মোদির ফোনও ব্যর্থ! কেন বসিরহাটে হেরে গেলেন রেখা পাত্র?
BJP Rekha Patra: হাজি নুরুল ইসলাম পেয়েছেন ৫২.৮ শতাংশ ভোট আর রেখা পাত্র পেয়েছেন ৩০.৯ শতাংশ ভোট।
রাজনীতি বিষয়ে তাঁর কোনও অভিজ্ঞতাই নেই, তবু তিনিই ছিলেন এই বাংলায় ভারতীয় জনতা পার্টির অন্যতম চমক দেওয়া প্রার্থী। সন্দেশখালি ইস্যুকে বিজেপি লোকসভা ভোটের আগে সর্বোচ্চ স্তরে ব্যবহার করতে চেয়েছে। সন্দেশখালিতে মহিলাদের নির্যাতন সহ বিবিধ অত্যাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত তৃণমূলের নেতা শেখ শাহজাহান ও তাঁর শাগরেদদের বিরুদ্ধে মহিলাদের আন্দোলনের মুখ ছিলেন। নরেন্দ্র মোদি খোদ ফোন করে বসিরহাট কেন্দ্রের প্রার্থী রেখা পাত্রের সঙ্গে কথা বলেন। তবুও শেষরক্ষা হলো না। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হাজি নুরুল ইসলামের কাছে ২,৯০,৬৭৪ ভোটের বিশাল ব্যবধানে হেরে যান রেখা।
হাজি নুরুল ইসলাম পেয়েছেন ৫২.৮ শতাংশ ভোট আর রেখা পাত্র পেয়েছেন ৩০.৯ শতাংশ ভোট। সিপিএমের নিরাপদ সর্দার রয়েছেন চতুর্থ স্থানে, পেয়েছেন মাত্র ৭৭,৮৮৯ টি ভোট। তৃতীয় স্থানে আছেন আইএসএফ প্রার্থী আখতার রহমান বিশ্বাস ১ লাখ ২৩ হাজার ৫০০ ভোট। রেখা পাত্রর হার রাজ্যে বিজেপির জন্য বড় ধাক্কা। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী প্রচারে বিজেপি 'নারী শক্তি' নিয়ে যেটুকু যা কথা বলেছে, সবটাই ছিল সন্দেশখালিতে যৌন নিপীড়ন এবং জমি দখলের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে। এই অভিযোগের জেরে তৃণমূলের শেখ শাহজাহান, তার ভাই এবং সহযোগীদের গ্রেফতারও করা হয়।
আরও পড়ুন- মাত্র ৯ টি আসন পেত বিজেপি! যে সমঝোতা হলে বাংলাছাড়া হতো গেরুয়া দল
বসিরহাটে রেখা পাত্র, তৃণমূলের নুরুল ইসলাম এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) নেতা নিরাপদ সর্দারের মধ্যে মূল লড়াই হওয়ার কথা ছিল। বসিরহাট অঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা ৫০ শতাংশেরও বেশি। অধিকাংশটাই তৃণমূলের পকেটের ভোট। ফলে বিজেপির টিকিটে এই অঞ্চলে ভোট টানতে পারা রেখা পাত্রের কাছে শুরু থেকেই কঠিন ছিল। জীবনে প্রথম নির্বাচনে লড়েছেন রেখা পাত্র, তাও আবার লোকসভা নির্বাচনের মতো কঠিন এক লড়াইয়ে। বামপ্রার্থী নিরাপদ সর্দার ছিলেন সন্দেশখালির প্রাক্তন বিধায়ক। তাঁর উপর আশা ছিল ঠিকই, তবে সারা রাজ্য জুড়ে বামেদের শোচনীয় হারের মধ্যে নিরাপদ সুবিধা করে উঠতে পারেননি।
তৃণমূলের নেতাদের বিরুদ্ধে জমি দখল এবং যৌন নিপীড়নের অভিযোগ সামনে আসার পরে সন্দেশখালিতে তৃণমূল বিরোধী হাওয়া তুলেছিল বিজেপি। বিজেপি 'নিপীড়িতা' রেখা পাত্রকে প্রার্থী করে মাস্টারস্ট্রোক খেলেছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রার্থীকে ফোন করে তাঁকে 'শক্তি স্বরূপা' নামে ডেকে বুঝিয়ে দেন রেখার উপর বাজি ধরেছেন তিনি। শেখ শাহজাহান এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রেখা, আন্দোলনের জেরে সকলেই গ্রেফতারও হয়। যদিও পরে একটি ভিডিও প্রকাশ্যে আসে যেখানে স্থানীয় বিজেপি নেতাকেই বলতে শোনা যায় কীভাবে ২০০০ টাকার বিনিময়ে এই মহিলাদের দিয়ে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ নির্বাচনের মুখে এই ভিডিও নিয়ে একটি কথাও বলেনি বিজেপি।
