আর কোনও প্রাণীর দেহেই নেই! জানেন, কেন কেবল মানুষেরই চিবুক আছে?
Human Chin Evolution: কেন একমাত্র মানুষেরই চিবুক আছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের মুখগুলি কেন ছোট হয়ে গেল তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ
মানুষের দেহ জটিল এক তন্ত্র। শুধু ভেতরের নানা অঙ্গ, নাড়িভুঁড়ি, শিরা ধমনীর জটিল মারপ্যাঁচ নয়, বহিরাঙ্গেও মানুষের দেহ বেশ জটিল, বেশ বিবর্তিত। মানুষের দেহ গবেষণা করে দেখা গিয়েছে বেশ কিছু অঙ্গ মানুষের রয়েছে যা এই পৃথিবীতে আর কোনও প্রাণীরই নেই! যেমন, চিবুক! হ্যাঁ, সারা প্রাণিজগতে একমাত্র মানুষই এমন জীব যার চিবুক আছে। চিবুক অর্থাৎ নীচের চোয়ালের নিচ থেকে বেরিয়ে আসা হাড়ের অংশখানি। প্রাণিজগতে একমাত্র মানুষই এই চিবুকের অধিকারী! কেন? গবেষকরা বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন এই বিষয়ে, তাও মানুষের চিবুক আজও রহস্য হয়েই রয়ে গেছে।
চিবুক শুধু মানুষের মুখের নীচের অংশ নয়, এটি চোয়াল থেকে প্রসারিত একটি বিশেষ ছোট্ট হাড়। মানুষ ছাড়া নাকি আর একটিও প্রাণী খুঁজে পাওয়া যায়নি যাদের চিবুক আছে। মানুষ যাদের থেকে এসেছে, সেই পূর্বপ্রাণীরা? নাহ, তাদেরও ভাঁড়ে মা ভবানী! শিম্পাঞ্জি এবং গরিলা আমাদের নিকটতম জেনেটিক আত্মীয় হলেও, চিবুক নেই তাদেরও। সামনে এগিয়ে আসার পরিবর্তে, তাদের নীচের চোয়ালগুলি সামনের দাঁত থেকে নীচে এবং পিছনে ঢালু হয়ে যায়। আরও মজার বিষয় হচ্ছে, নিয়ান্ডারথালদের মতো অন্যান্য প্রাচীন হোমিনিডদেরও চিবুক ছিল না! তাদের মুখগুলি ছিল সমতল।
আরও পড়ুন- মানুষের মূত্র ঢুকিয়ে দেওয়া হতো ব্যাঙের দেহে! কীভাবে গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করত আগেকার মানুষ?
ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পাম্পুশের মতে, যদি শিম্পাঞ্জিদের থেকে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর সেই বৃহৎ পরিবারের সব হোমিনিডের দিকে লক্ষ্য করা যায়, তাহলে আসলেই এত বেশি বৈশিষ্ট্য পাওয়াই যাবে না যেগুলোকে আমরা একচেটিয়াভাবে বলতে পারি মানুষ। এই সমস্ত প্রাণীই সব দুই পায়ে হাঁটত। কেবল একটি জিনিসে এসেই সব ধারণা ঘেঁটে যায়, তা হলো চিবুক।
বিগত শতাব্দী জুড়ে মানুষের চিবুকের বিবর্তন নিয়ে নানা তত্ত্ব সামনে এসেছে। আমাদের খাবার চিবানো থেকে শুরু করে কথা বলতে সাহায্য করতে গিয়ে মানুষের চিবুক কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এই তত্ত্বগুলির অধিকাংশই আরও গভীরে গিয়ে খতিয়ে দেখার জায়গায় নেই। পাম্পুশের মতো বিজ্ঞানীদের একাংশের কাছে চিবুক বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের এই বিরল ঘটনাগুলির মধ্যে একটি যা ঘিরে সত্যিই গবেষকদের মধ্যে গভীর দার্শনিক পার্থক্য গড়ে উঠেছে৷
চিবুক বিষয়ক সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারণাগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে, আমাদের পূর্বপুরুষরা খাবার চিবানোর চাপ সহ্য করতে করতে আমাদের নীচের চোয়ালগুলিকে শক্তিশালী করে ফেলে এবং সুগঠিত চিবুক তৈরি হতে থাকে। কিন্তু পাম্পুশের মতে, চোয়ালকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে চিবুকের গঠন হয়নি। আমাদের কথা বলতে সাহায্য করার জন্য জিভ একাই যথেষ্ট শক্তিশালী অঙ্গ। তৃতীয় একটি ধারণা হচ্ছে, চিবুক মানুষকে সঙ্গী নির্বাচন করতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এই ধরনের যৌনতাকেন্দ্রিক নির্বাচনী বৈশিষ্ট্যগুলি সাধারণত শুধুমাত্র একটি লিঙ্গের মধ্যেই বিকাশ করে।
আরও পড়ুন- এ যুগের ‘রেভ পার্টি’ও ফেল! জানেন ব্রোঞ্জ যুগে নেশায় কতটা আসক্তি ছিল মানুষের?
বস্তুত মানুষের দেহে চিবুকের কোনও আসল উদ্দেশ্য নাও থাকতে পারে। পাম্পুশের মতে, এটিকে 'স্প্যান্ড্রেল' বলা যেতে পারে, অর্থাৎ অন্য একটি বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন থেকে বিবর্তন ঘটতে ঘটতে উপজাত অংশ হিসেবে চিবুক তৈরি হিয়ে গিয়েছে। চিবুকের ক্ষেত্রে, এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মুখ সঙ্কুচিত হওয়ার ফলাফলও হতে পারে। এককালে মানুষের চোয়াল ছিল দীর্ঘ, সেই থেকে ধীরে ধীরে আমাদের ভঙ্গি পরিবর্তিত হয়েছে এবং আমাদের মুখ ছোট হয়েছে। চিবুক অবশিষ্টাংশ হিসেবে রয়ে গিয়েছে।
চিবুকের উপস্থিতি সম্ভবত প্লেস্টোসিন যুগের সময় মানুষের মুখের আকার হ্রাসের নিদর্শনগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত। কেন একমাত্র মানুষেরই চিবুক আছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের মুখগুলি কেন ছোট হয়ে গেল তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ, বলছেন আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখের বিবর্তন বিষয়ে অধ্যয়নরত গবেষক নাথান হোল্টন।
স্প্যান্ড্রেল হাইপোথিসিসটি বেশ গ্রহণযোগ্য হলেও এরও কিছু সমস্যা রয়েছে। মানুষের কোন অংশ বিবর্তনের ফলে সৃষ্ট উপজাত অঙ্গ তা পরীক্ষা করার মতো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া কঠিন, বিশেষ করে যদি সেই অঙ্গের সুস্পষ্ট কার্যকারিতা না থাকে। কিন্তু গবেষকরা যদি একদিন খুঁজে বের করতে পারেন যে চিবুক আসলে কোথা থেকে এসেছে, তবে তা আমাদের আদি এবং নিয়ান্ডারথাল আত্মীয়দের থেকে আলাদা হয়ে ওঠার রহস্যভেদে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে।