কাশ্মীরের শান্তি নষ্টের মূল কারিগর, কাশ্মীর টাইগার আসলে কারা?

Kathua Army Convoy Attack: সোমবারের হামলার ঘটনায় দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী কাশ্মীর টাইগার্স। কারা এই কাশ্মীর টাইগার্স? কীসের জোরে উপত্যকা জুড়ে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে তারা?

লোকসভা ভোটের বাজারে বাধা-উপদ্রবহীন ভোট পড়া থেকে শাসক থেকে বিরোধী, এক বাক্যে মেনেছিল আগের তুলনায় শান্তি ফিরেছে কাশ্মীরে। তবে খুব বেশিদিন নয়। তার মধ্যেই ফের জঙ্গি হামলায় অশান্ত হয়ে উঠল জম্মু-কাশ্মীর উপত্যকা। পুলওয়ামার কায়দায় সেনা কনভয়ে রক্তক্ষয়ী হামলা, টানা কয়েক দিন ধরে একের পর এক জঙ্গি হামলার কবলে কাশ্মীর। শনি, রবিবারের হামলায় লস্কর বা হিজবুল জঙ্গিগোষ্ঠীর যুক্ত থাকার আশঙ্কা থাকলেও সোমবার কাঠুয়ার ঘটনার দায় নিয়েছে জইশ গোষ্ঠীর শাখা সংগঠন কাশ্মীর টাইগার।

সোমবার জম্মুর কাঠুয়া জেলার কান্দি এলাকার লোহাই মালহারের জৈন্দা নালার কাছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়ি লক্ষ্য করে হামলা চালায় জঙ্গিরা। ভারতীয় সেনার ৯ কোর বাহিনী ছিল ওই কনভয়ে। সূত্রের খবর, প্রথমে পাহাড়ের মাথা থেকে সেনাবাহিনীর গাড়ি লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়ে জঙ্গিরা। তারপর এলোপাথাড়ি গুলি চালানো শুরু হয়। পাল্টা জবার দেয় সেনাও। শুরু হয় গুলির লড়াই। ওই হামলায় এক জুনিয়র কমিশনড অফিসার-সহ মোট ৫ সেনাজওয়ানের মৃত্যুর খবর মিলেছে। তাঁরা প্রত্যেকেই উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দা বলে জানা গিয়েছে। সোমবার জঙ্গিদের অতর্কিতে আক্রমণের পর ২২ গাড়ওয়াল রেজিমেন্টের জওয়ানরা আহত সহকর্মীদের বাঁচাতে ৫,১০০ রাউন্ডেরও বেশি গুলি চালায় বলে খবর। আর তাতেই পিছু হঠতে বাধ্য হয় জঙ্গিরা। ওই ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ৫ জওয়ান। জঙ্গিরা তিনটি দলে ভাগ হয়ে হামলা চালিয়েছিল বলে অনুমান। বিভিন্ন জায়গা থেকে একই সঙ্গে সেনা কনভয়ের উপর হামলা চালাতে থাকে তারা।

আরও পড়ুন: খাপছাড়া শৈশব থেকে প্রশাসনিক ভুল! ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি উজেইরকে ভূস্বর্গের জঙ্গি বানাল যারা…

এর আগে গত শনিবার কুলগামের ফ্রিজল চিন্নিগাম এলাকায় জঙ্গিদের লুকিয়ে থাকার খবর পেয়ে গোটা এলাকা ঘিরে তল্লাশি অভিযান শুরু করে সিআরপিএফ, সেনা এবং পুলিশের যৌথ বাহিনী। তল্লাশি অভিযান চলাকালীন পিছু হঠার জায়গা না পেয়ে নিরাপত্তাবাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে জঙ্গিরা। পাল্টা জবাব দেয় সেনাও। দু'পক্ষের গুলির লড়াইয়ে চার জঙ্গির মৃত্যু হয়। মৃত চার জঙ্গি লস্কর-ই-তৈবার সদস্য বলে মনে করা হচ্ছে। স্থানীয় একটি বাড়িতে নকল আলমারির পিছনে বাঙ্কার তৈরি করে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল তারা। ওই দিন রাতেই মাঞ্জাকোট সেনা ক্যাম্পে হামলা চালানোর চেষ্টা করে জঙ্গিরা। তাতে আরও দুই জঙ্গির মৃত্যু হয়। রবিবার রাজৌরির সেনা ক্যাম্পে সন্ত্রাস-হামলায় এক জন সেনাকর্মী আহত হন। তার পরেই সোমবার কাঠুয়াতে বড়সড় হামলার ছক।

কাঠুয়ায় সেনা কনভয়ে গ্রেনেড হামলা চালানো জঙ্গিদের খোঁজে তল্লাশি অভিযান শুরু করেন জওয়ানরা। ঘাদি ভাগওয়া জঙ্গলে কিছু সন্ত্রাসবাদী লুকিয়ে রয়েছে বলে আগেই খবর পেয়েছিল সেনা। সেই মতো শুরু হয়েছিল অভিযান। সে সময় ফের আচমকা হামলা চালায় জঙ্গিরা। জওয়ানদের লক্ষ্য করে জঙ্গল থেকেই গুলিবৃষ্টি শুরু করে তারা। পালটা জবাব দেয় সেনাও। দোদা জেলাতেও চলেছে জঙ্গি-সেনা এনকাউন্টার। স্থানীয় গোলি-গাদি জঙ্গলের মধ্যে একাধিক জঙ্গি লুকিয়ে রয়েছে বলে খবর রয়েছে পুলিশের কাছে। যদিও এখনও পর্যন্ত কোনও জঙ্গি নিকেশের খবর মেলেনি। ইতিমধ্যেই কাঠুয়ার ঘটনায় এক ট্রাকচালক-সহ ৫০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে পুলিশ। স্থানীয় এলাকাগুলিতেও তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ। ওই ট্রাকচালকের বিরুদ্ধে অভিযাগ, তিনি নাকি ইচ্ছা করেই কালভার্ট দিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করে কনভয়কে দেরি করিয়ে দেন। সেই অভিযোগ সত্যি কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একে ঘন জঙ্গল, তার উপর ভারী বৃষ্টি হওয়ায় তল্লাশি অভিযান চালাতে গিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে পুলিশ ও সেনাকে। জঙ্গিরা এখনও জঙ্গলেই ঘাপটি মেরে রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। উধমপুর, সাম্বা, রাজৌরি ও পুঞ্চ জেলার জঙ্গলে টানা তল্লাশি চালানো হচ্ছে।

সোমবারের হামলার ঘটনায় দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী কাশ্মীর টাইগার্স। কারা এই কাশ্মীর টাইগার্স? কীসের জোরে উপত্যকা জুড়ে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে এরা? যতদূর জানা যায়, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মহম্মদ (জেএম)-এর ছায়া সংগঠন এই কাশ্মীর টাইগার্স। ২০২১ সালে জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের পরেই শিরোনামে আসে এই কাশ্মীর টাইগারেরা। ২০২১ সালের জুন মাসে দক্ষিণ কাশ্মীরে একটি গ্রেনেড হামলার দায় স্বীকার করে তারা। ওই বছরেরই ডিসেম্বরে শ্রীনগরে একটি পুলিশের বাসে হামলা চালায় টাইগাররা। সেই হামলায় তিন জন নিহত ও ১১ জন আহত হন।

সূত্রের খবর, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর থেকে বারংবার পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উপর হামলা চালিয়েছে কাশ্মীর টাইগার। তবে উপত্যাকায় শুধু এরাই নয়, একই সঙ্গে জইশ-ই মহম্মদ, হিজবুল মুজাহিদিন হা লস্কর-ই-তইবার মতো একাধিক জঙ্গিসংগঠন সক্রিয় রয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের একটি অংশের দাবি, বাকি জঙ্গিসংগঠনগুলির থেকে এই টাইগাররা আলাদা। বাকি সব কটি সংগঠনের নামের সঙ্গে পাকিস্তান এবং ধর্মের যোগ থাকলেও, এই কাশ্মীর টাইগার নামটি ধর্মনিরপেক্ষ বলেই মনে করছে তারা। তবে তার সঙ্গে আদৌ তাদের মতাদর্শের মিল রয়েছে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে নামে যা-ই থাক না কেন, সন্ত্রাস ছড়ানোর ব্যাপারে কোনও অন্য পথে হাঁটছে না এই নয়া জঙ্গি সংগঠনটিও। তবে জইশেরই শাখা সংগঠন যখন, তখন পাক মদতপুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কোনও মতেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একই সঙ্গে জঙ্গিদের এই নতুন সংগঠনটি দেশের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছে, যাতে মনে হয় উপত্যকা এখনও জঙ্গিতেই ভরা। ৩৭০ ধারা বাতিলের পরে কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরকে জঙ্গিমুক্ত করা নিয়ে যে দাবি করেছে, তাকে মিথ্যাপ্রমাণ করাই যেন উদ্দেশ্য এই কাশ্মীর টাইগারদের। যদিও পুলিশের দাবি, আপাতত তাদের লোকবল ১৫০-২০০ জঙ্গির বলেই মনে করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, কাঠুয়ায় হামলাটি চালানোর জন্যজঙ্গিরা বেশ কিছুদিন আগেই বেআইনি অনুপ্রবেশ করে স্থানীয় এলাকাতেই ঘাঁটি গেড়েছিল। এমনকী, অত্যাধুনিক হাতিয়ার প্রয়োগ করা হয়েছে বলেও অনুমান সেনার।

আরও পড়ুন: কুখ্যাত ২২ অক্টোবরের স্মৃতি আজও দগদগে! কোনও দিন কি ফুরোবে কাশ্মীরের ‘কালো অধ্যায়’?

অমরনাথ যাত্রার সময় বারবার এমন জঙ্গিহামলার ঘটনা প্রশাসনের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। আগামী দিনে আরও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে চলেছে সেনা বাহিনী। উল্লেখ্য, রেয়াসিতে পুণ্যার্থীদের বাসে জঙ্গি হামলার পর কেন্দ্রের তরফে উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছিল। সেইমতো অলআউট অভিযানে নেমেছে সেনাবাহিনী। জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ সূত্রে জানা যাচ্ছে, বর্তমানে উপত্যকায় সক্রিয় ৭০ জন পাক জঙ্গিকে নিশানা করেই লাগাতার অভিযান চালাচ্ছে বাহিনী।

More Articles