প্রথম আয়োডাইজ লবণ! অন্ধকার থেকে দরিদ্র ভারতকে সেদিন তুলে এনেছিলেন রতন টাটা
Tata Salt: আয়োডিনের অভাব এ দেশে একসময় ছিল রীতিমতো দুশ্চিন্তার বিষয়। তেমনই এক দুশ্চিন্তার দিনে এগিয়ে এসেছিলেন এ দেশেরই এক শিল্পপতি। তাঁর সংস্থার তৈরি নুন মিটিয়েছিল এ দেশের আয়োডিনের ঘাটতি।
নুন, পৃথিবীর প্রতিটি কুইজিন, প্রতিটি রান্নাঘরের এক মৌলিক উপাদান বললে খুব একটা ভুল হয় না। নুন ছাড়া সব খাবারই বিস্বাদ। ম্যাজিকাল এই যৌগটির রাসায়নিক নাম সোডিয়াম ক্লোরাইড। ভারতের ঘরে ঘরে, প্রতিটি রান্নাঘরের কৌটোয় যে সাদা যৌগটি থাকে, তাতে কিন্তু সোডিয়াম এবং ক্লোরিনের চেয়েও আরও একটু বেশি কিছু থাকে। কী সেই বেশি উপাদান? অবশ্যই আয়োডিন। যে আয়োডিনের অভাব এ দেশে একসময় ছিল রীতিমতো দুশ্চিন্তার বিষয়। তেমনই এক দুশ্চিন্তার দিনে এগিয়ে এসেছিলেন এ দেশেরই এক শিল্পপতি। তাঁর সংস্থার তৈরি নুন মিটিয়েছিল এ দেশের আয়োডিনের ঘাটতি। এখনও ভারতীয় রান্নাঘরের অন্যতম জরুরি উপাদান হয়ে রয়ে গিয়েছে টাটা সল্ট।
মজার ব্যাপার, এই যে এত জরুরি উপাদান আয়োডিন, সেই ব্যাপারটি কিন্তু মানুষের শরীরে নিজে থেকে তৈরি হতে পারে না। ফলে খাদ্যবস্তু থেকেই মানুষকে তা সংগ্রহ করতে হয়। কী কী কাজ করে এই আয়োডিন? বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, আমাদের মস্তিষ্কের গঠনে সাহায্য করে এই উপাদানটি। বাড়ন্ত শিশুদের ক্ষেত্রেও ভীষণ জরুরি এই উপাদান। মানবশরীরের থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে যেসব হরমোন ক্ষরিত হওয়ার কথা, সেগুলি তৈরিতেও বিশেষ ভূমিকা নেয় এই আয়োডিন। সেই হরমোনগুলির ক্ষরণ বন্ধ হয়ে গেলে মানবশরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং হাইপোথাইরয়েডিজমের মতো সমস্যা দেখা যেতে পারে।
আর কী কী হতে পারে আয়োডিনের অভাবে? বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, শরীর প্রচন্ড দুর্বল লাগা, মুখ ফুলে যাওয়া, চুল পাতলা হয়ে যাওয়া, হাড়ের সন্ধিস্থলে ব্যথা, মাংশপেশি নড়াচড়ায় কষ্ট, মহিলাদের অনিয়মিত ঋতুস্রাব, থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে গিয়ে গলগন্ড রোগ— এ সমস্ত কিছুই হতে পারে আয়োডিনের অভাবে। এমনকী অতিরিক্ত আয়োডিনের ঘাটতি হলে মহিলারা বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের সাধারণত প্রতিদিন ১৫০ মাইক্রোগ্রাম করে আয়োডিনের প্রয়োজন হয়। গর্ভবতী বা বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন যে সব মহিলারা, তাঁদের প্রতিদিন ২০০ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিনের প্রয়োজন বলে মনে করা হয়। সামুদ্রিক বা পাহাড় এলাকায় যাঁরা থাকেন, প্রকৃতিগত কারণে বহু সময়েই তাঁদের শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি দেখা যায়।
