ঠিক কী কারণে ক্যারাভানকে প্রতিবেদন সরাতে হয়েছিল?
The Caravan on Kashmir Army Torture: ২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর পুঞ্চ এবং রাজৌরির একাধিক গ্রাম থেকে মোট ২৫ জনকে তুলে নিয়ে যায় সেনা। সেনার তিনটি পৃথক শিবিরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার চালানো হয়
তনভিয়া বড়ুয়া ও পম্পি অধিকারী: ছাইচাপা আগুন আগ্নেয়গিরি হয়ে আছড়ে পড়েছে বারবার। সেই আঁচে বারবার পুড়েছে উপত্যকার ইতিহাস, ভূগোল। তাই ভূস্বর্গের বুকে নেমে আসা নিস্তব্ধতা কানে বাজছিল বড়ই। সরকারের তরফে যদিও চেষ্টায় কোনও খামতি ছিল না। কখনও সিনেমা হলের উদ্বোধন, কখনও আবার ক্রিকেটের আয়োজন, সব কুশল-মঙ্গল বলে জোরকদমে চলছিল প্রচার। কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীরে যে সব ঠিক নেই, তা সামনে আনে ‘The Caravan’ পত্রিকা। সেনার হাতে নিরীহ কাশ্মীরি নাগরিকদের হত্যার খবর তুলে এনেছে তারা। আর সেই খবর সামনে আসার পর যা হওয়ার তা হয়েছে। মুদ্রণ রুখতে না পারলেও, ওয়েবসাইট থেকে ওই প্রতিবেদন সরাতে বাধ্য করা হয়েছে ‘The Caravan’-কে।
ওই প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইট থেকে সরাতে কেন্দ্রীয় তথ্য এবং সম্প্রচার মন্ত্রকের তরফে নোটিশ ধরানো হয় ‘The Caravan’-কে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৯এ ধারার উল্লেখ করা হয় নোটিশে, অর্থাৎ প্রতিবেদনটি দেশের সার্বভৌমিকতা, জাতীয় অখণ্ডতা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও পড়শি দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিপন্থী এবং উস্কানিমূলকও। সরকারি নির্দেশ মেনে প্রতিবেদনটি নিজেদের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নিয়েছে ‘The Caravan’। কেন্দ্রীয় নির্দেশের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে তারা। বিষয়টি আপাতত বিচারাধীন। ‘The Caravan’-এ ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করায় ‘The Wire’-কেও নোটিশ ধরানো হয়। তারাও ওয়েবসাইট থেকে প্রতিবেদনটি সরিয়ে নিয়েছে। আইনের দ্বারস্থ হয়েছে তারাও।
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি গোটা বিতর্কের সূচনা। ‘Screams from the Army Post’ নামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে তারা, যাতে কাশ্মীরে মোতায়েন ভারতীয় সেনার ৪৬ রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে পুঞ্চ এবং রাজৌরি জেলায় নিরীহ নাগরিকদের অপহরণ, অত্যাচার এবং হেফাজতে নিয়ে হত্যার অভিযোগ তোলা হয়। প্রতিবেদনটি লেখেন ‘The Caravan’-এর সাংবাদিক যতীন্দ্র কউর তুর। তিনি জানান, ২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর পুঞ্চ এবং রাজৌরির একাধিক গ্রাম থেকে মোট ২৫ জনকে তুলে নিয়ে যায় সেনা। সেনার তিনটি পৃথক শিবিরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার চালানো হয় তাঁদের উপর, যাতে তিনজনের মৃত্যু হয়। সেনা শিবির থেকে অত্যাচারের একটি ভিডিও-ও পোস্ট উঠে আসে সোশ্যাল মিডিয়ায়, যাকে ইরাকে আমেরিকার নৃশংস আচরণের সঙ্গে তুলনা করেন যতীন্দ্র।
