কংগ্রেস আর বিজেপির ফারাক কোথায়? মুখ্যমন্ত্রী বাছাই-ই ২০২৪-এ মোদির মাস্টারস্ট্রোক?

Narendra Modi and Amit Shah : মোদি ও অমিত শাহ কখনই চান না, তাঁদের কেউ চ্যালেঞ্জ করে বসুন। তাই বসুন্ধরা বা শিবরাজদের সেই সুযোগই তাঁরা দিতে চান না কখনও।

অন্য কেউ ভাবতেই পারেননি। এমনকী তাঁরা নিজেরাও ভাবতে পারেননি। সম্প্রতি ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে যাঁদের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বাছা হলো, তাঁরা নিজেরাও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জানতেন না, তাঁদের সামলাতে হবে রাজ্যভার। ছত্তিশগড়ের বিষ্ণু দেও সাই, মধ্যপ্রদেশের মোহন যাদব ও রাজস্থানের ভজনলাল শর্মারা আসলে নরেন্দ্র মোদিদের মাস্টারস্ট্রোক। এই মুখ্যমন্ত্রীদের নির্বাচন করে মোদির কোর টিম দেখিয়ে দিয়েছে তাঁরা কংগ্রেস বা অন্য দলের মতো পুরনো রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না। বরং তাঁরা যে আদর্শে বিশ্বাস করেন, সেই বিশ্বাসকে নিয়ে এক নতুন রাজনীতির দিকে এগিয়ে যাবেন। কংগ্রেসের পুরনো রাজনীতি ঠিক কী এবং মোদিদের নতুন রাজনীতিই বা কী? এদের মধ্যে একটা মিল থাকলেও, বড় পার্থক্য কোথায়?

কংগ্রেসের রাজনীতিতে একটা 'হাইকমান্ড' নামক বস্তু থাকলেও, আঞ্চলিক নেতাদের দাদাগিরি বরাবরই বিব্রত করেছে কংগ্রেস নেতৃত্বকে। কংগ্রেস মানেই একধিক গোষ্ঠী আর একাধিক দাদা! যে তিনটি রাজ্যে বিজেপি সরকার গড়ছে, সেখানেই দেখা যাক। রাজস্থানে, গেহলট-পাইলট। মধ্যপ্রদেশে, কমলনাথ-দ্বিগ্বিজয়-সিন্ধিয়া (এখন অবশ্য তিনি বিজেপিতে)। ছত্তিশগড়ে ভূপেশ বাঘেল-টিএস সিং দেও। এদের মধ্যে প্রকাশ্যে ঝগড়াঝাটির নিদর্শন গুনে শেষ করা যাবে না।

এর কারণ, এই ধরনের নেতারা নিজের নিজের রাজ্যে একটি অনুগামী গোষ্ঠী তৈরি করে ফেলতে সক্ষম হন। টাকা জোগাড় হোক বা লোক জোগাড় বা অন্য গোষ্ঠীকে টেক্কা দেওয়া হোক বা নিজেদের ক্ষমতার বিস্তার — যেভাবেই হোক না কেন, তাঁরা নিজেরা রাজ্যের ক্ষমতাবান নেতা হয়ে ওঠেন নিজেদের চেষ্টাতেই। এমনটা দেশের যেখানেই কংগ্রেসের একটু ক্ষমতা রয়েছে, সেখানেই দেখা যাবে।

আরও পড়ুন- আদানি অস্ত্রে কাবু হবেন মোদি? : সুমন চট্টোপাধ্যায়

তবে এরা মোটামুটি সবাই গান্ধি পরিবারের অনুগত। ফলে গান্ধিরাই যখন হাইকমান্ডে শেষ কথা, তখন তাঁদের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকে বটে। কিন্তু গান্ধিরাও হাল ছেড়ে দিলে, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসতে বিশেষ সময় লাগে না। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার মতো কেউ কেউ অবশ্য অতিষ্ঠ হয়ে কংগ্রেসের জাল ছিঁড়ে চলে যান। যেমন এক সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদ পাওয়াররা করেছিলেন।

কংগ্রেসি রাজনীতির সঙ্গে বিজেপির রাজনীতির একটিই মিল এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে — কংগ্রেসের মতোই ঘোষিত না হলেও, অঘোষিত একটি হাইকমান্ড তৈরি হয়েছে বিজেপিতেও। সেখানে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এবং মোহন ভাগবতেরা শেষ কথা। তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করেন রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি ঠিক কীভাবে এগোবে। কে নেতৃত্ব দেবেন আর কে পিছনে থাকবেন। কংগ্রেসি রাজনীতির সঙ্গে বিজেপির ওই একটিই মিল। তার পরে বাকিটা মোদিদের নিজস্ব রাজনীতি। যার নিদর্শন আমরা তিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনে দেখতে পেলাম।

