বামেরা চেয়েছিল বাদ দিতে || কেন আজও প্রাসঙ্গিক 'সহজ পাঠ'?
ছোট খোকা বলে অ আ
শেখেনি সে কথা কওয়া।
রবীন্দ্রনাথের অসামান্য সৃষ্টি-সাগরের এক স্বচ্ছ মুক্তো 'সহজ পাঠ'। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী বই। বিদ্যাসাগরের 'বর্ণপরিচয়'-এর ভাষা যতটা কঠিন, 'সহজ পাঠ'-এর ভাষা ততই সহজ ও সাবলীল। চলিত ভাষায় লেখা এই 'সহজ পাঠ' "ছোটো খোকা বলে অ-আ, শেখেনি সে কথা কওয়া" দিয়ে শুরু। রবীন্দ্রনাথের 'সহজ পাঠ'-কে সমৃদ্ধ করেছে নন্দলাল বসুর আঁকা। রবীন্দ্রনাথ এবং নন্দলাল বসুর যুগলবন্দিতে 'আজি হতে শতবর্ষ পরে'-ও সমান আকর্ষণীয় হয়ে থেকে যাবে এই শিশুপাঠ্য। 'সহজ পাঠ'-এর গোড়াতেই বলা আছে- 'নন্দলাল বসু কর্তৃক চিত্রভূষিত...।'
‘সহজ পাঠ’ সম্পূর্ণ সিরিজটি নন্দলাল বসুর অলংকরণে সমৃদ্ধ৷ 'সহজ পাঠ'-এর তৃতীয়, চতুর্থ ভাগের তুলনায় প্রথম, দ্বিতীয় ভাগই সর্বাধিক পরিচিত, তার একটা অন্যতম কারণ, বছরের পর বছর পশ্চিমবঙ্গে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যথাক্রমে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম ভাগ এবং দ্বিতীয় শ্রেণিতে দ্বিতীয় ভাগ পাঠ্য৷ ফলত প্রথম দু’টি ভাগের ছবিও অনেক বেশি পরিচিতি পেয়েছে, আলোচিত হয়েছে নানা শিল্প-সমালোচকের কথায়-কলমে৷ তবে ‘সহজ পাঠ’-এর ছবি বললেই আমাদের চোখের সামনে যে ছবিগুলি ভেসে ওঠে, সেইসব প্রচলিত ছবিগুলো ‘সহজ পাঠ’ আত্মপ্রকাশকালে (১৯৩০) ছিল না, ছিল ভিন্নধর্মী ছবি। উল্লেখ্য, নবম পাঠে ‘বৃষ্টি নামল দেখছি’ গদ্যে বোষ্টমীর প্রসঙ্গে আমরা দেখতে অভ্যস্ত, ঘরের মধ্যে চৌকিতে বসে দাদামশাই ও তাঁর গা ঘেঁষে নাতনি, আর মেঝেতে চাটাইয়ে বসে বোষ্টমী গাইছেন গান, প্রথম সংস্করণের অলংকরণে এ ছবি ছিল না, সেখানে পাঠের মাঝখানে ছিল স্পষ্টত এক বোষ্টমীর ছবি, মাথায় কেশরাশির চূড়া, পিঠে ভিক্ষার ঝুলি, হাতে ভিক্ষাপাত্র৷ বই-চিত্র যে বদলেছে, তা নয়, ভিন্ন ছিল বইটির আকৃতি এবং মলাট-পাতাও৷ লেখনশৈলি ছিল একেবারে সাদামাঠা মুদ্রণে, হলুদ রঙের মলাটে লাল কালিতে লেখা- 'সহজ পাঠ', আর তলায় লেখা 'শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর'৷
এখন নাকি অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল 'সহজ পাঠ' পড়ানোর প্রয়োজন বোধ করে না। তাহলে কি আগামী দিনে স্মৃতির অতলে চলে যাবে এই শিশুপাঠ্য? প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ, ১৯৮০ সালে ‘সহজ পাঠ’-কে কেন্দ্র করে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নকল্পে এক নতুন সিলেবাস কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি ‘সহজ পাঠ’-এর বদলে নতুন শিশুপাঠ্য প্রণয়নের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলনে শামিল হন দেশের বুদ্ধিজীবীরা। নীহাররঞ্জন রায়, সুশোভন সরকার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুবিনয় রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, প্রমথনাথ বিশী, প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত, আবু সৈয়দ আইয়ুব প্রমুখ সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেন। এত প্রতিবাদ সত্ত্বেও বামফ্রন্ট সরকার তাঁদের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। পরে অবশ্য ‘সহজ পাঠ’-এর শাপমুক্তি ঘটে।
আরও পড়ুন: ‘সোনার কেল্লা’ কমেডি থ্রিলার, বলেছিলেন সত্যজিৎ
বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সালে, ৭৫ বছর পরে ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’। শান্তিনিকেতন প্রেস থেকে রায়সাহেব জগদানন্দ রায় প্রকাশ করেন এই বই।
‘সহজ পাঠ'-এর সাহিত্যগুণ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর মত এইরকম: “পাঠ্যপুস্তক বলে যদিও রবীন্দ্রনাথ এখানে তাঁর প্রতিভাকে সীমিত রেখেছিলেন তথাপি তার প্রয়োগে কোন কার্পণ্য করেননি।‘সহজ পাঠ’ যেন প্রতিভার বেলাভূমিতে উৎক্ষিপ্ত, ক্ষুদ্র, নিটোল, স্বচ্ছ একটি মুক্তো। এর ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে চরিত্র, আর সেই সঙ্গে ব্যবহারযোগ্যতা, ছন্দোবদ্ধ ভাষায়, ভাষার কান্তিতে, চিত্ররূপের মালায়, গদ্যছন্দের বৈচিত্র্যে, অনুপ্রাসের অনুরণনে ‘সহজ পাঠ’ অনবদ্য।"
শিশুর সামগ্রিক বিকাশে ‘সহজ পাঠ’এর ভূমিকা নিয়ে এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন সুপ্রিয়া কর্মকার ও দেবপ্রসাদ শিকদার। তাঁদের বক্তব্য, শিশুপাঠ্য গ্রন্থ হিসেবে ‘সহজ পাঠ’ একেবারেই স্বতন্ত্র। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত দক্ষতায়, সচেতনতার সঙ্গে শিশুমনের উপযোগী করে তদানীন্তন সময়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক বিষয় উপস্থাপন করেছেন। গ্রাম, শহর, আচার-আচরণের সঙ্গে শিশুর পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
কিন্তু আমরা কি রবীন্দ্রনাথের সেই 'সহজ পাঠ'-এর শিক্ষার মান রেখেছি? বাংলা ভাষাই যেখানে বিপর্যস্ত, সেখানে 'সহজ পাঠ' কি আদৌ সুরক্ষিত?
অপূর্ব দত্তর একটা কবিতা এই প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। 'বাংলা টাংলা' কবিতার একটি লাইন, যেখানে এক শিশুর মা বাংলা বিষয়ের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে শিশুটির বাবাকে বলছে, "... চুপ করো তো, ওর ফল্টটা কিসে, স্কুলে কেন বেংগলিটা পড়ায় না ইংলিশে?" এই লাইনটির মধ্যে শ্লেষ থাকলেও রয়েছে এক ধরনের আশঙ্কা। এই প্রবণতা যদি ক্রমশ বাড়তে থাকে, তাহলে শৈশব যে বিপন্ন হবে, তা বলাই বাহুল্য।
এখানেই প্রশ্ন, আজকের শিশু কি প্রকৃত 'সহজ পাঠ' শিখছে ? পরিচিত হচ্ছে গ্রামবাংলার প্রকৃত রসের সঙ্গে? রবীন্দ্রনাথের কথা ও চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসুর এই ভুবনবিখ্যাত ছবিগুলো সাদা-কালো হলেও মানুষের মনে রঙিন হয়ে আছে। 'সহজ পাঠ'-এর বিকল্প আজও তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি। কোনওদিন হবেও না, একথা জোরগলায় দাবি করা যায়। বাংলা বর্ণমালার প্রাথমিক ধারণা, তাদের কাঠামো, উচ্চারণরীতি শিক্ষার জন্য এর থেকে ভালো বই আর কিছু হতে পারে না। ছোট ছোট ঘটনা ও গ্রাফিক্স চিত্র দিয়ে অক্ষরগুলিকে শিশুমনের উপযোগী করে তোলা হয়েছে।
আজও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সহজ পাঠ’ প্রাসঙ্গিক। কারণ এখানে শিশুদের প্রকৃতি, গ্রামবাংলার মাঝে নিয়ে যাওয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে 'সহজ পাঠ'। যখন আমরা 'সহজ পাঠ' পড়ি, তখন এটি আমাদের কাছে খুবই সাধারণ, কিন্তু তার গভীরে প্রবেশ করলে মনে হবে এটি বিশ্বসাহিত্যের এক অদবদ্য দৃষ্টান্ত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমাদেরকে বর্ণের পরিচয় দিলেও, পরবর্তীকালে রবি ঠাকুর সেই বর্ণগুলিকে দিয়েছেন সুরের ছন্দ, দিয়েছেন শব্দের জাদু।