কেজরিওয়ালের পরে কে? ইডি-সিবিআই অস্ত্রের নিশানায় এবার কারা?

Arvind Kejriwal: বিভিন্ন অবিজেপি রাজ্যে বিরোধীস্বরকে রুখতে নয়া অস্ত্র যেন ইডি-সিবিআই। প্রথমে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। তার পরেই খাঁড়া এসে নামল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাঁধে।

লোকসভা ভোট সামনেই। এই সময়েই একের পর এক অবিজেপি রাজ্যগুলিতে জোরদার ধরপাকড় শুরু করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি। ঝাড়খণ্ডের পর দিল্লি। আবগারি দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আগামী ২৮ মার্চ পর্যন্ত তাঁকে ইডি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। স্বাভাবিক ভাবেই কেজরির গ্রেফতারি ঘিরে প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছে দিল্লির শাসনব্যবস্থা। ভোটের মুখে গ্রেফতার মুখ্যমন্ত্রী। ঝাড়খণ্ডের মতো পদত্যাগ করে উত্তরসুরী বেছে নেওয়ার পথে অবশ্য হাঁটেননি কেজরিওয়াল। বরং তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, জেলে বসেই রাজ্যের শাসনভার সামলাবেন তিনি। গ্রীষ্মকাল আসতে চলেছে। এই সময় জলসমস্য়া ও নিকাশিব্যবস্থা নিয়ে গুরুতর নির্দেশ জেল থেকেই পাঠিয়েছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। রাজ্যের মানুষের উদ্দেশে পাঠিয়েছেন বার্তাও। যা মুখ্যমন্ত্রীর মতো করেই পাঠ করে শুনিয়েছেন অরবিন্দ-পত্নী সুনীতা। যতক্ষণ না দোষীসাব্যস্ত হচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়ার প্রশ্ন নেই, সাফ জানিয়ে দিয়েছেন কেজরি। এমনকী আদালত কেজরিওয়ালকে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দিলে আদালতের অনুমতি নিয়ে জেলেই মুখ্যমন্ত্রীর দফতর তৈরি করার কথাও জানিয়েছেন আপ নেতা ও পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান।

বিভিন্ন অবিজেপি রাজ্যে বিরোধীস্বরকে রুখতে নয়া অস্ত্র যেন ইডি-সিবিআই। প্রথমে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। একই ভাবে তাঁকেও রাতারাতি গ্রেফতার করেছিল ইডি। নিজেকে বাঁচাতে না পারলেও রাজ্যের ক্ষমতা নিজের দলের হাতেই রাখতে পেরেছেন হেমন্ত। জেএমএম নেতা চম্পাই সোরেনকে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী ও দলের ভার সঁপেন হেমন্ত। আস্থাভোটে জিতে সেই ক্ষমতা নিজের হাতেই রেখেছিলেন চম্পাই। তবে দিল্লি থেকে টলানো যায়নি মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালকে। জেলে বসেই রীতিমতো দেশের একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছেন কেজরি। তিনি যে ভয় পাননি, সেই বার্তাও দিয়েছেন স্পষ্ট ভাবে। জেলে বসে রাজ্যবাসীর স্বার্থের কথা ভেবে জনমানসে একটা ছাপও ফেলেছেন বলাই বাহুল্য। কেজরির গ্রেফতারির পর প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, ভোটের আগে আর কারা কারা ঘায়েল হতে চলেছে বিজেপির এই নয়া অস্ত্রে?