প্রথমত, এই আঞ্চলিক নেতাদের 'নেতা' হয়ে ওঠার দম্ভ ভেঙে দাও, যা কংগ্রেস হাইকমান্ড কখনও পারেনি। রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির 'সুসম্পর্কে'র কথা আজ আর কারও অজানা নয়। মোদি যে বসুন্ধরাকে আর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান না, তা অনেক দিন আগেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। তাঁকে এবার নির্বাচনী প্রচারে মুখ্যমন্ত্রীর মুখও করা হয়নি। বসুন্ধরার বাড়বাড়ন্তকে এবার একেবারেই নির্মূল করে দিলেন মোদি। আঞ্চলিক নেতা বলে তিনি কাউকে রাখবেনই না। একই ফর্মুলা মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিং চৌহান ও ছত্তিশগড়ের রমন সিংয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হলো। শিবরাজকে তো আগেই সংসদীয় বোর্ড থেকে গুডবাই বলে দিয়েছিলেন মোদিরা। না শিবরাজ, না রমন - কাউকেই মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে দেখাতে চাননি মোদিরা।

দ্বিতীয় যে কাজটি নরেন্দ্র মোদিরা করলেন, তা হলো নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে আসা। কংগ্রেস যখন অশোক গেহলট, কমলনাথ, দ্বিগ্বিজয়দের পরে কোনও নতুন নেতার কথা ভাবতেই পারল না, তখন বিজেপি তিনজন আনকোরা নেতাদের মুখ্যমন্ত্রী বানিয়ে দিল। তেলঙ্গানায় অনেকটা বিজেপির ঢঙে এই রাজনীতি করেই রেবন্ত রেড্ডিকে সামনে এনে সাফল্য পেয়েছে কংগ্রেস। মধ্যপ্রদেশে যতই শিবরাজ সিং চৌহানের 'লাডলি বহেনার' সাফল্যের কথা প্রচার হোক, মোদিরা জানেন, তিন দশকের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ জনগণ বেশিদিন পছন্দ করবে না। আর তা ছাড়া মোদির মুখই যথেষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী যে কেউ হোক। মহারাষ্ট্রেও একই কাজ করেছিলেন মোদিরা। দেবেন্দ্র ফড়নবিশকে মুখ্যমন্ত্রী করে।

মোদি ও অমিত শাহ কখনই চান না, তাঁদের কেউ চ্যালেঞ্জ করে বসুন। তাই বসুন্ধরা বা শিবরাজদের সেই সুযোগই তাঁরা দিতে চান না কখনও। কাজেই তাঁরা বাতিলের খাতায় চলে যাওয়াই বিজেপির হাইকমান্ডের জন্য শ্রেয়।

আরও পড়ুন- ২০২৪ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি বনাম কে? এখন থেকেই উত্তর খোঁজার চেষ্টায় বিজেপি বিরোধীরা

এবার অন্য় একটি কাজ বিজেপি সন্তর্পণে করে চলেছে। যে তিনজনকে মুখ্যমন্ত্রী বাছা হয়েছে তাঁরা প্রত্যেকেই সংঘ পরিবারের রাজনীতি করে উঠে আসা নেতা। যেমন ভজনলাল শর্মা সংঘের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকেই উঠে এসেছেন রাজনীতিতে। সংগঠনে কাজ করেছেন বহুদিন। সংঘের সঙ্গে মূল জড়িয়ে থাকা এখন বিজেপি রাজনীতির জন্য একটি বড় মানদণ্ড। দেশের রাজভবনগুলিতে তাকালেও বোঝা যাবে, কীভাবে সংঘ পরিবারের সঙ্গে রাজ্যপালরা যুক্ত ছিলেন একসময়। তাঁদেরই বসানো হয়েছে রাজভবনগুলিতে।

এছাড়া জাতপাতের অঙ্ক একদম ঠিক করে কষেছেন মোদিরা। আদিবাসী অধ্যুষিত ছত্তিশগড়ে একজন আদিবাসীকেই মুখ্যমন্ত্রী করেছেন। সঙ্গে উপমুখ্য়মন্ত্রী বানিয়েছেন দু'জনকে — একজন ব্রাহ্মণ নেতা বিজয় শর্মা (যাঁর বিরুদ্ধে দাঙ্গা বাঁধানোর অভিযোগ উঠেছিল), আর অন্য একজন ওবিসি নেতা অরুণ সাউ। মধ্যপ্রদেশে আবার ওবিসি নেতা মোহন যাদবকে মুখ্যমন্ত্রী করে, দলিত সম্প্রদায়ের জগদীশ দেবড়া ও ব্রাহ্মণ নেতা রাজেন্দ্র শুক্লাকে উপমুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে। রাজস্থানে আবার অন্য রাজনীতি। সেখানে ব্রাহ্মণ নেতা ভজনলালকে মুখ্যমন্ত্রী করে রাজপুত দিয়া কুমারী ও তফশিলি উপজাতির প্রেমচাঁদ বাইরওয়াকে উপমুখ্যন্ত্রী করেছেন মোদিরা।

সংঘের রাজনীতিকে মূল ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন মোদি-অমিত শাহেরা। তাঁরাই ঠিক করে দিচ্ছেন কারা নেতৃত্বের দ্বিতীয় স্তরে থাকবেন। নিজের নেতা হওয়ার চিন্তা না করে সংঘের এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। বাকিটা নরেন্দ্র মোদি সামলে দেবেন। তাঁর মুখ এখনও পুরনো হয়ে যায়নি।

কংগ্রেস ও অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলি কি পারবে তাদের পুরনো রাজনীতি ছেড়ে নতুন কোনও পথ খুঁজে বের করতে?

More Articles