আরও পড়ুন: আকাশপথে ‘বিপ্লব’? ভারতকে যে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রতন টাটা
আয়োডিনের অভাবজনীত সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য এখন সহজ উপায় নুন খাওয়া। চিকিৎসকেরাও বহু ক্ষেত্রেই তেমন পরামর্শই দিয়ে থাকেন। রান্নাঘরের এই কমদামী অথচ স্বাদে-গুণে বহুমূল্য যৌগটি ভারতে সহজলভ্য। কিন্তু সব সময়েই যে এ দেশের লবণ এতটা আয়োডিন সমৃদ্ধ ছিল, তেমনটা কিন্তু নয়। ১৯৮৩ সালের আগে ভারতে আয়োডিনযুক্ত লবণের রমরমা ছিল না। যদিও চিন ও আমেরিকার পর লবণ উৎপাদনে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। গোটা পৃথিবী জুড়ে লবণের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৩০ মিলিয়ন টন। তবে বরাবর তেমনটা ছিল না। জানা যায়, ১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন দেশীয় চাহিদা মেটাতে নাকি সুদূর ব্রিটেন ও অ্যাডেন্স থেকে লবণ আমদানি করতে হয়েছিল। তবে দিনে দিনে লবণ উৎপাদনে উঠে আসে ভারত। ১৯৪৭ সালে ভারতে যে পরিমাণ লবণ উৎপন্ন হত, ২০১১-১২ সালের রেকর্ড বলছে, ততদিনে তা অন্তত দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বলাই বাহুল্য, সমুদ্রের জল লবণের একটি অন্যতম প্রাকৃতিক উৎস। গুজরাটের উপকূল এলাকা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের কন্টাইকে লবণ উৎপাদনের মূল কেন্দ্র হিসেবে গন্য করা হয়। এছাড়া রাজস্থান ও হিমাচল প্রদেশের বিক্ষিপ্ত জায়গাতেও লবণের আমানত রয়েছে। তবে সেসব জায়গায় লবণের প্রকারগুলি আলাদা। সাধারণ ভাবে সমুদ্রের নোনা জলকে ফুটিয়ে বাষ্পীভূত করে লবণ উৎপাদন করা হয়। এছাড়া লবণাক্ত কূপ অথবা লবণাক্ত হ্রদের জল থেকেও লবণ আহরণ করা হয়ে থাকে। নোনা জলের পাশাপাশি পাথুরে খনি থেকেও লবণ আহরণ করা হয়। ২০০২ সালে বিশ্বে মোট ২১০ মিলিয়ন টন লবণ উৎপাদন করা হয়েছিল।
ভারতের প্রথম ব্র্যান্ডেড সল্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল টাটা সল্ট। শুধু ব্র্যান্ড হিসেবেই নয়, আয়োডাইজ নুনকে ভারতীয়দের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার নেপথ্যেও অবদান ছিল রতন টাটা নামে এই বিখ্য়াত শিল্পপতির। শুধু ব্যবসা নয়, কীভাবে দেশবাসীর আয়োডিনের ঘাটতি মেটাতে মুখ্য ভূমিকা নিতে পারে তাঁর সংস্থার লবণ, সেদিকে শ্যেন দৃষ্টি ছিল মানুষটির। টাটা সল্টের আগেও ১৯৪২ সাল থেকে লবণ প্রস্তুতকারক সংস্থা হিসেবে সক্রিয় ছিল SKSCNADARAJAN & BROR। যারা মূলত ব্যবসা শুরু করেছিল ভারতের দক্ষিণাঞ্চল থেকেই। তুতিনকোরিন থেকে নুন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লবণ পরিবহন করত তারা। তবে বাজারের বড় নাম হিসেবে তেমন করে উঠে আসতে পারেনি সংস্থাটি কোনওদিনই, যেভাবে বাজার ধরতে পেরেছিল টাটা। পরবর্তী কালে অবশ্য অন্নপূর্ণা, আশীর্বাদ, ক্যাপ্টেন কুকের মতো একাধিক সংস্থা আত্মপ্রকাশ করে। তবে তারা টাটার কাছে নেহাতই শিশু। এখনও পর্যন্ত টাটা সল্ট ভারতের বৃহত্তম প্যাকেজড লবণের ব্র্যান্ড, যার বাজার শেয়ার প্রায় ১৭ শতাংশ।