আরও পড়ুন- স্বাধীন সাংবাদিকদেরই গৌরী লঙ্কেশের আদর্শকে বাঁচাতে হবে
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, তোপা পীর গ্রামে বাড়ি অশীতিপর মীর হুসেনের। স্ত্রী জায়নাব বাইয়ের বস ৭৬ বছর। তাঁদের বড় ছেলে নুর আহমেদ সীমান্তরক্ষীবাহিনীতে কর্মরত। মেজো ছেলে সফীর আহমেদ (৪৩) জঙ্গলে কাঠ কাটা, বাড়ির ছাদ মেরামতের কাজ করতেন। ভুট্টাও চাষ করতেন সফীর। বাড়ি থেকে হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় তিন ঘণ্টা। কার্যত মৃত্যশয্যায় শায়িত বাবাকে পিঠে চাপিয়ে, পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে নেমে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল সফীরেরই। সেখানে সেনার সঙ্গে বেশ সখ্যও গড়ে ওঠে তাঁর। একসময় ইনফর্মার বা চর হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেওয়া হয় তাঁকে। প্রথমে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন সফীর, তাতে বাড়ির একাংশ সেনা কার্যত দখল করে নেয় বলে অভিযোগ। প্রতিবাদ জানাতে গেলে শিবিরে ডেকে পাঠানো হয় তাঁকে। সেযাত্রায় রাজস্থান থেকে ফোন করে কোনও রকমে ভাইকে রক্ষা করেন নুর।
নুর জানান, সেনার চর হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন সফীর। ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর রেজিস্ট্রারেও তাঁর নাম নথিভুক্ত ছিল। আর পাঁচজনের মতো কাজ ছিল না সফীরের। রীতিমতো মাস মাইনে দিয়ে তাঁকে রাখা হয়েছিল। গত ২২ ডিসেম্বর সকালে এক সৈনিক এসে সফীরকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান বলে অভিযোগ। সেইসময় বাড়িতে ছিলেন সফীরের মা জায়নাব, স্ত্রী জরিনা এবং সফীর ও জরিনার শিশু সন্তানরা। ছুটিতে বাড়ি এলেও, তোপা পীর থেকে নেমে এসে হাসপ্লুতে একটি ছোট বাড়ি নিয়ে থাকছিলেন নুর। সেই দিনই ডেরা কি গলি এলাকায় জঙ্গি হামলায় চার সৈনিকের মৃত্যুর খবর পান তিনি।
নুর জানতে পারেন, গ্রামের একাধকি বাড়ি থেকে অনেককে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাতে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। তাঁর আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়। পরদিন সকালে গ্রামের বাড়িতে ফেরে সফীরের নিথর দেহ। সফীরের কাঁধে, হাতে, পায়ে ইলেকট্রিক শক এবং পোড়া দাগ ছিল বলে দাবি নুরের। লোহার রড এবং লাঠি দিয়ে পেটানোর দাগও ছিল বলে জানান তিনি। সফীরের পরিবারের দাবি, এর চারদিন পর সেনার একটি দল তাদের বাড়িতে পৌঁছয়। ১৬ রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের ব্রিগেডিয়ার এমপি সিং, কর্নেল দিবেশ কুমার নতুন ছাপানো ৫০০ টাকার নোটে নগদ ১০ লক্ষ টাকা ধরান হাতে। সফীরের মৃত্যুতে দুঃখপ্রকাশ করেন এবং বেরিয়ে যান তাঁরা।
