রাহুল গান্ধির নয়, এ পরাজয় আঞ্চলিক মনসবদারদের
Assembly Election 2023: তেলেঙ্গানায় রেবন্ত পারলেন, অথচ পারলেন না কমল নাথ, ভূপেশ বাগেলের মতো অভিজ্ঞ নেতারা। কোথায় কোথায় ভুল থেকে গিয়েছিল কংগ্রেসের? আলোচনায় সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য
বিজেপি যে দলের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অংশও সাবলীল ভাবে পরিচালনার দক্ষতা রাখে—তা ২০২৩-এর বিধানসভায় স্পষ্ট হয়ে গেল। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়—এই তিন রাজ্যে কংগ্রেস যে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। একটা আত্মতুষ্টির মনোভাব এসে গিয়েছিল নেতাদের। এবং কংগ্রেস যে কটা রাজ্যে জিতছে, ঐ পরিচালনার দক্ষতার জন্যেই জিতেছে। যেমন তেলেঙ্গানায়, রেবন্ত রেড্ডি এক মিনিটও বসে থাকার লোক নন। সারাক্ষণ সংগঠনের কাজে ব্যস্ত। বিধানসভা নির্বাচনে রেবন্ত এবং কেসিআর, দুজনেই একটা সিটে বিজেপির কাছে হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু রেবন্ত লড়াইটা সর্বান্তকরণে লড়েছেন। বাকিদের মধ্যেও সেই উদ্দীপনার ছোঁয়া লেগেছিল। ২০২১-এর নির্বাচনে যেমন মমতা নিজে হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু দলের বাকিরা লড়ে গিয়েছিলেন। সেই জায়গাটা রেবন্ত তৈরি করতে পেরেছিলেন, কিন্তু ভূপেশ বাগেলের তা ছিল না।
বোঝাপড়ার অভাব
ছত্তিশগড়ের অনেক জায়গাতেই জাতিগত সমীকরণ কাজ করে। বিশেষত বাস্তার এবং সার্গুজা—এই দুটো জেলায় নকশালবাদীদের বেশ প্রভাব রয়েছে। সেখানে গত বিধানসভা নির্বাচনেও কংগ্রেস খুব ভালো ফলাফল করেছিল। এবার দেখা গেল সেখানে বিজেপি প্রচুর আসন জিতেছে। আদিবাসীদের সিংহভাগ ভোট বিজেপিতে গেছে। তার মূলে অবশ্যই বিজেপির বনবাসীকল্যাণ প্রকল্পের একটা ভূমিকা রয়েছে। আর এস এস সেখানে ক্রমাগত কাজ করে চলেছে। কিন্তু কংগ্রেস ওখানকার ক্ষমতাবান আদিবাসী নেতা-দলিতনেতাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা বা সমঝোতাই করেনি। অথচ খুব প্রয়োজন ছিল। পাশের রাজ্য তেলেঙ্গানায় কংগ্রেস সিপিআই-কে একটা আসন ছেড়েছে। ছত্তিশগড়ে এই সামান্য বোঝাপড়াটুকুও করতে চায়নি তারা। তারপরেও সিপিআই একটা আসন জিতে গিয়েছে। প্রায় সমস্ত আসনেই সিপিআই-এর ভোট রয়েছে হাজার দেড় হাজার। বিষয় হল, কংগ্রেস প্রায় পাঁচটি আসন খুবই কম ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছে। কাকে-তে মাত্র ষোলোটা ভোটের জন্য জিততে পারেনি। এখানেই একটু সমঝোতার প্রয়োজন ছিল। এইসব আসনে সিপিআই-এর হাজার দেড় হাজার না হোক, পাঁচশো ভোটও যদি কংগ্রেস পেত, নির্বাচনের ফলাফল অন্যরকম হতে পারত ছত্তিশগড়ে।
আরও পড়ুন: জিতেও মুখ্যমন্ত্রী হতে পারছেন না রেবন্ত রেড্ডি! তেলঙ্গানাতে কংগ্রেসের মধ্যেই ফের সংঘাত কেন?
পরাজয় মনসবদারদের
কংগ্রেসের এই পরাজয় যতটা না রাহুল গান্ধির পরাজয়, তার থেকে অনেক বেশি কমলনাথ, ভূপেশ বাগেল বা অশোক গেলটের পরাজয়। এঁরা এক একজন আঞ্চলিক মনসবদার। এঁদেরকে রাহুল গান্ধিও ঘাঁটাতে যাননি। কমল নাথ তো যা খুশি তাই করেছেন! ইন্ডিয়া জোট কয়েকজন নির্বাচিত সঞ্চালকদের সঙ্গে কথা বলবে না ঠিক করেছিল। নাভিকা কুমার সেই তালিকায় ছিলেন। কমল নাথ তাঁকে সাক্ষাৎকার দিয়ে এসেছেন। যেটা নিয়ে গোটা ইন্ডিয়া শিবিরে মানুষ বিক্ষুব্ধ। দ্বিতীয়ত, ইন্ডিয়া জোটের কে সি ভেনুগোপাল, কংগ্রেসের সাংগঠনিক সম্পাদক, তিনি ২ সেপ্টেম্বর ভূপালে বৈঠক ঘোষণা করলেন। উত্তরে কমল নাথ বললেন, এই বৈঠকের কোনো দরকারই নেই। কমল নাথ এই যে যা ইচ্ছে তাই করে গেলেন, এর অন্যতম কারণ তাঁর আত্মতুষ্টি। কেন? কারণ দু মাস আগেও বিভিন্ন চ্যানেলে যে জনমত সমীক্ষা গুলো প্রচারিত হচ্ছিল, সেখানে কংগ্রেসের আসন ছিল প্রায় ১৫০ থেকে ১৩০-এর মধ্যে। ফলে তৃণমূল স্তরে কংগ্রেস জিতছে এমন একটা আবহাওয়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এই আবহাওয়াটাই কমলনাথের আত্মতুষ্টির জন্য দায়ী। এমনকি নির্বাচনী প্রচারের ব্যাপারেও যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছে, তিনি তাঁর ছেলে নকুলনাথ ও দিগ্বিজয় সিং-এর ছেলে জয়বর্ধনের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন। বলা যায় রাজনীতির মঞ্চটিতে কমলনাথ প্রায় ছিলেনই না। ইনস্ক্রিপ্ট একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছে। দেখা যাচ্ছে, সার্বিক ভাবে চারটি রাজ্যের মোট ভোটের নিরিখে কংগ্রেস বিজেপির থেকে অনেক বেশি ভোট পেয়েছে। কিন্তু সেই ভোট বিশেষ বিশেষ আসনগুলিতে টানা যায়নি। অন্তত ফলাফল সেই কথাই বলছে।
জায়গা পান না নতুনেরা
এবার রাজস্থানের প্রসঙ্গে আসি। আশোক গেলট রাজস্থানে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যতটা জনপ্রিয়, তাঁর মন্ত্রীরা ঠিক ততখানিই চক্ষুশূল মানুষের। তাঁর দলের মোট বারো জন মন্ত্রী হেরে গিয়েছেন। সংখ্যাটা কম নয়। এর প্রভাব কাটাতে চাইলে দলের নিচের তলার খোলনলচে পালটে ফেলার দরকার ছিল। শচীন পাইলটকেও আরেকটু গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হবার নয়। কংগ্রেসের সমস্যাটাই হল অশোক গেলট, কমলনাথের মতো পুরনো নেতারা নতুনদের জায়গা ছাড়তে নারাজ। জ্যোতিরাদিত্য সিন্দিয়া চেয়েছিলেন রাজ্যসভার একটা আসন। তাঁকে জায়গা না দিয়ে, আসন দেওয়া হল দিগ্বিজয় সিং-কে। ফলে কী হল? বেরিয়ে গেলেন জ্যোতিরাদিত্য! শচীন পাইলট কেবল উপ-মুখ্যমন্ত্রী হয়েই থেকে যেতে চেয়েছিলেন। সে আর্জিও খারিজ হয়ে গেল। কীভাবে এগোবে সংগঠন? রাজস্থানে সিপিএম খুব শক্তিশালী নয়, কিন্তু আট-দশটা আসনে তাদের একটা ভূমিকা আছে। সিপিএমের সঙ্গে রাজস্থানে কংগ্রেসের তেমন বিরোধও নেই। কিন্তু তাদেরও আসন ছাড়া হল না। ভারতীয় আদিবাসী পার্টি এবং ছোটু যাদবের ভারতীয় ট্রাইবাল