আরও পড়ুন: সবার টাকা বিজেপির ঘরে! ইলেক্টোরাল বন্ডের যে তথ্যে তোলপাড়

ইতিমধ্যেই 'টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন' মামলায় সাংসদ পদ হারিয়েছেন তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র। এবার ওই মামলাতেই ফের নয়া বিপদের মুখে প্রাক্তন সাংসদ। মঙ্গলবার মহুয়ার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে সিবিআই। জানা গিয়েছে, সেই অভিযোগপত্রে নাম রয়েছে দুবাইয়ের ব্যবসায়ী দর্শন হিরানন্দানির নামও। গত শনিবার ওই মামলায় বাংলার বেশ কয়েকটি জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালায় সিবিআঅ। হিরানন্দানির থেকে টাকা নিয়ে সংসদে ব্যবসায়ী আদানিকে নিয়ে প্রশ্ন করার অভিযোগ ওঠে। আসন্ন লোকসভা ভোটে ফের কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকেই টিকিট পেয়েছেন মহুয়া। তার সামনে আরও একবার নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে সাংসদ পদ অর্জনের সুযোগ ছিল। তবে পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে ভোটের আগেই কেজরিওয়ালের মতো অবস্থা হতে চলেছে না তো মহুয়ারও? উঠে গিয়েছে প্রশ্ন। মহুয়ার বিরুদ্ধে কৃষ্ণনগরে দাঁড়িয়েছেন বিজেপির অমৃতা রায়। শোনা গিয়েছে, কৃষ্ণনগরের স্থানীয় রাজপরিবারের মেয়ে অমৃতা। তবে অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে, তাতে মহুয়ার বিরুদ্ধে না লড়েই কৃষ্ণনগর আসনে জয় পেয়ে যাবে না তো বিজেপি? অস্ত্র অবশ্য একই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার লাল চোখ।

Who are the next target Of central investigation agency after arresting Arvind Kejriwal

শুধু মহুয়াই নয়। ইডি-র পরবর্তী নিশানায় রয়েছে বামশাসিত রাজ্য কেরলও। ইতিমধ্যেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের মন্ত্রিসভাতেও। এ সি মঈদিন-সহ একাধিক সিপিএম নেতারা ইডি-র পরবর্তী নিশানায় বলে জানা গিয়েছে। কারুভান্নুর ব্যাঙ্ক দুর্নীতিতে ইতিমধ্যেই অভিযুক্ত এ সি মঈদিনের মতো বেশ কয়েক জন নেতা। পরিস্থিতি মালুম হতেই ত্রিশূরের সিপিএম জেলা কমিটির অফিসে ছুটে যান মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন।

একই সঙ্কট ঘনিয়েছে তামিলনাড়ুতেও। তামিলনাড়ুর মন্ত্রিসভার ছত্রিশজনের মধ্যে অন্তত দশ জন মন্ত্রীই কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির ব়্যাডারের নীচে রয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে ক্ষমতায় রয়েছে ডিএমকে। ইতিমধ্যেই তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিনের মন্ত্রিসভার একাধিক মন্ত্রী ইডি-সিবিআইয়ের জেরার মুখে পড়েছেন। প্রবীণ ডিএমকে নেতাদের মধ্যে রয়েছেন সেখানকার সেচমন্ত্রী দুরাই মুরুগান। কোটি কোটি টাকার বালিখাদান দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত তিনি। উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী কে পনমুন্ডির বিরুদ্ধেও রয়েছে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ। গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী আই পেরিয়াস্বামীও রয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থাদের নজরে। প্রাক্তন আবগারি মন্ত্রী কে সেন্থিল বালাজির বিরুদ্ধে চাকরি-দুর্নীতি ও বেআইনি আর্থিক লেনদেনেক মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। গত জুন মাসে তাঁর বাড়িতে তল্লাশিও চলে। স্ট্যালিনের মন্ত্রীসভায় এমন নেতানেত্রী বহু, যাদের মাথায় নামতে পারে ইডি-সিবিআই খাঁড়া।

Who are the next target Of central investigation agency after arresting Arvind Kejriwal

গত বছরের শুরুর দিকে আপ সাংসদ রাঘব চাড্ডা জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতারির পরিকল্পনা আঁটছে বিজেপি। সে সময় কেজরিকে পাঠানো একটি ইডি-র সমনের সমালোচনা করেই এই দাবি করেন আপ নেতা। সে সময়েই তিনি জানিয়েছিলেন, দিল্লিতে যে সাতটি লোকসভা আসন রয়েছে, তাতে যদি ইন্ডিয়া জোট লড়ে, তাহলে দিল্লিতে ওই সাতটি আসন হাতছাড়া হতে পারে বিজেপির। আর সেই ভয়েই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করাতে পারে বিজেপি, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। হয়েছে তেমনটাই। শুঘু কেজরিই নয়, বিজেপির পরবর্তী লক্ষ্য যে ঝাড়খণ্ডের হেমন্ত সোরেন হতে পারেন, সেই আশঙ্কাও জানিয়েছিলেন চড্ডা। সেই ভবিষ্যদ্বাণীও মিলে গিয়েছে অক্ষরে অক্ষরে।

