লেবাননে ড্রোন হামলার নিহত হামাসের ডেপুটি নেতা! জানেন কে এই সালেহ আল-আরৌরি?
Israel-Gaza war: দীর্ঘদিন ধরেই ইজরায়েলের নিশানায় ছিলেন হামাসের ডেপুটি চেয়ারম্যান সালেহ আল-আরৌরি। ইরান ও লেবাননের হেজবোল্লাহ গোষ্ঠীর সঙ্গে হামাসের প্রধান সংযোগের মাধ্যমও ছিলেন সালেহই।
প্রায় নব্বই দিন ছুঁই ছুঁই ইজরায়েল হামাস যুদ্ধ। ইজরায়েলি বোমায় ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে গাজার প্রায় ৭০ শতাংশ জনবসতি। অন্তত ২২ হাজার সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে এরই মধ্যে। জখম অজস্র। তার পরেও যুদ্ধের তীব্রতা থামায়নি নেতানিয়াহু সরকার। বরং প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী হামাসকে শেষ করতে কোনও ফাঁক রাখতে রাজি নয় ইজরায়েল। গাজা থেকে শুরু করে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক-সহ প্যালেস্টাইনের একাধিক জায়গায় ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েলি সেনা। এরই মধ্যে আবার বেইরুটের দহিয়ে শহরের ড্রোন হামলায় সালেহ আল-আরৌরি নামে হামাসের এক ডেপুটি নেতার মৃত্যু হয়েছে বলে খবর। যদিও সরাসরি সেই হামলার দায় নিচ্ছে না ইজরায়েল।
গত ৭ সেপ্টেম্বর ইজরায়েলে আচমকাই ঢুকে পড়েছিল হামাস। ইহুদিদের পবিত্র দিকে অতর্কিতে চালানো হয়েছিল হামলা। সেই হামলায় অন্তত ১৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। অসংখ্য নিরপরাধ ইজরায়েলিকে অপহরণ করে গাজায় নিয়ে এসেছিল হামাস জঙ্গিরা। এর পরেই হামাসের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছিল ইজরায়েলের বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকার। সেই থেকে গাজায় একের পর এক রকেট হেনে গিয়েছে ইজরায়েল। হাসপাতাল, ধর্মস্থান, শরণার্থী শিবির, স্কুল কোনও কিছুই বাদ যায়নি ইজরায়েলি সেনার নিশানা থেকে। যে কোনও ভাবে হামাসের অস্তিত্ব বিনাশ করতেই হবে। এমন একটা জায়গা লাগাতার নতুন নতুন কৌশল, নতুন নতুন যুদ্ধের ফাঁদ খুঁজে গিয়েছে ইজরায়েল। কখনও সুড়ঙ্গে ঢালা হয়েছে সমুদ্রের লবনাক্ত জল, যাতে সলিল সমাধি ঘটে সুড়ঙ্গে আশ্রয় নেওয়া হামাস জঙ্গিদের।
আরও পড়ুন: বন্দি ইহুদিদের ছাড়তে নতুন শর্ত হামাসের, ইজরায়েলের গাজা-দখলের দাবি আদতে কতখানি সত্যি?
দীর্ঘদিন ধরেই ইজরায়েলের নিশানায় ছিলেন হামাসের ডেপুটি চেয়ারম্যান সালেহ আল-আরৌরি। হামাসের সিনিয়র লিডারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। ইরান ও লেবাননের হেজবোল্লাহ গোষ্ঠীর সঙ্গে হামাসের প্রধান সংযোগের মাধ্যমও ছিলেন সালেহই। ইজরায়েল অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেও বেশ প্রভাবশালী ছিলেন তিনি। হবে না-ই বা কেন! সেখানেই তো জন্ম সালেহ-র। ফলে অনেকদিন ধরেই ইজরায়েল সালেহ-কে খতম করার জন্য তক্কে তক্কে ছিল। অবশেষে বেইরুটেই সম্পন্ন হল সেই কাজ। সেখানে হামাসের অফিস কেন্দ্র করে ড্রোন হামলা চালানো হয়। সেই হামলায় সালেহ-সহ মোট ৬ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। তেমনটাই জানানো হয়েছে লেবাননের স্টেট নিউজ এজেন্সির তরফে।
হামাসের তরফেও জানানো হয়েছে, ইজরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় মারা গিয়েছে তাদের সিনিয়র নেতা সালেহ আল-আরৌরি। ইজরায়েলের এই পদক্ষেপকে 'কাপুরুষতম হত্যা' বলে আখ্যা দিয়েছে হামাস। তারা জানিয়েছে, এভাবে ভিতর বা বাইরে থেকে ফিলিস্তিনি জনগণের ইচ্ছা ও দৃঢ়তাকে ভেঙে ফেলা যাবে না। এমনকী এই প্রতিরোধ গড়ে তোলার যে ধারাবাহিক চেষ্টা, তাকেও নষ্ট করা যাবে না। এ ধরনের লুকিয়ে হামলা ইজরায়েলের ব্যর্থতাকেই বড় করে তোলে বলে জানানো হয়েছে হামাসের তরফে।
হামাসের পলিটিক্যাল ব্যুরোর ডেপুটি চিফ ছিলেন ৫৭ বছরের সালেহ আল-আরৌরি। পাশাপাশি হামাসের সশস্ত্র শাখা কাসেম ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন সালেহ। জীবনের আঠেরোটা বছর ইজরায়েলের জেলে কাটানোর পর লেবাননে চলে যান তিনি। সেখানে থেকেই দলকে নেতৃত্ব দিতেন সালেহ। জানা গিয়েছে, ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামলার আগেই বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু-র তকফে হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ২০১৫ সালেই আমেরিকা সালেহকে গ্লোবাল টেররিস্ট আখ্যা দেয়। এমনকী তাঁর খবর দিতে পারলে ৫ মিলিয়ন ডলার উপহারও পর্যন্ত ঘোষণা করা হয় আমেরিকার তরফে।