বাকি যে দু’জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়, তাঁরা হলেন, মহম্মদ শৌকত (২৭) এবং সাবির হুসেন (৩২)। পুঞ্চের জঙ্গি হামলা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁদের সেনা তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ। তোপা পীরের বাসিন্দা লাল হুসেন জানান, ২২ ডিসেম্বর সকালে তাঁর জামাতা সাবির হুসেনকেও তুলে নিয়ে যায় সেনা। ৪৮ রাষ্ট্রীয় রাইফেলসে মালবাহকের কাজ করতেন সাবির। সেনাকে জল পৌঁছে দেওয়া মূল কাজ ছিল তাঁর। পাশাপাশি, তিনিও সেনার চর হিসেবে কাজ করতেন বলে গুঞ্জন ছিল। ওই দিন সকাল ১০টা নাগাদ আচমকা বাড়ির দরজায় এসে উপস্থিত হন সাবির। দরজা খুলতেই তাঁর সঙ্গে কয়েক জন সৈনিক হুড়মুড়িয়ে ভিতরে ঢুকে আসেন। লালকেও পাকড়াও করে গাড়িতে তোলা হয়। গাড়িতে তোলা হয় এলাকার বাসিন্দা শৌকত-সহ আরও বেশ কয়েক জনকে। তাঁদের সঙ্গে একই গাডি়তে তোলা হয়েছিল সফীরকে।
আরও পড়ুন- প্রশ্ন করার সংস্কৃতি সাংবাদিকতা থেকে যে ভাবে হারাল…
লাল জানান, স্থানীয় ‘মাল’ পোস্টে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। সেখানে ২০ জন সৈনিক লাঠি দিয়ে সকলকে পেটাতে শুরু করেন। পায়ে এবং পেটে এলোপাথাড়ি আঘাত নেমে আসে। পুঞ্চে হামলার নেপথ্যে কাদের হাত রয়েছে জানতে চেয়ে শুধু মাঝে কয়েকবার বিরতি নেন সৈনিকরা। তারপর আবার অকথ্য অত্যাচার চলতে থাকে। কোম্পানি কমান্ডার মেজর পঙ্কজ কুমারের সামনেই চলে অত্যাচার। লালের দাবি, জঙ্গি হামলার খবর তখনও অনেকের কানেই পৌঁছয়নি। কাজেই কে বা কারা জড়িত, সেই কথা জানার কথা ছিল না। কিন্তু সেসবের ভ্রূক্ষেপ না করে শৌকতকে ধরে দাঁড় করিয়ে ১৫ জন মিলে পেটাতে শুরু করেন।
সেই সময় সাবির মধ্যস্থতার চেষ্টা করেন বলে দাবি লালের। তাঁর দাবি, সাবির জানান, তিনি এমনিতেই সেনার চর হিসেবে কাজ করেন। তাই বাকিদের অত্যাচার না করে তাঁকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হোক। এর পরই নাকি সাবিরকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেন সৈনিকরা। দুই দিক থেকে তাঁর হাত ধরে ফেলেন কয়েক জন। এর পর তাঁর চোখের উপর লঙ্কাগুঁড়োর গোটা প্যাকেট ঢেলে দেওয়া হয়। সেই অবস্থায় এলোপাথাড়ি কিল, চড়, ঘুষি নেমে আসতে থাকে। সফীরও সৈনিকদের পা ধরে আকুতি জানান। তিনি যে চর, নিজের হ্যান্ডলারের নামও জানান, যাঁর কাছে রিপোর্ট দিতেন। কিন্তু সফীরের মাথায় এবং মুখে এলোপাথাড়ি ঘুষি মারা হয় বলে অভিযোগ।
লালা জানান, মারতে মারতে লাঠি ভেঙে গেলে বাঁশ দিয়ে পেটানো হয় সকলকে। সেটিও ভেঙে গেলে ঢেঁকিতে মশলা গুঁড়ো করার মুষল দিয়ে পেটানো হয়। হাড়গোড় ভেঙে কাতরাতে থাকা শরীরগুলির উপর লাঠি, মুষলের টুকরে পড়ে থাকতে দেখেন লাল। শৌকতের এক আত্মীয়া শেহনাজ জানান, এক বছরও হয়নি বিয়ে হয়েছিল। শৌকতের স্ত্রী ফতিমা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। সকালেই ফতিনা তাঁকে ফোন করেছিলেন। বেলার দিকে সেনা শিবিরের কাছেই ভেড়া চড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় আর্তনাদ শুনতে পান। পর মুহূর্তেই দেখেন, শৌকত-সহ আট জনকে টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করা হচ্ছে। চৌবাচ্চার কাছে নিয়ে গিয়ে শৌকতের ঘাড় ধরে বার বার জলে চোবাচ্ছেন কয়েক জন। সেই অবস্থায় শৌকতকে বিদ্যুতের শকও দেওয়া হয় বলে দাবি শেহনাজের। তাঁর দাবি, সাহায্যের জন্য চিৎকার শুরু করেন তিনি। তাতে সেনার কয়েকজন ছুটে আসেন তাঁর কাছে। সেখান থেকে না গেলে মাথায় ৩২টি গুলিই পুরে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেন। সেখান থেকে পালিয়ে এসে শৌকতের বাড়িতে খবর দেন শেহনাজ।
সাবিরের স্ত্রী রাকিয়া বেগম জানিয়েছেন, সেনার চর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর স্বামীকে রেয়াত করা হয়নি। রাকিয়ার বাবা লাল জানিয়েছেন, উল্টো করে ঝুলিয়ে সাবিরকে জলে চোবানো হচ্ছিল। তাঁর চোখের সামনেই মৃত্যু হয় জামাতার। সাবিরের ঠিক পরই শৌকত মারা যান। সেই সময় সেনা শিবিরের কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে ভিড় জমাতে শুরু করেন পরিবার এবং স্থানীয় লোকজন। মহিলারা কান্নাকাটি করছিলেন, কাতর আর্জি জানাচ্ছিলেন। সেনার হাতে আটক হওয়া নাজির জানান, মেজর সাহেব নির্দেশ দেন সকলকে উলঙ্গ করে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে নিয়ে যেতে। ফতিমা জানান, গর্ভে থাকা সন্তান এবং তাঁর সামনেই মারা যান সাবির।মারা গিয়েছেন নিশ্চিত হয়ে তবেই সাবিরের দেহ জল থেকে বের করা হয় বলে দাবি লালের।
সেনার হাতে আটক হওয়া ইরফান জানান, তিনটি নিথর দেহ পরপর রাখা ছিল। নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন সৈনিকরা। গালিগালাজ করছিলেন মৃতদের। কেউ বলছিলেন, খালে দেহগুলি ফেলে দেওয়া হবে, কেউ আবার পুড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। এরপর লোহার রড দিয়ে কেউ মাথায় আঘাত করেন। তারপর আর জ্ঞান ছিল না ইরফানের। স্থানীয়দের দাবি, লরির পিছনে ইরফানের সঙ্গে তিনটি মৃতদেহ চাপিয়ে ফেরত পাঠানো হয় গ্রামে। কোঁকাতে থাকা ইরফানের মুখে জল দিতে গেলেও সেনা বাধা দেয়।
স্থানীয়দের দাবি, লরিটি ডান্ডি মহল্লায় পৌঁছয় যখন, সেখানে থিকথিকে ভিড়। সকলের সামনেই সেনাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। শৌকত জীবিত না মৃত, সেই নিয়ে সন্দেহ ছিল তাঁদের। নিশ্চিন্ত হতে তাই লরি থেকে ছুড়ে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয় শৌকতের দেহ। এরপর তাঁর বুকের উপর পা দিয়ে লাফাতে থাকেন তিন জন। আবারও দেহগুলি তুলে নিয়ে লরিটি চলে যায়। এর পর গ্রামবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। আঘাতপ্রাপ্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের চিকিৎসা শুরু না করলে দেহ ফেরত নেবেন না বলে জানান তাঁরা। সকলে জমায়েত শুরু করলে ভোর ৩টে নাগাদ দেহগুলি ছাড়া হয় বলে অভিযোগ।
মাত্র ১০ মিনিটের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে এমন অনেককেই সেনা ওই দিন তুলে নিয়ে গিয়েছিল বলে অভিযোগ। ‘The Caravan’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসপুল্তের মহম্মদ আশরফকেও তুলে নিয়ে যায় সেনা। বিদ্যুৎ দফতরে দিনমজুরের কাজ করেন তিনি। তাঁর ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। ব্যাঙ্কের লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাওয়া হয়। পেশায় রাজমিস্ত্রি ফারুখ আহমেদ, ১৮ বছরের মহম্মদ জুলফকার, তার দাদা মহম্মদ বেতাবও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। জঙ্গি হামলার সময় গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন কি না প্রশ্ন করা হয় তাঁদের। হামলাস্থল থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে কী করে গুলির শব্দ শোনা সম্ভব, জানতে চেয়েছিলেন তাঁরা, তাতে এলোপাথাড়ি আঘাত নেমে আসে। তারপর শিবিরে নিয়ে চলে অকথ্য অত্যাচার। আহত অবস্থায় রাস্তার ধারে তাঁদের ফেলে দেওয়া হয় পরে।
