পাকিস্তানপন্থী অবস্থানই সঠিক? বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতার মন্তব্য যে বিতর্ক তুলছে

Bangladesh Razakars: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই 'রাজাকার' শব্দটি অত্যন্ত ঘৃণ্য হিসেবেই দেখা হয়ে এসেছে ওদেশে।

কিছুকাল আগেই বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটার প্রতিবাদে যে আন্দোলন ঘটে, তাতে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক বক্তব্য। হাসিনা বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের মানুষ কোটা না পেলে কি রাজাকারের পরিবারের লোকজনরা পাবেন? এই 'রাজাকার' শব্দটি নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক ক্ষোভ। স্লোগান ওঠে “তুমি কে? আমি কে - রাজাকার, রাজাকার?", "অধিকার চেয়ে রাজাকার হয়েছি”। এবার সেই রাজাকারদের ভূমিকার পক্ষে সওয়াল করেছেন সেই দেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে রাজাকার আল-বদর বাহিনী বাঙালিদের উপর যে নিপীড়ন চালিয়েছে তা কি সঠিক ছিল তবে? জামাতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে এমনটাই ইঙ্গিত দেন সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলছেন, “পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত যুদ্ধ করেছে। এবং ভারত জিতেছে। তার মানে, তৎকালীন সময়ে যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, তাদের অবস্থান সঠিক ছিল।"

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই 'রাজাকার' শব্দটি অত্যন্ত ঘৃণ্য হিসেবেই দেখা হয়ে এসেছে ওদেশে। ১৯৪৭ সালের অগাস্টে ব্রিটিশরা ভারতকে ভাগ করে পাকিস্তান তৈরি করে। নবগঠিত এই রাষ্ট্র দু'টি অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল: পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানে ছিল মোট জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশ, যেখানে প্রায় ৪৪ মিলিয়ন লোকের বাস। দেশটি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা শাসন করত। ভাগাভাগি পরবর্তী দশকজুড়ে সম্পদের অভাব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রভাবের কারণে পূর্ব পাকিস্তানে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।

 

রাজাকার কারা ছিলেন? 'রাজাকার' শব্দটি ফার্সি, যার অর্থ 'স্বেচ্ছাসেবী'। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য ১৯৭১ সালে খুলনার খান জাহান আলি রোডের এক আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন পাকিস্তানপন্থী ব্যক্তিকে নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই রাজাকার বাহিনীর সদস্য সংগ্রহ করার তোড়জোর শুরু হয়। রাজাকার বাহিনী গঠনের পেছনে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা ছিল জামায়াতে ইসলামির তৎকালীন নেতা এ কে এম ইউসুফ। পরবর্তীতে রাজাকার বাহিনীর নায়েব-এ-আমির হন তিনি। মানবতা-বিরোধী অপরাধের মামলায় তাঁকে আটক করা হয়েছিল এবং পরে কারাগারেই তাঁর মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন- হাসিনার পাশে নেই ভারত? বাংলাদেশ নিয়ে ক্রমেই স্পষ্ট অবস্থান

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির তথ্য বলছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স গঠন করা হয়। এর অধীনে রাজাকার, আল-বদর এবং আল-শামস্ বাহিনী গঠন করা হয়। এই বাহিনীতে বাঙালিদের পাশাপাশি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উর্দুভাষী মানুষও ছিলেন। পাকিস্তান বাহিনীই এদের অস্ত্র জোগাত।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে রাজাকার বাহিনী ছিল শান্তি কমিটির আওতায়। ১৯৭১ সালের জুন মাসে জেনারেল টিক্কা খান রাজাকার আইন জারি করেন। সেই সময় রাজাকার বাহিনীতে প্রায় ৫০ হাজার সদস্য ছিল, যারা মাসিক ভাতা পেতেন। টাকার অঙ্কেও নেহাত কম না। সেই সময়ে প্রতি মাসে রাজাকার বাহিনীর একজন সদস্য দেড়শো টাকা ভাতা পেতেন। এই বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানের সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে অংশ নিতেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ধরতেন। হয় হত্যা করতেন কিংবা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বাহিনী বা সংগঠন গড়ে উঠেছিল - শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর এবং আল-শামস। এই শান্তি কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জামায়াত ইসলামির নেতা গোলাম আজম এবং মুসলিম লীগের নেতা খাজা খয়েরউদ্দিন। আল-বদর বাহিনীতে প্রায় পাঁচ হাজার সদস্য ছিল। জামায়াতে ইসলামির তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র সংঘের নেতা-কর্মীরা এই আল-বদর বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি জামায়াতে ইসলামির আমির হন। মানবতবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পরে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

