ভারতরত্ন দেওয়াতেই লুকিয়ে আসল খেল? কীভাবে কর্পুরী ঠাকুরের পথে হাঁটলেন নীতীশ কুমার?
Karpoori Thakur and Nitish Kumar : কর্পুরী ঠাকুর অনগ্রসর জাতিগুলিকে দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন, "অপেক্ষাকৃত বেশি পিছিয়ে পড়া" এবং "অপেক্ষাকৃত কম পিছিয়ে পড়া"।
বিহারের রাজনীতিকে বুঝতে হলে কর্পুরী ঠাকুরকে বুঝতে হবে। এমনটাই বলেন একাংশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিহারের পিছিয়ে পড়া জনজাতির রাজনীতির জন নায়ক কর্পুরী ঠাকুর। সম্প্রতি বিজেপি সরকার জানিয়েছে, দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ভারতরত্ন দিয়ে ভূষিত করা হবে তাঁকে। বিষয়টি শুধু পুরস্কারের নয়। বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের এই মুহূর্তের রাজনৈতিক ডামাডোলও। এই কর্পুরী ঠাকুরের পদচিহ্ন ধরেই কিন্তু রাজনীতির 'পল্টুরাম' হয়েছেন নীতীশ কুমার। কে এই কর্পুরী ঠাকুর?
এই ভারতরত্ন সম্মান প্রদানের ঘোষণাটির প্রশংসা করেছে নীতীশ কুমারের জেডি(ইউ) এবং আরজেডি এবং বিজেপির অন্যান্য বিরোধীরাও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, কর্পুরী ঠাকুরকে ভারতরত্ন প্রদানের সরকারের সিদ্ধান্ত এই সমাজতান্ত্রিক নেতার প্রান্তিক মানুষদের জন্য লড়াই এবং সমতার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টাকেই সম্মান দেওয়া।
কর্পুরী ঠাকুর কে?
কর্পুরী ঠাকুরকে বিহারের জনতা চেনে 'জন নায়ক' নামেই। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের জুন মাস এবং ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
কর্পুরী ঠাকুরের জন্ম ১৯২৪ সালে। সমস্তিপুর জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা অংশগুলির মধ্যেই একটি, নাই জাতে (নাপিত সম্প্রদায়) জন্ম কর্পুরী ঠাকুরের। নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে, একজন নেতা হিসেবে কর্পুরী ঠাকুর সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের উন্নতি করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় একজন তরুণ ছাত্র হিসাবে রাজনৈতিক কাজকর্ম শুরু করেছিলেন কর্পুরী ঠাকুর। ফলস্বরূপ কয়েক মাস তাঁকে জেলেও থাকতে হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে একটি গ্রামের স্কুলে শিক্ষকের চাকরিই করতেন কর্পুরী। কিন্তু রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ ছিল বরাবরের। ১৯৫২ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে তাজপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী হিসাবে জয়ী হয়েছিলেন কর্পুরী। সেই সময় রাজনীতিতে কিন্তু কংগ্রেসেরই আধিপত্য ছিল।
আরও পড়ুন- বিজেপির সঙ্গে কতদিন থাকবেন নীতীশ? ভবিষ্যদ্বাণী প্রশান্ত কিশোরের…
কর্পুরী ঠাকুর ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণের ঘনিষ্ঠ। যদিও পরে তিনি রাম মনোহর লোহিয়ারও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তাঁর নেতৃত্বের জোরেই তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও উচ্চবর্ণের মানুষরা তাঁকে সম্মান করতেন।
রাজনীতিতে কর্পুরী ঠাকুরের উত্থান
কর্পুরী ঠাকুর আরও বেশি করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন ১৯৬৭ সালে। রাজ্যে সেই প্রথম মহামায়া প্রসাদ সিনহার নেতৃত্বে প্রথম অ-কংগ্রেসি সরকার গঠন হয়েছিল। কর্পুরী ঠাকুর বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। শিক্ষামন্ত্রীও ছিলেন তিনিই। স্কুলগুলিতে ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসাবে সরিয়ে দিয়েছিলেন কর্পুরী।
কর্পুরী ঠাকুর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দু'টি স্বল্পকালীন মেয়াদে দায়িত্ব সামলেছিলেন। ক্ষমতায় খুব বেশি দিন স্থায়ী হননি কর্পুরী কিন্তু, সেই সময়কালে ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনে একজন পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষের উত্থান ছিল রূপকথার মতো! দরিদ্র পরিবার থেকে আসা, অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া, নিচু জাতের নাপিত সম্প্রদায়ের একজন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন, ভাবাই যেত না তখন, বলেছেন প্রবীণ আরজেডি নেতা শিবানন্দ তিওয়ারি। শিবানন্দর প্রয়াত বাবা রামানন্দ তিওয়ারি ছিলেন কর্পুরী ঠাকুরের অন্যতম সঙ্গী।
১৯৫২ সালে প্রথমবার জয়ী হওয়ার পর, সাধারণ মানুষের কাছে কর্পুরী ঠাকুর তার সরল জীবনযাপনের জন্য, সাধারণ মানুষের হয়ে সামাজিক ন্যায়বিচারের লড়াইয়ের জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ক্রমশই। সেই কারণে কখনই কোনও নির্বাচনে হারেননি তিনি।
কেন কর্পুরী ঠাকুর বিহারের রাজনীতিতে এত গুরুত্বপূর্ণ?
কর্পুরী ঠাকুরই ছিলেন বিহারের প্রথম নেতা যিনি অনগ্রসর শ্রেণির ক্ষমতায়নের জন্য লড়াই বলেছিলেন। তাঁর এই লড়াইয়ের ফলেই শেষ পর্যন্ত মণ্ডল কমিশনের সুপারিশগুলি বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যায়।
১৯৭০-এর দশকে নাই সম্প্রদায় বা নাপিত সম্প্রদায় ছিল মূল জনসংখ্যার মাত্র ১.৬ শতাংশ। রাজ্য রাজনীতিতে এই পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য রাজনৈতিক স্থান নগণ্য। তখন কর্পুরী ঠাকুরই প্রথম পিছিয়ে পড়া জাতিদের সংগঠিত করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে বিহারে সরকারি পরিষেবায় এই পিছয়ে পড়া শ্রেণির মানুষদের জন্য ২৬ শতাংশ সংরক্ষণের পথ প্রশস্ত করেছিলেন কর্পুরী।
পরবর্তীতে, ভিপি সিং-এর নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৯০ সালে সর্বভারতীয় স্তরে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (OBC) সংরক্ষণের জন্য মণ্ডল কমিশনের সুপারিশগুলি বাস্তবায়ন করে। ওবিসিদের এভাবেই শক্তিশালী ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে গরে তোলা হয়। জনতা দল (ইউনাইটেড) বা জেডিইউ এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দল সকলেই বিহারের মণ্ডল রাজনীতিকে ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে।
আরও পড়ুন- আবার প্রতারণা নীতীশের! যেভাবে এগোয় পল্টুরামের পাল্টির কিসসা
কীভাবে কর্পুরী ঠাকুরের পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন নীতীশ?
আরজেডি সুপ্রিমো লালু প্রসাদ যাদব এবং মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার দু'জনই ১৯৯০-এর দশক থেকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির হাত থেকে যাতে লাগাম ঢিলে না হয়ে যায় তা নিশ্চিত করার জন্য কর্পুরীর পদাঙ্কই অনুসরণ করেছেন। বিহারের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বিহারে চাকরির সংরক্ষণের প্রেক্ষাপটে কর্পুরীর সূত্রের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেছেন।
কর্পুরী ঠাকুর অনগ্রসর জাতিগুলিকে দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন, "অপেক্ষাকৃত বেশি পিছিয়ে পড়া" এবং "অপেক্ষাকৃত কম পিছিয়ে পড়া"। নীতীশ কুমার কর্পুরী ঠাকুরের সূত্র ব্যবহার করেই অনগ্রসর শ্রেণিকে দু'টি ভাগে ভাগ করেছেন – অত্যন্ত অনগ্রসর শ্রেণি (EBC) এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (OBC)।
লালু প্রসাদ যাদবের ভোট ব্যাঙ্কের মোকাবিলা করার জন্য বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ ইবিসি এবং ওবিসিদের জন্য যথাক্রমে ১৮% এবং ১২% সরকারি চাকরি সংরক্ষিত করেছিলেন। বিহারের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কর্পুরী ঠাকুরকে যেই ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ভারতরত্ন প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় জনতা পার্টি, তারপরেই নীতীশ নিজের আনুগত্য পরিবর্তনের দিকে ঝোঁকেন। বিরোধী এনডিএ জোটেই বদলে নেন নিজের পক্ষ।