আপ নেতা চড্ডার তালিকায় ছিল আরও কয়েকটি রাজ্যের নেতা-নেত্রীরাও। ছিলেন বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী তথা আরজেডি নেতা লালুপুত্র তেজস্বী যাদবও। উল্লেখযোগ্য ভাবে, এরা সকলেই বিজেপি বিরোধী জোট 'ইন্ডিয়া'-র সদস্য়ও বটে। এমনকী পশ্চিমবঙ্গের নামও ছিল চড্ডার তালিকায়। এমনিতেও বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ বিজেপির সামনে। সেখানে বহু চেষ্টা করেও দাঁত ফোটাতে পারেনি বিজেপি। নির্বাচনী পদ্ধতিতে তা কঠিন হলে সেখানে অন্যভাবে চাপ বাড়াতে পারে বিজেপি। আর সে কৌশল বোঝা কঠিন নয়। তৃণমূল সুপ্রিমো তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই রয়েছে একাধিক মামলা। আর সেই সব মামলা নিয়েই তৃণমূলের উপর চাপ বাড়াতে পারে বিজেপি বলে মনে করেছিলেন চড্ডা। তার সূচনাই কি হতে চলেছে মহুয়া মৈত্রকে দিয়ে? প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। শুধুই কি মহুয়া। ইতিমধ্যেই ইডি-সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়েছে বঙ্গ-তৃণমূলের বহু নেতা-নেত্রীই। জেলও খাটছেন অনেকে। কয়লা কেলেঙ্কারি থেকে শিক্ষাদুর্নীতি, গোরুপাচার, নিয়োগদুর্নীতি- একাধিক খাঁড়া ঝুলছে তৃণমূলের কাঁধে। শিক্ষা দুর্নীতি মামলায় মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহাকে ইতিমধ্যেই নোটিস পাঠিয়েছে ইডি। গত সপ্তাহেই তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। ৪১ লক্ষ টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলেও দাবি ইডির। আগামী ২৭ তারিখই তাকে ইডির দফতরে ডেকে পাঠানো হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: অরবিন্দ কেজরিওয়াল গ্রেফতার! বিজেপির দিল্লি দখলের মোক্ষম অস্ত্র এটিই?

কেজরির আগেই আপ নেতা মণীশ সিসৌদিয়া ও সঞ্জয় সিংকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। একাধিক বার জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিবালকে। শেষপর্যন্ত তরুণ আপ নেতা রাঘবের কথাই ফলে গিয়েছে অক্ষরে অক্ষরে। গত সপ্তাহেই গ্রেফতার হয়েছেন অরবিন্দ কেজরিবাল। বিকল্প রাজনীতি ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার উদ্দেশ্য নিয়েই সিংহাসনে চড়েছিলেন যিনি। দুর্নীতি তো বটেই, একই সঙ্গে এই গ্রেফতারির নেপথ্যে যে রয়েছে বিজেপির নির্বাচনী রণনীতি, তা অস্বীকার করছে না অনেকেই। তবে কি এই লোকসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বীশূন্য ময়দানেই গোল করতে চাইছে বিজেপি। গোড়া থেকেই ভোট নিয়ে আত্মবিশ্বাসী দেখিয়েছে বিজেপিকে। তবে কি এই আত্মবিশ্বাসের নেপথ্যে রয়েছে আসলে হাতের তুরুপের তাস ইডি-সিবিআই? একাধিক প্রশ্ন উঠে গিয়েছে কেজরির গ্রেফতারিকে কেন্দ্র করে।

More Articles