বাঙালি বনাম অবাঙালি: বেছে বেছে সুজিতকেই কেন নিশানা করলেন মমতা?
Mamata Banerjee-Sujit Bose: সরকারি জমি দখল, পুকুর ভরাট এই অঞ্চলে নতুন ঘটনা নয়। তাহলে এখন কেন প্রশ্ন তুলছেন মমতা?
বিধাননগর সল্টলেক অঞ্চলে গত কয়েক বছরে অবাঙালি বেড়েছে হু-হু করে। এই অঞ্চলে দাপট সুজিত বসুর, তৃণমূলের দমকলমন্ত্রী। দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় উন্নয়নের বহর বেড়েছে আর পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন দুর্নীতি, টেবিলের তলা দিয়ে কাজের পরিমাণও বেড়েছে বলে অভিযোগ। এবারের লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশ হতেই দেখা যায় কলকাতার পুরসভাগুলিতে ভোট কমছে তৃণমূলের। লোকসভা ভোটে বিজেপির আসন কমলেও ভোট সংখ্যায় বিশেষ প্রভাব পড়েনি। ভোট মিটতেই প্রথম তাই বাঙালি-অবাঙালি ইস্যুতে জোর গলায় কথা বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুরবৈঠক ডেকে সুজিত বসুর নাম করে বলেছেন, বিধাননগরে সরকারি জমি বেহাত হচ্ছে অথচ পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সল্টলেক জুড়ে ফুটপাথে হকার উচ্ছেদও শুরু হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ বাঙালি-অবাঙালি ইস্যুতে সুজিত বসুকেই কেন নিশানা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? কেন সুজিতের বিরুদ্ধে 'নিজের লোক' বসানোর অভিযোগ উঠল? নিজের লোক বলতে কাদের বোঝালেন মুখ্যমন্ত্রী?
নিম্নবিত্ত অধ্যুষিত সল্টলেক-বিধাননগর সংলগ্ন এলাকাগুলি বাদ দিলে সল্টলেক, লেক টাউন, বাঙুর, দমদম পার্কের মতো এলাকায় অবাঙালি ভোটের হার যথেষ্ট বেশি। অন্তত ২৬ থেকে ২৭ শতাংশ অবাঙালি ভোটার রয়েছেন এই এলাকায়। সল্টলেকের কোনও কোনও ব্লকে আবাসিকদের ৫০ শতাংশই অবাঙালি, এমনও আছে। আর এই অবাঙালিদের একটা বড় অংশই বিজেপির ভোটার। তাহলে মমতা কি বলতে চাইছেন সুজিত বসুর মদতে বিজেপি ভোট বাড়ছে সল্টলেক বিধাননগরে?
আরও পড়ুন- জবরদখল হয়ে যাচ্ছে বাঙালিদের জমি? কেন ক্ষোভে ফুটছেন মমতা?
ভিআইপি রোডের ধারে নয়ানজুলি ভরাট হওয়া নিয়ে ২০১৫ সালেই হইচই পড়ে যায়। নয়ানজুলি ভরাট করে বহুতল ও রেস্তোরাঁ তৈরি হওয়ার অভিযোগ ওঠে। সেবারও এই ইস্যুতে নিউ টাউনের তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন বিধাননগরের বিধায়ক সুজিত বসুকেই। ২০২৪ সালে আবার কাঠগড়ায় সুজিত। এবার মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি সুজিতের বিরুদ্ধে সরকারি জায়গায় লোক বসানোর অভিযোগ তুলেছেন। সরকারি জমি দখল, পুকুর ভরাট এই অঞ্চলে নতুন ঘটনা নয়। তাহলে এখন কেন প্রশ্ন তুলছেন মমতা?
২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বিধাননগরে তৃণমূলের ফল শোচনীয়। বিধাননগর বিধানসভা কেন্দ্রের লেকটাউনেও তৃণমূলের ফল খারাপ। লেকটাউন সুজিত বসুর জায়গা। ভিআইপি রোডের দক্ষিণদাঁড়ি, গোলাঘাটা অঞ্চলের একাধিক স্থানে সরকারি জায়গাতে যেখানে নয়ানজুলি ছিল, সেখানে এখন আবাসন এবং রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। তৃণমূলের অন্দরের সুজিত-বিরোধী শিবির বলছে, নয়ানজুলি ভরাট নিয়ে আগেও বিতর্ক হয়েছে। আর তখন রাজ্য সরকারও কোনও তদন্তের নির্দেশ দেয়নি। সুজিত বরাবরই মমতা ঘনিষ্ঠ। লোকসভা নির্বাচনেও এই অঞ্চলের প্রচারে সুজিত বসুকেই দেখা গেছে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে। সেই সুজিতই লোকসভা ভোটের পরে বিরাগভাজন হয়ে গেলেন!
আরও পড়ুন- হজ করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে ১,৩০০ পুণ্যার্থী, কেন মৃত্যুনগরী মক্কা?
তৃণমূল রাজ্যের লোকসভাগুলিতে দাপট ধরে রাখলেও বিভিন্ন জেলার পুর-এলাকাগুলির অধিকাংশেই বিজেপি তৃণমূলের থেকে এগিয়ে রয়েছে। লোকসভা ভোটের পুরসভা ভিত্তিক ফল অনুযায়ী, রাজ্যের ১২১টি পুরসভার মধ্যে ৭৪টিতেই ওয়ার্ড ভিত্তিক ফলাফলের নিরিখে ১ নম্বরে রয়েছে বিজেপি। তৃণমূল ৪১টিতে, কংগ্রেস ৩টিতে প্রথম স্থানে আছে। খোদ কলকাতার মধ্যে পুর-এলাকায় তৃণমূলের ভোটের শোচনীয় ঘাটতি দেখেই এবার সুজিত বসুর নাম ধরে এমন আক্রমণ মমতার, মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। মমতা স্পষ্টই বোঝাতে চেয়েছেন সুজিত টাকা নিয়ে যে 'নিজের লোকদের' ঢোকাচ্ছেন সল্টলেকে তারা অবাঙালিই বেশি এবং বিজেপির ভোটার। তাই তৃণমূলের ভোট কমছে। দলে থেকেও এ তো 'দলবিরোধী' কাজই।
ফুটপাত দখল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করার পরেই সল্টলেকে ফুটপাতের বেশ কিছু দোকান ভেঙে দিয়েছে বিধাননগর পুরসভা। কিন্তু ফুটপাথ ছাড়াও এখানে বিবিধ স্থানে যে পার্কিং গজিয়ে উঠছে তাও তো সরকারি জায়গা দখল করেই। নগরোন্নয়ন দফতরের একাধিক জমিতে বস্তিও গজিয়ে উঠেছে। বিধাননগরের নাওভাঙা, কুলিপাড়া, ছয়নাভির মতো জলাভূমি অধ্যুষিত সংযুক্ত এলাকায় বেআইনি বাড়িও আছে। সেসবও কি মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভ প্রশমন করতে গিয়ে ভেঙে ফেলা হবে? এখানেই প্রশ্ন উঠছে, খাস কলকাতায়, সল্টলেকে যা ঘটছে, সুজিত যা যা করছেন বলে অভিযোগ তা কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজরে এতদিন পড়েনি? নাওভাঙা, কুলিপাড়া এলাকায় অবৈধ বাড়ি গজিয়ে উঠেছে মুখ্যমন্ত্রীর নজর এড়িয়ে? নাকি এতদিন বিষয়টা দেখেও অদেখা রেখেছিলেন তিনি? ভোটের ফল প্রকাশ পেতেই কি মমতা তাই সতর্ক করে দিচ্ছেন সুজিতকে?