পার্টি—দুটি দলের সঙ্গেই ২০১৮-তে সমঝোতা হয়েছিল কংগ্রেসের। সমঝোতা হল না তাদের সঙ্গেও। এর মূলে ওই আঞ্চলিক মনসবদারেরা। কেবলমাত্র নিজের লোককে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এঁরা দলের ক্ষতি করেন। যেখানে হার নিশ্চিত, সেখানেও জোটের কাউকে আসতে দেন না। বুন্দেলখণ্ডের পাঁচটা আসন সমাজবাদী পার্টিকে ছেড়ে দিলে কংগ্রেসের কী ক্ষতি হত? মধ্যপ্রদেশের যেখানে ২৩০ খানা আসন! কিন্তু কমলনাথ দিলেন না। নিশ্চয় সেই সব আসনে তাঁর এমন তাঁবেদারেরা ছিল, যাদের তিনি বাদ দিতে চাইছিলেন না। রেবন্তের কাজটা বেশ সহজ ছিল। কারণ, কোনও উপায় ছিল না। কংগ্রেসের মোট উনিশজন এমএলএ-র মধ্যে দশ জন দল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে প্রায় শূন্য থেকে ফের দল গড়ে তুলতে হয়েছে তাঁকে। কর্ণাটক নির্বাচনের আগে কেউ তেলেঙ্গানাকে নিয়ে ভাবছিলই না। কর্ণাটকে কংগ্রেসের জিতে যাওয়া দক্ষিণ ভারতে দলটির সম্পর্কে মানুষের চিন্তাধারাটাই পাল্টে দিল। তখন দলে দলে লোক তেলেঙ্গানাতেও কংগ্রেসে আসতে শুরু করল। ফলে সেখানে লড়াইয়ের সমীকরণটা ছিল অন্যরকম।
হারাটাও অভ্যেস
আসলে জেতাটা যেমন একটা অভ্যেস, হারাটাও ঠিক তেমন। কংগ্রেসেরই এক মুখপাত্রের কথা। তিনি নিজেই বলছিলেন, কংগ্রেসের হারাটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে যদি বলি, কাউন্সিলর নির্বাচনে যাঁর আছেই সাকুল্যে বারোটি ভোট, তিনিও সংবাদমাধ্যমের চ্যানেলে এসে সকাল থেকে ব্যাখ্যা করেন, কেন তৃনমূলের সঙ্গে জোট করা উচিত নয়! তিনি নাকি তাঁর সমস্ত ভোট হারাবেন এই জোটের ফলে। কিন্তু এঁদের দল সরায় না। কারণ তিনি পঁচিশ বছর ধরে দল করছেন। পঁচিশ বছরে লাভের লাভ যা হয়েছে, নিজের এলাকায় দলটা কেবলমাত্র সাইনবোর্ড হয়ে থেকে গিয়েছে। এই 'বিদ্রোহী'দের নিয়ে নির্বাচনে নামলে সমস্যা তো হবেই। মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনে কংগ্রেসের এই ঝোঁকটিই দেখা গিয়েছে। রেবন্তকে এই ঝামেলাটা পোহাতে হয়নি। তেলেঙ্গানা নির্বাচনের ফলাফলই তার প্রমাণ। রাহুল গান্ধি রেবন্তকে সেই স্বাধীনতাও দিয়েছিলেন। রেবন্ত রেড্ডি দুই হাতে নতুন লোক নিয়েছেন। বিআরএসের মন্ত্রীই হোন বা বিজেপি থেকে ফিরতে চাওয়া কংগ্রেসের প্রাক্তন মন্ত্রী, সবাইকে জায়গা দিয়েছেন তাঁর দলে। কোন প্রার্থী জিততে পারবে—তার একটা পরিষ্কার ধারণা তাঁর ছিল। কারণ এইসব ব্যাপারগুলো খতিয়ে দেখার জন্য তাঁর একজন বিশ্বস্ত লোকও ছিল। কিন্তু রণদীপ সিং সুরজেওয়ালার কথা কমলনাথ শুনলেনই না! কংগ্রেসের স্ট্র্যাটেজিস্ট সুনীল কানুগোলু রাজস্থানে ঢুকতেই পারলেন না। ভূপেশ বাগেলকে কেউ বোঝাতেই পারল না যে অরবিন্দ নেতা হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, তাঁর ভাগের যে দেড়-দু শতাংশ ভোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন: কংগ্রেসের শোচনীয় হারের পর ইন্ডিয়ার বৈঠক, কেন যাচ্ছেন না মমতা?