একইভাবে সাওয়ানি মেহরার মহম্মদ নিসার ভেড়া চড়াতে বেরোলে তাঁকে সেনা তুলে নিয়ে যায় বলে জানা গিয়েছে। ভ্যানের মধ্যে আরও আটজন ছিলেন আগে থেকে, যাঁদের মধ্যে এক নাবালক এবং একজন শ্রবণশক্তিহীন বৃদ্ধও ছিলেন। বাইয়াজ গ্রামের শিবিরে নিয়ে গিয়ে অকথ্য অত্যাচার চালানো হয় বলে অভিযোগ। সেখানকার গ্রামের প্রধানরা এসে সেই নিয়ে প্রতিবাদ জানালে, সকলকে বেহরামগালায় সরিয়ে নিয়ে গিয়ে রাতভর অত্যাচার চালানো হয়। আধমরা অবস্থায় পরদিন বাড়ি পৌঁছন তাঁরা কিন্তু সেখানে আগে থেকেই সেনা মোতায়েন ছিল। হাসপাতলে যেতে দেওয়া হয়নি, বেরোতে দেওয়া হয়নি বাড়ি থেকে। তিনদিন পর সেনা সরলে তবে চিকিৎসার সুযোগ মেলে। পরে আহতদের কাউকে ১.৫ লক্ষ, কাউকে ২ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়। কারও পাঁজরে আঘাত ছিল, কারও কিডনি এবং যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নাকের মাঝের পর্দা ফেটে যায় কারও। রক্তবমি করেন কেউ। শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন কেউ। শারীরিক অত্যাচারের কথা পোর্টে থাকলেও, তাতে আইনি সিলমোহর মেলেনি। মৃতদের ময়নাতদন্তও সঠিকভাবে হয়নি বলে অভিযোগ। স্থানীয়দের দাবি, সেনার অত্যাচারের যে ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হয়, তা স্থানীয়দের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য, যাতে সম্ভাব্য পরবর্তী জঙ্গি হামলা নিয়ে আগে থেকে বার্তা দেওয়া যায়। আবার পুলিশের সঙ্গে সেনার দ্বন্দ্ব রয়েছে এলাকায়। পুলিশের তরফেও ভিডিও ছড়ানো হতে পারেও বলে দাবি কারও কারও। উপর থেকে নির্দেশ পেয়েই এই অত্যাচার চালানো হয় বলে দাবি তাঁদের।
এ নিয়ে প্রাক্তন এক সেনা আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলে ‘The Caravan’। তিনি জানিয়েছেন, বর্তমানে ব্রিগেড কমান্ডারদের কার্যকালের মেয়াদ কমে ১৬ থেকে ১৮ মাস হয়েছে। যোগ্যতার নিরিখে পদক দেওয়া হয়। তাঁর আমলে জঙ্গি হামলা হলে, সম্মান ও স্বীকৃতি মেলার পাওয়ার সম্ভাবনা কমে। সেই নিয়ে রেষারেষি রয়েছে নিজেদের মধ্যেই, তার জেরেও অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে এই ধরনের অত্যাচার চালানো হয় বলে জানিয়েছেন প্রাক্তন ওই সেনা আধিকারিক। কিন্তু সেনার চর হিসেবে যাঁদের নাম নথিভুক্ত রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে, তাঁদের বাঁচানোর কি কোনও দায়বদ্ধতা নেই? প্রশ্ন তুলছেন কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ।
এই ঘটনায় অভিযোগ দায়ের হলেও, পুলিশ আহতদের বয়ান রেকর্ড করেনি বলে অভিযোগ। পরবর্তীতে ৩০২ ধারায় মামলা দায়ের হলেও, অপহরণ, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, অত্যাচার সংক্রান্ত কোনও ধারাই যুক্ত করা হয়নি। তফসিলি জাতি এবং উপজাতিদের উপর অত্যাচার প্রতিরোধ আইনও প্রয়োগ করা হয়নি, যা কিনা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ অত্যাচারিত সকলেই প্রায় গুজ্জর এবং বকেরওয়াল সম্প্রদায়ের মানুষ,যাঁরা তফসিলি উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত। অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তির বিরুদ্ধেই শুধুমাত্র এফআইআর দায়ের হয়েছে। অথচ সেনাকর্তা থেকে সেনাকর্মী, ঘটনার সঙ্গে জড়িত সকলের নামই মুখে মুখে ফিরছে আহতদের এবং নিহতদের পরিবারের।
