পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে এমন পাঁচটি জায়গা আছে যেখানে... যেভাবে অসাধ্যসাধন করছে আদিত্য L1

Aditya L1 Solar Mission : পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে এমন পাঁচটা বিন্দু থাকা সম্ভব যেখানে কোনও ক্ষুদ্র বস্তুকে প্রতিস্থাপন করতে পারলেই বস্তুটি প্রায় স্থির হয়ে যাবে।

চন্দ্রযান সফল হওয়ার পরপরই গত বছর সেপ্টেম্বরে, আদিত্য নামক সৌরযানকে মহাশূন্যে পাঠিয়েছিল আমাদের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো। সম্প্রতি ৬ জানুয়ারি সফলভাবেই সেই যাত্রা উতরেছে ইসরো। আদিত্য পৃথিবীর টান অগ্রাহ্য করে পৌঁছে গেছে পৃথিবী থেকে প্রায় দেড় মিলিয়ন দূরে অবস্থিত প্রথম লাগ্রঁজ পয়েন্টে (L1)। শুধু তো পৌঁছলেই হবে না, ওই জায়গা থেকে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খেতে হবে একটি বিশেষ কক্ষপথে (হ্যালো অরবিট), আর পর্যবেক্ষণ করতে হবে সূর্যকে। কী এই লাগ্রঁজ পয়েন্ট বা লাগ্রঁজ বিন্দু? কেনই বা সেখানেই প্রতিস্থাপন করতে হবে আদিত্যকে?

সেটা জানতে গেলে আমাদেরকে এক বিখ্যাত গণিতজ্ঞের কথা জানতে হবে। নিউটনের সূত্র অনুযায়ী আমরা জানি, এই মহাবিশ্বের যেকোনও দু'টি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। এমনকী হাতের কাছে থাকা বলটিকে ৩০ ডিগ্রি কোণে ছুঁড়ে দিলে কত দূরে গিয়ে পড়বে বা শূন্যে কতক্ষণ অবস্থান করবে, সেসব হিসেব-নিকেশ নিমেষে করে ফেলা যায় নিউটন সাহেবের সূত্র অনুযায়ী। এই বিদ্যার পোশাকি নাম 'নিউটনিয়ান মেকানিক্স' বা 'নিউটনিয় বলবিদ্যা'। কিন্তু যদি একসঙ্গে তিনটি বস্তুর স্থান-কাল, গতি নিয়ে আলোচনা করতে হয়, যেমন পৃথিবী, সূর্য ও চাঁদ- তখন হিসেবটা একটু গোলমেলে হয়ে পড়ে। পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত যাঁদের রুটি- রুজি, তারা জানবেন এই ধরনের সমস্যার একটা পোশাকি নাম আছে, 'থ্রি বডি প্রবলেম'। এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে চর্চাও কম হয়নি।

আরও পড়ুন- রামমন্দিরের জয়ে আসলে হারল ভারতই?

অষ্টাদশ শতকে বিখ্যাত সুইস গণিতজ্ঞ, অয়লার ও ফরাসি গণিতজ্ঞ লাগ্রঁজ স্বাধীনভাবে এর সমাধান দেন। ফরাসি গণিতজ্ঞ লাগ্রঁজ এই 'থ্রি বডি সমস্যার' সমাধান লিপিবদ্ধ করেন তাঁর বিখ্যাত 'মেকানিক এনালিটিক' নামক বইতে। সেই থেকে জন্ম নিল এক নতুন বলবিদ্যা: লাগ্রঁজ বলবিদ্যা। তিনি বললেন দুটো বৃহৎ বস্তুর সঙ্গে একটা ছোট বস্তু যদি একই সমতলে নিজেদের মধ্যে সমান দূরত্ব রেখে ঘোরে, তাহলে এমন কিছু স্থান থাকা সম্ভব, যেখানে ছোট বস্তুর উপর কার্যগত মোট বল শূন্য। আসলে এক্ষেত্রে ছোট বস্তুর ঘূর্ণনের দরুন তৈরি কেন্দ্রাতিগ বল, তার উপরে ক্রিয়াশীল বৃহৎ বস্তুগুলোর মহাকর্ষীয় বলকে প্রশমিত করে। লাগ্রঁজের সম্মানে, সেইসব স্থানের নামকরণ করা হয় লাগ্রঁজ বিন্দু। একটা দুটো নয় এইরকম বিন্দু পাঁচটা থাকা সম্ভব, যেখানে ছোট বস্তুটির উপর মোট সম্মিলিত কার্যকরী বল শূন্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে এমন পাঁচটা বিন্দু থাকা সম্ভব যেখানে কোনও ক্ষুদ্র বস্তুকে প্রতিস্থাপন করতে পারলেই বস্তুটি প্রায় স্থির হয়ে যাবে।

এই পাঁচটি বিন্দুর যেকোনও একটিতে ছোট বস্তুটিকে রাখলে, সেটি বড় বস্তুদু'টির সঙ্গে দিব্যি তাল রেখে ঘুরতে পারে। এদের মধ্যে L1, L2, ও L3 বিন্দুগুলো সুস্থির নয়। এই বিন্দু তিনটি পৃথিবী ও সূর্যের সংযোগকারী রেখার উপর অবস্থিত। অপরদিকে পরস্পর বিপরীতমুখী দু'টি সমবাহু ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দু দু'টি, (L4, ও L5 ) সুস্থির বিন্দু বা স্টেবল পয়েন্ট। এখানেও একটা গণ্ডগোল আছে। বড় বস্তুদু'টির মধ্যে একটি অপরটির প্রায় ২৫ গুণ হলে, তবেই বিন্দুগুলি সুস্থির বিন্দুর মতো আচরণ করে।