কংগ্রসের সংগঠন দুর্বল
কংগ্রেসের সবথেকে বড় সমস্যা নিজের দুর্বলতা চিহ্নিত করতে না পারা। পশ্চিমবঙ্গে যখন 'নো ভোট টু বিজেপি' প্রচার শুরু হয়, নকশালপন্থীদের এই প্রচার দেখে বিজেপির অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই প্রচারে তাঁদের কি কোনও সমস্যা হবে? মমতার ভোট কি এতে আদৌ বাড়বে? এদের তো নিজেদেরই ভোট নেই! কথাটা ঠিকই। কিন্তু এই যে সারাদিনব্যাপী একটা প্রচার, এতে ৫ থেকে ৭ শতাংশ ভোট কিন্তু তৃণমূলে গিয়েছে। কংগ্রেসের এই তিন নেতা অশোক গেলট, ভূপেশ বাগেল এবং কমলনাথ—এঁদের এইসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। কোনও ছোট দলকেই আমল দেব না—এই জাতীয় মনোবৃত্তি নিজেদেরই বিপর্যয় ডেকে আনবে। ছোট ছোট আঞ্চলিক দলগুলি জোটে এসে বিরাট কিছু করে ফেলবে না। কিন্তু তাদের জায়গা দিলে একটু একটু করে যে সমর্থন জড়ো হবে, তা কিন্তু সামগ্রিক ভোটে বড় প্রভাব ফেলবে। আজ তেলেঙ্গানায় নরেন্দ্র মোদীর সাফল্য দেখুন। তেলেঙ্গানায় বিজেপি নেতা পবন কল্যাণকে কেউ চিনতই না। কিন্তু মোদী তাঁর সঙ্গে একটা সেলফি তুলে ফেললেন। সেই ছবি দেখিয়ে পবন কল্যাণ প্রচার করতে শুরু করলেন এবার তেলেঙ্গানায় তাঁরাই জিতছেন। এই হাওয়াতে তেলেঙ্গানায় বিজেপির আসন এক থেকে বেড়ে দশ হয়ে গেল। কাকে দিয়ে কীভাবে কাজ হবে—এটা যেমন বিজেপি খুব ভালো বোঝে, কংগ্রেসের তিন পরাজিত নেতা এই সাংগঠনিক দিকটিকে আমলই দেননি। ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রতি হাজার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও জ্যোতিবাবু তাঁদের ফ্রন্টে রেখেছিলেন। কেন? না, তাঁরা থাকলে আজও বাঙালি ভাবে নেতাজি ফ্রন্টের সঙ্গে রয়েছেন। এই যে বৃহত্তর লাভের প্রশ্ন, সাংগঠনিক লাভের প্রশ্ন, কংগ্রেসের আঞ্চলিক মনসবদারেরা ক্ষুদ্র স্বার্থ পেরিয়ে সেটা বুঝে উঠতেই পারলেন না। তাই নির্বাচনে এই শোচনীয় ব্যর্থতা তাঁদের