শুধু তাই নয়, ডিসেম্বর মাসের ওই ঘটনার পর ৪৮ রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের পরিবর্তে, এবছর জানুয়ারিতে ৬১ রাষ্ট্রীয় লাইফেলস বাহিনীকে মোতায়েন করা হয়েছে সেখানে। অর্থাৎ অভিযুক্ত সেনাকর্তা এবং সেনাকর্মীদের কেউই আর নেই সেখানে। সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। AFSPA-র আওতায় এমনিতেই সেনাকর্মীদের নাগরিক আদালতে তুলতে গেলে কেন্দ্রের অনুমোদন লাগে, জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে যা আজও দেখা যায়নি। সেনার তরফে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানা গেলেও, সেই রিপোর্ট জনসমক্ষে আসার সম্ভাবনা নেই। গত ২৫ ডিসেম্বর জম্মু সফরে যান সেনার চিফ অফ স্টাফ মনোজ পাণ্ডে। এর দু’দিন পর রাজৌরি যান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। পীড়িত পরিবারগুলির সঙ্গে তিনি দেখা করেন। সেনার উদ্দেশে বলেন, “উপত্যকাকে সন্ত্রাসমুক্ত করা উদ্দেশ্য হলেও, আমাদের লক্ষ্য বৃহত্তর হওয়া উচিত। দেশের মানুষের মন জয় করতে হবে আমাদের।”
এরপর সেনা এবং গোয়েন্দাকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও। সেই থেকে সেনার তরফে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ থেকে পড়ুয়াদের পেন-খাতা বিতরণ এবং রাস্তা নির্মাণে বাড়তি উৎসাহ দেখা গিয়েছে। সৌর প্যানেল বসানোর কাজও শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রিয়জনকে নৃশংসভাবে খুন করে তাঁদের জীবনে অন্ধকার নিয়ে এসেছে যারা, সৌর প্যানেল বসালেই কি পাপস্খলন হবে? প্রশ্ন পীড়িত পরিবারগুলির। তাঁদের মতে, ন্যায়বিচারের কোনও বিকল্প উপায় হতে পারে না। কোনও টাকা, কোনও খাবার তাঁদের প্রিয়জনকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
ভারতীয় সেনার একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্তা জানান, সেনার অপরাধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে টাকা মজুত রাখা হয়। যেভাবে নিহত এবং আহতদের পরিবারের হাতে নোটের বান্ডিল ধরানো হয়েছে, তাতে অর্থের নির্লজ্জ প্রদর্শন হয়েছে। টাকা দিয়ে ন্যায় বিচার হয় না। পীড়িত পরিবারগুলি সেনার থেকে পাওয়া বলে যে টাকা দেখিয়েছেনস, সেগুলি মহারাষ্ট্রের নাসিক এবং মধ্যপ্রদেশের দেওয়াসের টাঁকশাল থেকে ছাপানো হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ছাপানোর দিনও তাতে লেখা ছিল বলে দাবি সাংবাদিকের। অর্থাৎ সরাসরি টাঁকশাল থেকেই টাকা সেনার কাছে পৌঁছেছে, নিয়ম বহির্ভূত বলে জানিয়েছেন আয়কর দফতরের এক আধিকারিক। তাঁর দাবি, এভাবে যে টাঁকশাল থেকে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কও হয়ত সেটা জানে না।
আরও পড়ুন- ভারতীয় সাংবাদিকরাই লক্ষ্য! মোবাইলে পেগাসাস ঢুকিয়ে নজরদারি চালাচ্ছে কারা?
‘The Caravan’-এর প্রতিবেদনে লেখা হয়, জম্মু ও কাশ্মীরে গণহত্যা কোনও নতুন ঘটনা নয়। ১৯৪৭ সালে জম্মু গণহত্যা কাণ্ডের পর নয়ের দশকে পর পর গাওকাড়াল, হান্দোয়ারা, জাকুরা, হাওয়াল, বিজবেহারা, সোপোর, কুপওয়ারা গণহত্যাকাণ্ড ঘটে। হেফাজতে নিয়ে অত্যাচার, হত্যা, ভুয়ো এনকাউন্টারও নতুন কিছু নয়। কিন্তু ২২ ডিসেম্বর যে ঘটনা ঘটেছে, তার সঙ্গে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি-র রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। কারণ এক্ষেত্রে গুজ্জর এবং বখেরওয়ালদের উপর অত্যাচার হয়েছে। উপত্যকায় সেনার চর হিসেবে কাজ করেন এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। ২০২০ সালে সীমানা বিন্যাস কমিশন কাজে হাত দেওয়ার পর থেকের বর্তমানে জম্মুর হিন্দু ভোট এবং কাশ্মীরের মুসলিম ভোটের পাল্লা প্রায় সমান। কাশ্মীরে দাঁত ফোটাতে গেলে তাই এই গুজ্জর এবং বখেরওয়ালদের সমর্থন বিজেপি-র জন্য অত্যন্ত জরুরি। তাই ২২ ডিসেম্বরের ঘটনার পর থেকে সেখানে সেনাকে ‘সদ্ভাবনা’ প্রকল্পে নামানো হয়েছে, যার নেপথ্যে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থই লক্ষ্য বলে দাবি করা হয় প্রতিবেদনে। ওই সময়ে বিরোধী শিবিরের রাজনীতিকদের পীড়িতদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি, আটকে রাখা হয় বলেও অভিযোগ সামনে এসেছে।
‘The Caravan’-এর প্রতিবেদনটি মুদ্রিত হতেই কেন্দ্রের তরফে নোটিশ যায় তাদের কাছে। মুদ্রণ সংস্করণ যেহেতু ছেপে বেরিয়ে যায় আগই, তাই অনলাইন সংস্করণের উপর খাঁড়া নেমে আসে। কিন্তু প্রতিবেদনের ঠিক কোন অংশটি নিয়ে আপত্তি কেন্দ্রের? কার দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে সেটি সরানোর নির্দেশ দেওয়া হল? ‘The Caravan’-এর দাবি, বার বার জানতে চেয়েও সরকারের কাছ থেকে সদুত্তর মেলেনি। এমনকী আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগও দেওয়া হয়নি তাদের। একটি শুনানি যদিও হয়, কিন্তু সেখানে অভিযোগ খণ্ডনের সুযোগ পর্যন্ত মেলেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের এই আচরণ সংবাদবাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি বাক স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে অভিযোগ তুলেছে ‘The Caravan’.
ইউটিউবে ভিডিও-র আকারেও তুলে ধরা হয় ওই প্রতিবেদনটিকে, যা মাইক্রোব্লগিং সাইট X (সাবেক ট্যুইটার) এবং ইনস্টাগ্রামেও পোস্ট করা হয়। এর পরই ৯ ফেব্রুয়ারি ‘The Caravan’কে নোটিশ ধরায় কেন্দ্র। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য ১২ ফেব্রুয়ারি অনলাইন মিটিংয়ে যোগ দিতে বলা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারির ওই মিটিংয়ে প্রতিবেদনটি সরিয়ে নিতে বলা হয়। কিন্তু কী অভিযোগ, কোথায় আপত্তি, তার কোনও ব্যাখ্যা কেন্দ্রের তরফে দেওয়া হয়নি বলে দাবি ‘The Caravan’-এর। ওই দিনই নোটিশ দিয়ে প্রতিবেদনটি সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।