ্চে ঘটছে।

মূলত, যদি কিছু একটা নেতিবাচক ঘটনা ঘটে, তখন আমরা তার সম্পর্কে আরও নাড়াঘাঁটা করতে থাকি। কারণ আমাদের মস্তিষ্ক তখন এটির উপরই 'ফোকাস' করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন আমাদের মস্তিষ্ক এমনটা করে? আসলে প্রকৃতির রূঢ় বাস্তবতায় দীর্ঘকাল ধরে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করে করে মানুষ দেখেছে, বেঁচে থাকতে গেলে আনন্দদায়ক জিনিসের বা মুহূর্তের ঢেঁকুর তোলার চেয়ে বিপদ এবং হুমকির মোকাবিলা করা বেশি জরুরি। সেজন্যই, প্রকৃতিগতভাবে আমাদের মস্তিষ্কে একটা বিপদ নির্ধারণ কৌশল বা থ্রেট ডিটেকশন মেকানিজম আছে। কোনও খারাপ খবরের আঁচ পেলে সে সতর্ক হয়ে যায়। আমাদের শক্তিশালী মস্তিষ্কের একটি খারাপ দিক হলো যে, এমনকী সবচেয়ে বিমূর্ত বা ধারণাগত জিনিসগুলিকেও আমরা বিপদ বা হুমকি হিসাবে ভাবতে থাকি এবং স্বভাবতই সেই বিষয়ে আমাদের মনোযোগ চলে যায়। খারাপ খবর আমাদের টানে বেশি।

আরও পড়ুন-প্রথমবার বাবা হওয়ার পর আয়তনে হ্রাস পাচ্ছে মস্তিষ্ক! নতুন গবেষণায় চাঞ্চল্য বিজ্ঞানমহলে

কিন্তু আশার কথা হচ্ছে যে, আমাদের মস্তিষ্কের নেতিবাচক জিনিসের মতোই ইতিবাচক জিনিসের প্রতিও পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। 'কন্ট্রাডিকশন' মনে হচ্ছে? আসলে যদি সময়ের সারণিতে হিসেব করি, তাহলে আমরা দেখব, কম সময়ের ক্ষেত্রে আমাদের মস্তিষ্ক নেতিবাচক ঘটনার পক্ষপাতদুষ্ট কিন্তু একটু লম্বা সময়ের বেলায় সে বেশ ইতিবাচক। খারাপ ঘটনার তথ্য আমাদের মাথায় ঢুকলে যেমন একটা আপৎকালীন সংকেত আসে, ঠিক তেমনই সেটি একবার স্মৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে গেলে নেতিবাচক আবেগ তুলনামূলকভাবে দ্রুত ম্লান হয়ে যায়। ঘটনাটার তথ্য মস্তিষ্কের স্মৃতিতে থেকে যায় ঠিকই কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত অপ্রীতিকর উপলব্ধি বা আবেগ ম্লান হয়ে যায়। ব্যাপারটা অনেকটা চুইংগাম চেবানোর মতো। প্রথমে এর স্বাদ থাকে, পরের দিকে চুইংগাম থাকলেও কোনও স্বাদ বা গন্ধ থাকে না। সেজন্যই বোধহয় আমরা বলি, 'time heals'!

মজার বিষয় হলো, ইতিবাচক আবেগের স্মৃতির সঙ্গে কিন্তু এটা ঘটে না। আমাদের পুরনো স্মৃতিগুলি ইতিবাচক দিকেই ঝুঁকতে চায়। আমাদের মস্তিষ্ককে বোঝার জন্য আমাদের স্মৃতিগুলিই সম্বল, কারণ এটি বিভিন্নভাবে আমাদের চিন্তাভাবনা এবং উপলব্ধিকে প্রভাবিত করে। এই সমস্ত কিছুর একটি ফলাফল হলো যে, আমরা প্রায়শই একটি ব্যপারে আশাবাদী, 'সময়ের স সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে"।

More Articles