২০০৯ সাল থেকে বসিরহাটে পরপর তিনটি লোকসভা নির্বাচনে জিতেছে তৃণমূল। সংখ্যালঘু জনসংখ্যা এই অঞ্চলে ৫০ শতাংশেরও বেশি, আর আসনটিতে এ যাবৎ শুধুমাত্র মুসলিম প্রতিনিধিরাই নির্বাচিত হয়েছেন। বসিরহাট কেন্দ্রটি সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত — বাদুড়িয়া, হারোয়া, মিনাখাঁ (এসসি), সন্দেশখালি (এসটি), বসিরহাট দক্ষিণ, বসিরহাট উত্তর, এবং হিঙ্গলগঞ্জ (এসসি), সমস্তটাই উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অন্তর্গত।
গত লোকসভা নির্বাচনে এই আসনে জেতেন তৃণমূলের নুসরাত জাহান। এবার তাঁর বদলে ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী নুরুল ইসলামকেই প্রার্থী করা হয়। নুসরাত জাহান ২০১৯ সালে বিজেপির সায়ন্তন বসুকে ৩.৫ লক্ষ ভোটে হারিয়েছিলেন।
১ জুন ভোট ছিল বসিরহাট কেন্দ্রে। সেখানে সন্দেশখালি অঞ্চলে সেদিন তৃণমূল এবং বিজেপি সমর্থকদের মধ্যে হিংসা শুরু হয়। বহু মানুষ আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। বিজেপির রেখা পাত্র অভিযোগ করে ছিলেন তৃণমূলের গুন্ডারা ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দিয়েছে। এতকিছুর পরেও বসিরহাট নাগালে এল না বিজেপির। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে জায়গায় সন্দেশখালিতে আন্দোলন হয়েছিল সেটি সন্দেশখালি থেকে মাত্র একটি ব্লক দূরে। অতএব, এই আন্দোলন অন্যান্য বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে প্রভাব ফেলতে পারেনি।
আরও পড়ুন- ২০ বছর পর হার! অর্জুনের দুর্বলতাকে কীভাবে কাজে লাগালেন পার্থ ভৌমিক?
পাশাপাশি তৃণমূল 'স্টিং অপারেশন' করে যে ভিডিওটি ব্যবহার করেছে, যাতে স্পষ্ট বিজেপি নেতা গঙ্গাধর কয়াল ক্যামেরায় স্বীকার করেছেন সন্দেশখালি ঘটনায় ধর্ষণের অভিযোগগুলি ভুয়ো, সেই ভিডিওটি তৃণমূলের পক্ষে গেছে। সেখানে স্পষ্ট ওই নেতা বলে ফেলেছেন, বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীই এই 'ষড়যন্ত্রের পিছনে' রয়েছেন।
নুরুল ইসলাম জানেন, এলাকার জনসাধারণের সঙ্গে কীভাবে সংযোগ স্থাপন করতে হয় এবং তাঁর কৌশল কাজ করেছে কিন্তু রেখা পাত্র সন্দেশখালি ছাড়া অন্যান্য বিধানসভা কেন্দ্রগুলির সঙ্গে সংযোগ করতে ব্যর্থ হন। এই কেন্দ্রের হারোয়াতে ৫৮% সংখ্যালঘুর বাস, মিনাখাঁতে ৫০% সংখ্যালঘু জনসংখ্যা, সন্দেশখালিতে ২৩% সংখ্যালঘু, বসিরহাট দক্ষিণে ৫০% সংখ্যালঘু জনসংখ্যা, বসিরহাট উত্তরে ৬৮% সংখ্যালঘু থাকেন, হিঙ্গলগঞ্জে ২৬% আর বাদুড়িয়াতে ৬৩% সংখ্যালঘু জনসংখ্যা। তাই সেখানে দাঁত ফোটাতে পারা রেখার পক্ষে সম্ভবই ছিল না।