ইসরো আদিত্যকে L1 পয়েন্টে প্রতিস্থাপন করতে পেরেছে যথাযথভাবে। না, একবার প্রতিস্থাপন করতে পারলেই দায়িত্ব শেষ নয়। সমস্যা একটা আছে! সেটা হচ্ছে পৃথিবীর ঘূর্ণন। সময়ের সাপেক্ষে পৃথিবীর গতিপথ যেহেতু বদলাচ্ছে, ফলে ওই লাগ্রঁজের বিন্দুর অবস্থানও বদলাবে একটু একটু করে। ফলে প্রতি মুহূর্তে নজরদারিতে রাখতে হবে যেন আদিত্যের উপরে মোট কার্যকরী বল শূন্য হয়। বিন্দুটির তাৎক্ষণিক অবস্থানকে কেন্দ্র করে একটি কক্ষপথ কল্পনা করে আদিত্যকে সেই কক্ষপথ বরাবর পৃথিবীর বেগের সমান বেগে ঘুরিয়ে দিতে পারলেই আদিত্যর উপর সম্মিলিত বলের মান শূন্য। ঘূর্ণনরত এই অবস্থায় একটানা সূর্যকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে সে। ফলে পৃথিবীতে বসে আমরা তথ্য পেতে থাকব নিয়মিত।

এই L1 পয়েন্টেই রয়েছে SOHO অর্থাৎ 'সোলার অ্যান্ড হেলিওস্ফেরিক অবজারভেটরি'। আবার L2 বিন্দুতে একসময় ছিল নাসার WMAP স্পেসক্রাফট। বিজ্ঞানীদের কাছে এটি বেশ পছন্দের স্থান কারণ এখান থেকে চাঁদ, পৃথিবী ও সূর্য তিনটিকেই নিরবিচ্ছিন্নভাবে লক্ষ্য করা যায়। এখানেই আছে বহুল আলোচিত জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ।

এত সব বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের মাঝে হয়তো মনে উঁকি দিতেই পারে, কী লাভ এই সৌর অভিযানে? পৃথিবীতে থাকা অনেক দূরবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে তো অনেকদিন ধরেই মহাজাগতিক অনেক কিছুই দেখে আসছি। কিন্তু সূর্যকে এখনও জানা বাকি, আমাদের চির পরিচিত এই নক্ষত্র এখনও অনেক রহস্যে মোড়া, যা আবিষ্ট করে রেখেছে পৃথিবী জোড়া সৌর বিজ্ঞানীদের। পৃথিবীতে বসে আমরা সূর্যের কেবল বাইরের দৃশ্যমান অংশ দেখতে পাই কিন্তু এর বাইরের আবহাওয়া সম্পর্কে বিশেষ আঁচ করতে পারি না। 'মহাকাশের আবহাওয়া'-কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বোঝাই হলো আদিত্য L1 এর মুখ্য উদ্দেশ্য।

আরও পড়ুন- চাঁদে যেতে গিয়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছিলেন ওঁরা

আসলে সুর্যের বাইরের যে স্তর অর্থাৎ ফটোস্ফিয়ারের উষ্ণতা ৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যেটি দৃশ্যমান ও অবলোহিত রশ্মি বিকিরণ করে। এই ফটোস্ফিয়ারের উপরে আছে ক্রমোস্ফিয়ার বা বর্ণমণ্ডল, তার উপরে কোরোনা অঞ্চল। সূর্যের কেন্দ্রের (উষ্ণতা প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস) থেকে ফটোস্ফিয়ারের উষ্ণতা অনেক কম, প্রায় ধর্তব্যের বাইরে। বর্ণমণ্ডলের তাপমাত্রা আবার সে তুলনায় অনেক বেশি, প্রায় মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস। করোনা অঞ্চলের উষ্ণতা আরও বেশি প্রায় ২ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রার হেরফেরের রহস্য, বিজ্ঞানীদেরকে অনেকদিন থেকেই ভাবাচ্ছে।

কোরোনা অঞ্চলের বিকিরণের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের থেকে ক্রমাগত আসতে থাকে আহিত কণার (ইলেকট্রন, প্রোটন, ও অন্যান্য আয়ন) স্রোত, যাকে আমরা সৌর ঝড় বলে চিনি। ক্ষেত্রবিশেষে, এই ঝড় উপগ্রহ ভিত্তিক টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থাকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীকে ঘিরে প্রায় ৭,০০০ স্যাটেলাইট ঘুরপাক খাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে আদিত্য যদি সৌরঝড়ের কোনও আভাস দিতে পারে, তা সৌরমণ্ডলের গবেষণায় একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে।

ইসরোর সৌরযান, আদিত্যর সঙ্গে এবার জুড়ে দেওয়া হয়েছে সাতটি পেলোড, যার মধ্যে চারটির কাজ খালি সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করা, আর বাকি তিনটি সৌর ঝড় ও সৌরচৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন বোঝার চেষ্টা করবে। এতে আছে সোলার আল্ট্রভায়োলেট ইমেজিং টেলিস্কোপ বা 'সুট', যেটি দিয়ে সৌরকলঙ্কের ছবি তোলা যাবে। সম্পূর্ণ দেশিয় প্রযুক্তিতে তৈরি এটি। অয়লার ও লাগ্রঁজর কালজয়ী গণনায় ভর করে তৈরি আদিত্য, আগামী কয়েক বছর সূর্যের চারপাশের আবহাওয়াকে গভীর ভাবে বোঝার চেষ্টা করবে।

More Articles