আল-শামস বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও ছিল প্রায় ৩,০০০। এই রাজাকার বাহিনী বাংলাদেশজুড়ে বাঙালি এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের হত্যা ও ধর্ষণের যে নজির তৈরি করেছিল তা আজও ভুলতে পারেনি সেই দেশের মানুষ। রাজকারদের বরাবর রাষ্ট্রবিরোধী এবং পাকিস্তানপন্থী হিসাবেই দেখা হয়। মুক্তিযুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়, হাজার হাজার মহিলা ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর এই নৃশংস সামরিক অভিযানের মূল লক্ষ্যই ছিল পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। এই প্রচেষ্টায় মুখ্য ভূমিকায় মদত দিয়েছিল রাজাকাররা। যুদ্ধের শেষের দিকে যখন পাকিস্তানের পরাজয় আসন্ন, তখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় প্রায় ২০০ জন বাঙালি বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক এবং শিক্ষাবিদদের আটক করে এবং তাদের গুলি করে বলেও অভিযোগ। রাজাকারদের এই গণহত্যাকে বাংলাদেশ ভোলেনি।

আরও পড়ুন- বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা কি সত্যিই নির্যাতিত? প্রকৃত চিত্রটি আসলে যেমন

বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল ব্যাপক। তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধির সরকার মুজিবের বাংলাদেশকে প্রাণ দিয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে মিশে যুদ্ধ করে অবশেষে পাকিস্তানকে পরাজিত করে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে অনেক রাজাকারকে স্থানীয়রা আক্রমণ করে হত্যাও করে।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে আসার পর, আওয়ামী লীগ সরকার একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় গণহত্যায় অভিযুক্তদের তদন্ত ও বিচারের আদেশ দেওয়া হয়। এই অভিযুক্তদের মধ্যে ছিল পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা এবং স্থানীয় সহযোগীরা যারা আল-শামস ও আল-বদরের সদস্যরা। অভিযোগ ওঠে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতেই হাসিনার এই নির্দেশ। তবে হাসিনার এই প্রচেষ্টাকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের শিকারদের ন্যায়বিচার প্রদানের চেষ্টা হিসাবে দেখা হয়েছিল। ফলস্বরূপ, হাসিনা ব্যাপক মানুষের সমর্থনও পান। হাসিনার অধ্যায় শেষের পরে বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ক টালমাটাল। তাতে পাকিস্তানের অবস্থানকে সঠিক ভাবা কি দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্কে বিশেষ উপকারে আসবে? সংখ্যালঘু ইস্যুতে ভারতের বিদেশনীতির সমালোচনা করতে গিয়ে কোথাও কি পাকিস্তানকেই সমর্থন করে ফেলছেন এই নেতা? এই সমীকরণে পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে এই মুহূর্তে সুবিধার বলেই মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের। কারণ সহজ, ভারতের সরাসরি বিপক্ষে অবস্থান করা। হাসিনার সরকার ফেলার নেপথ্যে যে গণ অভ্যুত্থান ঘটে, বহুকাল ধরেই অভিযোগ ছিল এতে জামাতের পরোক্ষ মদত রয়েছে। বাংলাদেশে জমাতের অবস্থান পাকিস্তানপন্থীই। তারা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী। ছাত্রনেতাদের মধ্যে থেকে যখন রাজাকারদের সমর্থনে বক্তব্য উঠে আসে তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলছেন, "বিজয় এসেছে, তবে সামগ্রিক নয় মুক্তি এখনো বহুত দূরে!” তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সাহায্য ও যুদ্ধজয়কে খণ্ড স্বাধীনতা হিসেবেই দেখছেন তারা? সামগ্রিক মুক্তি বলতে কী বলছেন মাহফুজ? বলছেন, "হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত জনপদ পুনরুদ্ধার ব্যতীত পোকায় খাওয়া পূর্ব পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ দিয়ে আমরা মুক্তিকে ছুঁতে পারব না। ভারত একটা ঘেরাও (Contain) ও গেটো (Ghettoize) কর্মসূচি নিয়েছে। '৪৭ এ হিন্দু মৌলবাদী ও কুলীনদের (অখণ্ড) বাংলাবিরোধিতা থেকে এ পোকায় খাওয়া খণ্ড বাংলা দেশের জন্ম।" প্রশ্ন উঠছে, পোকায় খাওয়া যে বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে, এর সঙ্গে প্রকৃত মুক্তির সংঘাত কোথায়? ভারতের নীতিকে যুক্তি দিয়ে সমালোচনার জায়গায় যদি পাকিস্তানের পক্ষে সওয়াল করতে হয় তাহলে কি নির্মম ইতিহাসকেই অস্বীকার করা হয় না। নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন কি এই পথে বাস্তবায়িত হবে আদৌ?

More Articles