অপহরণ থেকে শুরু করে সিপিএম নেতা খুন! পুলিশের খাতায় ‘অপরাধে’র লম্বা তালিকা চোপড়ার জেসিবি-র
Chopra Assault Case: এরপরেই একে একে সামনে আসতে থাকে তাজিমুল তথা জেসিবির অপরাধগাথা। অতীতেও নাকি একাধিক বার ভয়ঙ্কর সব অপরাধ করেছে সে।
সালিশি সভায় তালিবানি কায়দায় যুগলকে মাটিতে ফেলে মার। খোদ পশ্চিমবঙ্গের এই ঘটনায় হঠাৎই শিরোনামে এসে গিয়েছিল উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া। ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিও দেখে শিউরে উঠেছিলেন অনেকেই। সেই ঘটনার নেপথ্যে কঞ্চি হাতে যে ব্যক্তিকে দেখা গিয়েছিল, তিনি তৃণমূল ঘনিষ্ঠ নেতা তাজমুল ওরফে জেসিবি। কেউ কেউ বলছেন, এই জেসিবি নাকি উত্তরের শাহজাহান। রবিবারের মারধরের ঘটনার পরে ইতিমধ্যেই তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। দেওয়া হয় দিন পাঁচেকের হেফাজতও।
জেসিবি গ্রেফতার হতে হতেই একে একে সামনে আসতে শুরু করেছে এই কুখ্যাত দুষ্কৃতির একের পর এক অপরাধের লম্বা তালিকা। লোকসভা ভোটের আগে সন্দেশখালির ত্রাস শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে সেখানকার মানুষ। নারীদের অত্যাচার, নিগ্রহ থেকে শুরু করে স্থানীয়দের জমি জবরদখল। একাধিক অভিযোগ ছিল শাহজাহানের বিরুদ্ধে। কম যায় না এই জেসিবিও। রবিবার সালিশি সভায় এক তরুণ-তরুণীকে নিগ্রহ করতে দেখা গিয়েছিল জেসিবি-কে। ভাইরাল হয় সেই ভিডিও। ভিডিয়োয় দেখা যায়, কঞ্চির ছড়া দিয়ে এক তরুণীকে এলোপাথাড়ি মারছেন তাজিমুল। ওই ভিডিয়ো পোস্ট করে তৃণমূলকে নিশানা করতে শুরু করে বিরোধীরা। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতর শুরু হয়। এর পরেই তাজিমুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সোমবার তাঁকে ইসলামপুর আদালতে হাজির করানো হয়।
আরও পড়ুন: বিহার, উত্তরপ্রদেশ নয়! খোদ বাংলায় প্রকাশ্যে বীভৎস মার যুবক-যুবতীকে! নেপথ্যে তৃণমূল?
এরপরেই একে একে সামনে আসতে থাকে তাজিমুল তথা জেসিবির অপরাধগাথা। অতীতেও নাকি একাধিক বার ভয়ঙ্কর সব অপরাধ করেছে সে। চোপড়ার যে জায়গায় নিগ্রহের ঘটনাটি ঘটে, সেই লক্ষ্মীপুরে নাকি দীর্ঘ দিন ধরেই দাপট কুখ্যাত জেসিবির। ২০১৭ সাল থেকে শুরু তাঁর উত্থান। সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার, মারধর থেকে শুরু করে খুন ও অপহরণের একাধিক অভিযোগ রয়েছে জেসিবির বিরুদ্ধে। সেটা ২০১৮ সালের কথা। ওই বছর ৪ নভেম্বর তারিখে রুস্তম আলি নামে চোপড়ার এক বাসিন্দা থানায় অভিযোগ দায়ের করেন জেসিবির বিরুদ্ধে। গোলাম মুস্তাফা ও আবুল নামে ওই দুই বালসিন্দার উপরে নাকি অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চড়াও হয় জেসিবি। সেই ঘটনার লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন রুস্তম। সেই এফআইআরে মোট ৩৭ জনের নাম ছিল। আর তার পয়লা নম্বরেই ছিল জেসিবির নাম।
২০১৯ সালে ১১ মার্চ চোপড়া থানায় দায়ের হয় আরও একটি অভিযোগ। আজিনা খাতুন নামে এক মহিলা থানায় জানান, ডাঙাপাড়া থেকে লক্ষ্মীপুর বাজারে যাওয়ার সময় তাঁর উপর আক্রমণ চালিয়েছে তাজিমুল ও তার দলবল। ৩১ জনের নামে এফআইআর দায়ের হয়। আর তার পয়লা নম্বরেই থাকে জেসিবির নাম। এত সব বাড়বাড়ন্ত কি শাসক দলের নেতার ঘনিষ্ঠ হওয়ার দৌলতেই? ইসলামপুর পুলিশ জেলার সুপার জোবি থমাস অবশ্য জানিয়েছেন, ‘‘উনি তৃণমূলের নেতা কি না তা বলতে পারব না। তবে ক্রিমিনাল। আমরা নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ওঁকে গ্রেফতার করেছি। ওঁর নামে আগেও নানাবিধ গুরুতর অভিযোগ হয়েছে।’’
এখানেই শেষ নয়। ২০২১ সালে জেসিবির বিরুদ্ধে দায়ের হয় অপহরণ করে খুনের অভিযোগ। ওই বছরেরই ২ সেপ্টেম্বর তারিখে সাবুজান নেসা নামে এক মহিলা তাজিমুল ও তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন চোপড়া থানায়। তাঁর অভিযোগ ছিল, ১ সেপ্টেম্বর তাঁর ছেলে ওসমান গনি ইসলামপুর কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। সেই সময় তাঁকে অপহরণ করা হয় বলে অভিযোগ। না, শুধু অপহরণ নয়। দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয় তাঁকে। করা হয় গুলিও। পরে তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চোপড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে ভর্তি করা হয় শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। মৃত্যু হয়েছিল ওসমান গনির। এর পর ২০২৩ সালে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়নের শেষ দিনে বাম-কংগ্রেস জোটের মিছিলে গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছিল জেসিবির বিরুদ্ধে। সেই ঘটনায় এক সিপিএম নেতার মৃত্যুও হয়েছিল। পুলিশে যে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল, তাতে জেসিবির নাম শুরুতেই ছিল বলে জানা গিয়েছে পুলিশ সূত্রে। গ্রেফতারও হয়েছিলেন তৃণমূল নেতা। কিন্তু অভিযোগ, কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁকে ছেড়়ে দেওয়া হয়।
