কে তুমি?
Who Are You: ক্ষমতার পা চাটা দালালরা সাংবাদিকতার মুখোশ পরে যাদের আকছার র্যাগিং করে, আমি তাদেরই কেউ।
কে তুমি?
-এক কথায় বলা মুশকিল। প্রথমত, আমায় আপনি তুমি বলে সম্বোধন করতেই পারেন না। আপনি বলতে হতো, এই যেমন আমি আপনাকে বলছি। আপনার প্রশ্নে বোঝা যাচ্ছে, বয়স গড়িয়েছে কিন্তু আপনি নিজের কাজের পর্যাপ্ত ট্রেনিং পাননি। সে যাই হোক, আপনি ধরে নিতে পারেন আমার নাম- শারজিল ইমাম। আমার বয়স ৩৫। শিক্ষাগত যোগ্যতা আপনার থেকে অনেকটাই বেশি। তিন বছর ধরে জেলে বসে পচছি। ইউএপিএ-র খাঁড়া ঝুলছে আমার মাথায়। একজন ধর্ষক বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারে রোজ। আমার জন্যে বরাদ্দ সপ্তাহে একদিন। আপনি আমাকে নিয়ে, আমার সঙ্গে হওয়া অন্যায় নিয়ে একটিও সান্ধ্য-খ্যামটা আয়োজন করেননি।
এই কে তুমি হ্যাঁ ?
-আমি একজন বৃদ্ধ। জেসুইট পাদ্রী। নাম স্ট্যান স্বামী। পার্কিনসনে আক্রান্ত। আমাকে জেলে ভরার আগে ন্যূনতম সাক্ষ্যপ্রমাণ যাচাই হয়নি। গোটা জীবন আমি জনজাতি যাতে অধিকার পায় তা সুনিশ্চিত করার জন্যে লড়াই করেছি। বিনা বিচারে আদিবাসীদের বন্দি করে রাখার বিরুদ্ধে সরব থেকেছি। বিভিন্ন জেলে আটক রাজবন্দিদের জন্য গঠিত ‘পারসিকিউটেড প্রিজ়নারস সলিডারিটি কমিটি’-র জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছি ঘুরে ঘুরে। আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা থেকে উচ্ছেদবিরোধী সংগঠন ‘বিস্থাপন বিরোধী জন বিকাশ আন্দোলন’-এর কাজ করেছি। রাষ্ট্র বলেছে আমি মাওবাদী। আমায় তুলে এনেছে। আমি জেলে এসেছিলাম সুস্থ শরীরে। আট মাস এই গুমঘরে থেকে আমি চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলি। আদালতে বলিও সে কথা। এনআইএ-এর পুলিশ সুপার বিক্রম খালাটে আমার অসুস্থতার প্রমাণে খুশি হননি। আমি হাতে বোতল ধরে জল খেতে পারতাম না। আমার দরকার ছিল একটা স্ট্র। পাইনি। মরে গেছি। আপনি আমার হয়ে একদিনও কোনো অনুষ্ঠান করেননি।
কে তুমি? কে তুমি?
- চিৎকার থামান। বাবারে! এর নাম সাংবাদিকতা? সরকারের বিজ্ঞাপন ভিক্ষার্থীর সন্ধেবেলায় হাইহাই চিৎকার শুনে কানে তালা লেগে গেল! আমার নাম জেনে আপনি কী করবেন? আমার কথা তলিয়ে ভাববেন? আমার হয়ে লিখবেন? অন্তত একটা নিরপেক্ষ প্যাকেজ তৈরি করবেন? জনমত তৈরি করবেন? ধরে নিন, আমার নাম উমর খলিদ। সেই কবে থেকে জেলে বসে পচছি। আমায় বলা হচ্ছে দাঙ্গা ষড়যন্ত্রী। এতবড় ঘটনা ঘটিয়েছি, আামার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করে আমায় শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না কেন! আর কতদিন ট্রায়াল চলবে! আর কতদিন আমার সম্ভাবনাগুলিকে হত্যা করা হবে জেলে পচিয়ে? যত বড় অভিযোগ তা তো রাতারাতি প্রমাণ হয়ে যাওয়ার কথা। কেন বারংবার আমার জামিনের শুনানি রদ হয়ে যায়? সংখ্যাগরিষ্ঠ খাবে, তাই, আমি ধর্মে মুসলমান তাই, আমার বিচারের আগেই জনসমাজকে আমার বিরুদ্ধে লাগাতার উস্কেছেন আপনি। আপনারা। আমার বিরুদ্ধে চলা একটি মামলায় আমি নির্দোষ, প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। যদি পরের মামলাতেও নির্দোষ প্রমাণিত হই? আমার এই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি কি ফেরত পাব আর? আমার ব্যাপারে জনমত বদলাবে?
এই কে তুমি! তুমি কে তুমি কে! কে তুমি! কে-এ-এ-এ তুমি!
-আমি নাজীব আহমেদ। জেএনইউ-তে পড়তে এসেছিলাম ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর আমি জেএনইউ-এর ছাত্রাবাস থেকে নিখোঁজ হই। মাইন্ড ইট, ছাত্রাবাস থেকে। আমি কোথায়, এই প্রশ্নে গলা ফাটিয়ে অনেকে পুলিশের হাতে মার খেয়েছে। নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন আমায় অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের ছাত্ররা মারধর করে। আমার মা বসন্তকুঞ্জ নর্থ থানায় এফআইআর করতে গেলে, পুলিশ বলে ছাত্রাবাসে গোলমালের কথা এফআইআর-এ লেখার দরকার নেই। আমার হারিয়ে যাওয়ার একশো দিন পর পুলিশ আমারই বাড়িতে তল্লাশি করতে গিয়েছিল। আমার মা ফতিমা নাফিস আজও জানেন না আমি কোথায়। আমিও জানি না আমি কোথায়। প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান ছিল। তবু কেউ এখনও শাস্তি পায়নি। আপনি তো আমার জন্যে এক ঘণ্টা ব্যয় করেননি কখনও! আমি কোথায়, এই শিরোনাম একটাও অনুষ্ঠান করেননি! আপনি সাংবাদিক? সারাদিন মুখোশ পরে থাকতে আপনার লজ্জা করে না? আমাকেই জিজ্ঞেস করছেন, আমি কে!
আরে! তুমি কে? কে তুমি?
-আমি? একজন কবি। আমার নাম ভারভারা রাও। চার বছর জেলে ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এই চার বছরে। আমার হয়ে আপনি কখনও সওয়াল করেননি। আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের পেচ্ছাপখানায় পড়ে ছিলাম। আপনি আমার জন্যে গলা ফাটাননি। আমেরিকার সংবাদপত্র ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর রিপোর্টে দেখা গেল আমাদের বিরুদ্ধে ওই মামলায় ‘মূল প্রমাণ’ হিসাবে যা তুলে ধরা হচ্ছে তা বাইরে থেকে ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে ল্যাপটপে ঢুকিয়ে দিয়েছিল হ্যাকার। একটি নয়, দশটি চিঠি ভরে দেওয়া হয়েছিল ল্যাপটপে। সহানুভূতি চাই না। কিন্তু একটি তথ্যনিষ্ঠ শো আয়োজন করে কিছুক্ষণ গলাবাজি করতে পারতেন তো আপনি! আমার সন্তানের বয়সি আপনি, বাবা নোংরা পেচ্ছাপখানায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে জানলে মেয়ের কেমন লাগে কখনও ভেবেছেন?
তুমি কে? কে তুমি?
-আমি একজন বৃদ্ধ সাংবাদিক। সেই জরুরি অবস্থার সময় থেকে কাজ করছি। দেশের এক বাণিজ্যগোষ্ঠীকে নিয়ে লেখার জন্যে আমার বিরুদ্ধে ৬ টা মামলা করা হয়েছে, চাকরি গিয়েছে। আমি তবু সত্য থেকে সরিনি। প্রশ্ন করা বন্ধ করিনি। তোমাদের দেখে হাসি পায়, জানাতে এলাম।
কে তুমি? তুমি কে?
