এক দেশ, এক নির্বাচন! সারা দেশে একসঙ্গে নির্বাচন কেন চাইছে বিজেপি?
One Nation, One Election : ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত রাজ্যের বিধানসভা এবং লোকসভার একসঙ্গেই নির্বাচন হতো ভারতে।
নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান হতে পারে, সেখানে যতই বৈচিত্র্য থাকুক না কেন সংসদীয় গণতন্ত্রে নিজের সরকার বাছাইয়ে এবার অভিন্ন নিয়ম আসতে পারে। অন্তত সরকার বাছাইয়ের দিন নিয়ে এক এবার সারাদেশে এক নিয়ম চালু হওয়ার বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্র সরকার সংসদের বিশেষ অধিবেশন চলাকালীন 'এক দেশ, এক নির্বাচন' বিল পেশ করতে পারে।
এক দেশ, এক নির্বাচন কী?
'এক দেশ, এক নির্বাচন' ধারণাটির মূল নির্যাস হচ্ছে, সারাদেশে একযোগে নির্বাচনের আয়োজন। দেশে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে বিধানসভা নির্বাচন হয়, এবং সারা দেশে লোকসভা ভোটের দিনটিও আবার আলাদা। কিন্তু এক দেশ, এক নির্বাচনের মানে হচ্ছে যে, সারা ভারত জুড়ে লোকসভা এবং সমস্ত রাজ্যজুড়ে বিধানসভার নির্বাচন একযোগে অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমানে প্রতিটি রাজ্যের বিধানসভা এবং লোকসভার নির্বাচন পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত হয় কারণ সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার দিনটি প্রতিক্ষেত্রেই আলাদা। কিন্তু হঠাৎ সরকার একসঙ্গে সমস্ত নির্বাচনের আয়োজন করতে চাইছে কেন?
সুবিধা কী কী?
একসঙ্গে সমস্ত নির্বাচন আয়োজনের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় যে কারণটি দেখানো হচ্ছে তা হলো, পৃথক নির্বাচনের খরচ কমানো। সরকারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৬০,০০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। যে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে লড়াই করছে তাদের খরচ এবং ভারতের নির্বাচন কমিশন নির্বাচন আয়োজনে যা খরচ করেছে সব মিলিয়েই এই বিপুল অঙ্ক।
পাশাপাশি, একসঙ্গে নির্বাচনের সমর্থনে দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় দক্ষতার দিকটিও তুলে ধরা হচ্ছে। ভোটের সময় দেশের প্রশাসনিক লাগাম যথেষ্ট আলগা হয়ে যায় কারণ প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা ভোটগ্রহণের দায়িত্বে নিযুক্ত হয়ে পড়েন।
কেন্দ্রের যুক্তি হচ্ছে, এক দেশ এক নির্বাচন হলে তা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নীতি এবং কর্মসূচির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতেও সাহায্য করবে। এখন যখনই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখনই আদর্শ আচরণবিধি জারি করা হয়। নির্বাচনের ঘোষণা থেকে ভোটের ফলাফল ঘোষণার দীর্ঘ সময়ের মধ্যে জনকল্যাণের নতুন প্রকল্প চালু বা ঘোষণা করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
আইন কমিশন বলছে, একসঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়বে কারণ মানুষের পক্ষে একবারে দু'টি ভোট দেওয়া আরও সুবিধাজনক।
আরও পড়ুন- সারা বিশ্বের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল নরেন্দ্র মোদির নির্বুদ্ধিতা
অসুবিধা কী কী?
সুবিধার ছায়ায় বাড়ে অসুবিধাও। একসঙ্গে নির্বাচন আয়োজনের নানা সমস্যাও আছে। সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে, একসঙ্গে বিধানসভা আর লোকসভা নির্বাচন আয়োজন করতে গেলে সবার আগে লোকসভার সঙ্গে রাজ্য বিধানসভার শর্তাবলীর সমন্বয় ঘটাতে সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রয়োজন হবে। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের পাশাপাশি অন্যান্য সংসদীয় পদ্ধতিতেও সংশোধন করতে হবে।
একসঙ্গে নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে কেন্দ্রের দাপট। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক দলগুলোর বড় ভয় হচ্ছে জাতীয় ইস্যুগুলো কেন্দ্রের হাতে থাকায় রাজ্যের স্থানীয় ইস্যুগুলি জোরালোভাবে সামনে আসতে পারবে না। নির্বাচনী ব্যয় ও নির্বাচনী কৌশলের ক্ষেত্রেও জাতীয় দলগুলোর সঙ্গে পেরেই উঠবে না রাজ্যের দলগুলি।
২০১৫ সালে IDFC ইনস্টিটিউট পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, একইসঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভোটাররা যে রাজ্য বিধানসভা এবং লোকসভায় একই রাজনৈতিক দল বা জোটকে বেছে নেবে এর সম্ভাবনা ৭৭ শতাংশ। তবে ছয় মাস ব্যবধানে নির্বাচন হলে মাত্র ৬১ শতাংশ ভোটার একই দলকে বেছে নেবেন।
এক দেশ এক নির্বাচনের ধারণাটির সমর্থক কারা?
১৯৬৭ সাল পর্যন্ত রাজ্যের বিধানসভা এবং লোকসভার একসঙ্গেই নির্বাচন হতো ভারতে। ১৯৬৮ এবং ১৯৬৯ সালে কিছু বিধানসভা এবং ১৯৭০ সালে লোকসভা অকালে ভেঙে গেলে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়।
এর এক দশক পর, ১৯৮৩ সালে নির্বাচন কমিশন একসঙ্গে নির্বাচন আয়োজন ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দেয়। তবে কমিশন তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তৎকালীন সরকার এর বিরুদ্ধেই সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৯ সালের আইন কমিশনের রিপোর্টে আবার একসঙ্গে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়টিকে জোর দেওয়া হয়।
এইবার বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে বিজেপি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নিজেদের নির্বাচনী ইস্তাহারেই বলেছিল যে রাজ্য সরকারগুলির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য একসঙ্গে সমস্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি পদ্ধতি তৈরি করতে চাইবে বিজেপি৷ ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আবারও বিষয়টা নিয়ে কথাবার্তা বলতে থাকেন। ২০১৭ সালে, নীতি আয়োগ একসঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে।
২০১৮ সালে আইন কমিশন জানায়, একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য কমপক্ষে পাঁচটি সাংবিধানিক সুপারিশের প্রয়োজন। ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র এক মাস পরেই প্রধানমন্ত্রী মোদি একসঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধানদের সঙ্গে দেখা করেন। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, বহুজন সমাজ পার্টি, সমাজবাদী পার্টি এবং দ্রাবিড় মুনেত্র কাঝঘম সহ বেশ কয়েকটি বিরোধী দল এই বৈঠক থেকে দূরে ছিল। আম আদমি পার্টি, তেলেগু দেশম পার্টি এবং ভারত রাষ্ট্র সমিতি অবশ্য যোগ দেয় সেই বৈঠকে।
আরও পড়ুন- কোনও ধর্মের জন্য আর আলাদা বিধি নয়! অভিন্ন দেওয়ানি বিধির নামে কী চাইছেন মোদি?
২০২২ সালে, তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুশীল চন্দ্র জানিয়েছিলেন, নির্বাচন কমিশন একসঙ্গে সব নির্বাচন পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত এবং সক্ষম। তবে এই ধারণাটি বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে এবং সংসদে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ওই বছরই ডিসেম্বরে আইন কমিশন দেশে একসঙ্গে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাবে জাতীয় রাজনৈতিক দল, ভারতের নির্বাচন কমিশন, আমলা, শিক্ষাবিদ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত চেয়েছিল।
বিরোধিতা করছেন কারা?
প্রধানমন্ত্রী মোদি 'এক দেশ, এক নির্বাচন'-এর জন্য চাপ দেওয়া শুরু করতেই বিরোধী দলগুলি এই ধারণার বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের মতে এটি অসাংবিধানিক এবং গণতন্ত্রের নীতিবিরুদ্ধ। এই বছরের জানুয়ারিতে, আম আদমি পার্টি অভিযোগ করে যে বিজেপি রাষ্ট্রপতি শাসনের সঙ্গে সংসদীয় কাঠামোর সরকারকে বদলে দিতেই একযোগে নির্বাচনের প্রস্তাব দিচ্ছে।
শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে শিবির জানিয়েছে, যদি স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে পরামর্শ না করে আইনটি কার্যকর করা হয় তবে এই শিবির তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে। রাষ্ট্রীয় জনতা দল, জনতা দল (ইউনাইটেড) এবং সমাজবাদী পার্টি সহ INDIA জোটের অংশ অন্য দলগুলিও এই ধারণার বিরোধিতা করেছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কেন্দ্রে অটুট রইলেও, বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে হারছে বিজেপি। রাজ্যের আর কেন্দ্রের নির্বাচন একসঙ্গে করে দাপট বজায় রাখাই কি 'এক দেশ, এক নির্বাচনের' লক্ষ্য তবে?