এখনও পর্যন্ত বহুবার পুলিশের খাতায় নাম উঠেছে জেসিবির। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, কখনওই তার বিরুদ্ধে কোনও কঠোর পদক্ষেপ করা হয়নি প্রশাসনের তরফে। আর সেই বিষয়টি নিয়েই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিরোধীরা। পুলিশ অবশ্য একাধিক বার ধরে নিয়ে গিয়েছে জেসিবি-কে। কিন্তু সামান্য কয়েক দিন। তার পরেই দাগী এই দুষ্কৃতীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে প্রতিবার। শোনা যায়, স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল রহমানের নাকি বেশ ঘনিষ্ঠ এই তাজমুল ওরফে জেসিবি। প্রশ্ন ওঠে, সেই যোগাযোগ ব্যবহার করেই কি প্রতিবার আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেত সে? স্থানীয় এক সিপিএম নেতার কথায়, ‘‘বিধায়কের সঙ্গে থাকত জেসিবি। পুলিশ কিছু করতেই ভয় পেত।’’ চোপড়ার কংগ্রেস সভাপতি মাসিরুদ্দিন দাবি করেছেন, ‘‘সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করে রেখেছে জেসিবি। লক্ষ্মীপুর এলাকায় কেউ মাথা তুলে কথা বলতে পারছে না। ও গ্রেফতার হওয়ার পর মানুষ আস্তে আস্তে মুখ খুলছে। এর আগেও ওর অত্যাচারের ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে।’’
রবিবারের এই ভয়াবহ মারধরের ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পর কী বলছেন তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল? জানা গিয়েছে, গোটা ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন তিনি। জানিয়েছেন, ‘‘যা হয়েছে তা একদমই ঠিক হয়নি। আমি মেনে নিচ্ছি। ওই জায়গায় জাতপাত সংক্রান্ত সমস্যা হলে সালিশি সভা হয়। একে আমি বা আমার দল একদমই সমর্থন করি না। সন্দেশখালির ত্রাস শেখ শাহাজাহান কাঠগড়ায় ওটার পরেও সমস্ত দায় ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিল শাসক দল তৃণমূল। এবারও সেই ছবিটাই দেখা গেল কার্যত। তৃণমূল মুখপাত্র শান্তনু সেনও বলেছেন, ‘‘চোপড়ায় যে ঘটনা ঘটেছে তা তৃণমূল বা আমাদের সরকার কোনও ভাবে সমর্থন করে না। এটা আমরা বার বার বলেছি। পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করেছে। মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নির্যাতিতদের পুলিশি সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। আরও যদি কেউ এই ঘটনায় জড়িত থাকেন, তাঁরাও পার পাবেন না। তবে তফাত অন্য জায়গায়। ৩৪ বছরের বাম শাসনে বাংলায় এ রকম অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কোনও বাম নেতাকে প্রকাশ্যে এসে নিন্দা করতে শুনিনি বা পুলিশ গ্রেফতার করেছে দেখিনি। দেশে বিজেপি শাসিত বহু রাজ্যেও এই ধরনের ঘটনা হামেশাই ঘটে। কিন্তু তা নিয়ে পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করছে বা বিজেপি নেতা বিরোধিতা করছেন, তেমনটা ওই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে দেখা যায় না। এটা একমাত্র বাংলাতেই সম্ভব। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এই ধরনের ঘটনায় ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি রেখেছেন। শুধু মুখে বলা হয় না, কাজেও করে দেখানো হয়।’’
আরও পড়ুন: তৃণমূল সমর্থককে মাটিতে ফেলে বেধড়ক মার! ভোট মিটলেও শান্তি ফিরল না সন্দেশখালিতে
তবে এখনও কিন্তু শেষ হয়নি জেসিবির অপরাধের খতিয়ান। অস্ত্র আইনেও মামলা রয়েছে জেসিবির বিরুদ্ধে। স্থানীয়দের দাবি, এলাকায় তোলাবাজি করত জেসিবি। নতুন বাড়ি নির্মাণ থেকে হাটে ধান, ভুট্টা বিক্রির পর ব্যবসায়ীদের ‘তোলা’ দিতে হয় তাকে। এমনকি চা বাগান দখলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সে কারণে রবিবার জেসিবি সালিশি সভায় তালিবানি কায়দায় নির্মম অত্যাচার করলেও প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেননি কেউই। ইতিমধ্যেই এই ঘটনায় চোপড়া থানার আইসিকে শোকজ করেছে রাজ্য পুলিশ। তবে প্রশ্ন, এত কিছুর পরেও কি সাজা পাবে তৃণমূলনেতা ঘনিষ্ঠ তাজামুল ওরফে জেসিবি। নাকি এবারও প্রতিবারের মতোই রাজনৈতিক সংযোগ ব্যবহার করে ঠিক আইনের চোখ এড়িয়ে বেরিয়ে আসবে এই দাগী, সেটাই প্রশ্ন।