হেব্রন ইউনিভার্সিটির ছাত্র নেতা হিসেবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন সালেহ। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি ইসলামপন্থি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেখান থেকে হামাসে যোগদান। ইজরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রথম থেকে প্রতিরোধ গড়ার পক্ষপাতি ছিলেন তিনি। করেওছেন তেমনই। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে মিলিটারি অপারেশনে অর্থ জোগানোর জন্য আমেরিকা ও ইজরায়েল- দু'দেশেরই চক্ষুশূল হন সালেহ। ২০১৪ সালে ওয়েল্ট ব্যাঙ্কে তিন ইজরায়েলি কিশোর-কিশোরীকে অপহরণ করে খুনের ঘটনার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন তিনি, এমন অভিযোগও রয়েছে। ১৯৯২ সাল ইজরায়েলের হাতে গ্রেফতার হন সালেহ। তার পর প্রায় আঠেরো বছর সেখানেই কেটেছে তাঁর। ২০১০ সালে এক অপহৃত ইজরায়েলি সৈন্যের বিনিময়ে এক হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তি নিয়ে ইজরায়েলের সঙ্গে আলোচনায় সাহায্য করেন সালেহ।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রথমে সিরিয়ায়, পরে কাতারে এবং শেষপর্যন্ত লেবাননে আশ্রয় নেন। তবে হামাসের তরফে ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কাজ করতেন তিনি। তাঁর হাত ধরেই ক্রমশ বিস্তার লাভ করেছিল হামাস। ততদিনে হামাসের পলিটব্যুরোর সদস্য হয়েছেন সালেহ। ২০১৭ সালে সংগঠনের নেতা ইসমাইল হানিয়াহের ডেপুটি নির্বাচিত ছিলেন। ক্রমশ হাইপ্রোফাইল নেতা হিসেবে পরিচিতি ছড়াতে থাকে তাঁর। হামাসের হাতে বন্দি ইজরায়েলিদের মুক্তির ক্ষেত্রেও মধ্যস্থতা করেছিল কাতার। সেই আলোচনাতেও মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন সালেহ।
হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতা সালেহ-র মৃত্যু নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও অফিশিয়াল বিবৃতি বা প্রতিক্রিয়া আসেনি ইজরায়েলের তরফ থেকে। যদিও নেতানিয়াহুর উপদেষ্টা মার্ক রেগেভ জানিয়েছেন, এই হামলার দায় নেবে না ইজরায়েল। পাশাপাশি এটাও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, এই হামলা কোনও ভাবেই লেবানন রাষ্ট্রের উপরে হামলা ছিল না। বরং হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে একটি সার্জিকাল স্ট্রাইক ছিল এই হামলা। রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রাক্তন ইজরায়েলি দূত ড্যানি ড্যানন অবশ্য এই হামলাকে স্বাগত জানিয়েছেন। হামাস নেতা সালেহ আল-আরৌরিকে হত্যার জন্য ইজরায়েলি সেনা ও ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে অভিনন্দনও জানিয়েছেন তিনি। এদিকে ড্যাননের এই টুইটের পরই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে ইজরায়েল। জানা গিয়েছে, ইজরায়েল সরকার নাকি তার মন্ত্রীদের এ বিষয়ে মুখ না খোলার নির্দেশ দিয়েছেন।
এদিকে এই হামলার কড়া নিন্দা করেছে লেবানন। লেবাননের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি বেইরুটে এই ধরনের হামলা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। 'ইজরায়েলের নয়া অপরাধ' বলেও আখ্যা দিয়েছেন এই হামলাকে। পাশাপাশি ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধের মধ্যে জোর করে লেবাননকে জড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: বন্দিদের কী পরিণতি হয় ইজরায়েলের জেলে? বর্ণনা দিচ্ছেন নির্যাতনের সাক্ষী
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য ইজরায়েলের এই হামলাকে মোটেই ভালো চোখে দেখছে না। এমন এক নেতার মৃত্য়ু হামাসদের হিংসার পথকেই আরও বেশি প্রকট করবে বলেই মনে করছেন তারা। ইতিমধ্যেই সালেহের মৃত্যুর প্রতিবাদে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের রামাল্লায় পথে নেমেছে মানুষ। সালেহ-র মৃত্যুর পর কি ইজরায়েলের বিরুদ্ধে নতুন করে কোনও পদক্ষেপের পথে হাঁটবে হামাস, নাকি নতুন কোনও কৌশল নেবে ইজরায়েল। কোথায় গিয়ে থামবে হামাস-ইজরায়েলের এই সর্বক্ষয়ী যুদ্ধ, সেটাই এখন বিশ্বের মানুষের কাছে সব চেয়ে বড় প্রশ্ন।