-আমি নোবেল পুরস্কারের জন্যে মনোনীত হওয়া একজন সাংবাদিক। ফ্যাক্টচেকারও বলতে পারেন। আপনাদের মতো সংস্থা থেকেই নিয়মিত ভুল খবর, মলমূত্র ছড়ানো হয় গণপরিসরে। আমি সেই ময়লা সাফাই করি। মিথ্যে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার ২০১৮ সালের একটি টুইটে ‘ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লেগেছে’, বলা হলো ২০২২ সালে। আমার সমস্ত কাজের দাম আমি পেলাম। আমাকে জেলে পাঠানো হল, আপনারা কিছু বলেননি। মনে মনে বলেছেন, বেশ হয়েছে। কারণ তথ্যের প্রতি দায় নেই আপনাদের। বেচারা তল্পিবাহক।
কে তুমি! কে তুমি!
-আমি তেমন কেউ না। এই উপরে যাদের র্যাগিং চলছে, তাদের তুলনায় সামান্য লোক। আমি দেশভাগের পর এদেশে এসেছি। সামান্য স্কুলশিক্ষক। কোচবিহারে থাকতাম। ছেলের চাকরির জন্যে এখন জলপাইগুড়িতে থাকি। বয়স হয়েছে, সব কাগজ গুছিয়ে রেখেছি কিনা জানি না। টিভিতে এনআরসি নিয়ে চিৎকার দেখে আমার ভয় করল। আমি কাগজ খুঁজতে বসলাম। কাগজ পেলাম না। শরীর খারাপ হয়ে গেল। শরীরের সব জোর চলে গেল। কত কম বয়সে এই দেশে এসেছিলাম, এই বয়সে দেশছাড়া হতে হলে কী হবে! এই ভয়ে আমি আর আগের আমি নেই। আমার কথা আপনি কখনও ভাবেননি।
কে তুমি! কে তুমি?
-করোনায় মরা দলিত। আমার দেহ কুকুর ছিঁড়ে খেয়েছে। আপনি জেনেছেন নিশ্চয়ই। খবর করেননি। ভালোই হয়েছে, কুকুরটারও খিদে ছিল পেটে।
কে তুমি! তুমি কে!
-আমি সেই পরিযায়ী শ্রমিক যে মরে গেল বেঘোরে। রাতের অন্ধকারে ট্রেনে কাটা পড়ে। আর রেলট্র্যাকে পড়ে রইল পরদিনের জন্যে বাঁচিয়ে রাখা রুটি।
কে তুমি! কে তুমি!
-নাম বললে চিনবেন? লঙ্কাখেতে কাজ করতে যাওয়া শিশুশ্রমিক। জামলো মকদম। তিনদিন হেঁটেছি বাড়ি ফেরার জন্য। বাড়ির সামনে এসে প্রাণটা চলে গেল। আমার কথা আপনি বলবেন কখনও? আমার নাম আপনার মনে থাকবে? আপনি সাংবাদিক?
কে তুমি হে?
আমি মণিপুরের কুকি মেয়ে। যাকে পুলিশ ধর্ষণ করেছে, মেইতেইরা ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণ সেরে চাররাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে খুলিতে গুলি করেছে। অথবা আমি কাশ্মীরের সেই মেয়ে যাকে ভোরে ধর্ষণ করে জলপাই পোষাক। রাতে ধর্ষণ করে 'জেহাদি'। আপনার পক্ষে আমায় চেনা মুশকিল।
কে তুমি?
-তমন্না, ফিরদৌসি, শবনম- যে নামে ডাকুন, আমি শাহিনবাগে বসেছিলাম ১০০ দিনের বেশি। রোদে, বর্ষায়, শীতে। অধিকারের জন্যে। আপনি আমাদের দিকে সহানুভূতি নিয়ে তাকাননি। আমরা মনে রাখব।
আরও পড়ুন: কাঁদালে তুমি মোরে…
এই কে তুমি, এতক্ষণ জ্ঞান দিচ্ছ?
-ক্ষমতার পা চাটা দালালরা সাংবাদিকতার মুখোশ পরে যাদের আকছার র্যাগিং করে, আমি তাদেরই কেউ ধরে নিন। আপনি কে, ভাববেন মহোদয়া।