১৯২৭ সালে গুজরাটের ওখাতে লবণ উৎপাদনের যাত্রা শুরু করেছিল টাটা গ্রুপ। সহজ ছিল না পথচলা। নানা কাঠখড় পুড়িয়ে ১৯৮৩ সাল নাগাদ, সংস্থাটি বাজারে আয়োডিনযুক্ত লবণ বিক্রি শুরু করে। সেসময় দেশবাসীর মধ্যে আয়োডিনের ঘাটতি ছিল অন্যতম একটি উদ্বেগের বিষয়। ১৯৬২ সাল নাগাদ ভারত লরকার জাতীয় গলগন্ড নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লাগে। যা এখন ন্যাশনাল আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি ডিসঅর্ডার কন্ট্রোল প্রোগ্রাম (NIDDCP) হিসেবে পরিচিত। ১৯৮২ সাল নাগাদ সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়, ১৯৯২ সালের মধ্যে ভারতের সমস্ত ভোজ্য লবণকে আয়োডেট করতে হবে। উনিশটি রাজ্য ও ৬টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে আয়োডিনবিহীন লবণ বিক্রি নিষিদ্ধও করা হয়। তবে ততদিনে বাজারে এসে গিয়েছে টাটা সল্ট, যা ভারতের প্রথম আয়োডাইজ লবণ হিসেবে পৌঁছে যায় দেশের প্রতিটি মানুষের রান্নাঘরে। ২০১৯ সালের জুন মাসের হিসেব বলছে, তখনও পর্যন্ত ৯০ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি টাটা সল্ট বিক্রি হয়েছে ভারতীয় বাজারে। যা খুচরো বিক্রেতা ও দোকানদারদের মাধ্যমে প্রতি মাসে সারা দেশের অন্তত ১৬১ মিলিয়ন পরিবারের কাছে পৌঁছেছে। ক্রমশ বিশুদ্ধ লবণ হিসেবে নিজেকে উন্নিত করেছে টাটা সল্ট। যা কিনা জলে সম্পূর্ণ রূপে দ্রবীভূত হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:বদলে যাবে বৃদ্ধাশ্রমের মানে, রতন টাটা বুঝিয়ে দিলেন অন্য ধনকুবেরদের থেকে কতটা আলাদা তিনি
এদেশে বহু শিল্পপতি এসেছেন, জমিয়ে বেসাতিও করেছেন। কিন্তু রতন টাটা যেন ছিলেন তাঁদের সকলের চেয়ে আলাদা। তাঁর আদর্শ, ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিটাই ছিল বাকি সকলের থেকে আলাদা। শুধু নুন নয়, তাঁর ব্যবসার পরিধি ছিল বিরাট, বিপুল। লবণ থেকে লোহা, ইস্পাত, গাড়ি, পোশাক থেকে গহনা, ইলেকট্রনিক্স গ্য়াজেট থেকে সফ্টওয়্যার, প্রায় সর্বত্র অবাধ বিচরণ টাটা গ্রুপের। তবে তার মধ্যেই জনকল্যাণের যে নিরন্তর চেষ্টা মানুষটি দেখিয়ে গিয়েছেন তাঁর কর্মক্ষেত্রে, তা কার্যত তুলনাহীন। ১৯৮৩ সালে আয়োডাইজ লবণের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল টাটার হাত ধরে, এতটা পথ পেরিয়েও কিন্তু সেই নুনকে মধ্যবিত্তের সামর্থ্যের মধ্যে রাখতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি সংস্থাটি। প্যাকেজিং থেকে দাম, কোনও জায়গাতেই যাতে টাটা সল্ট ব্যবহার করতে মানুষের কোনও রকম অসুবিধা না হয়, সে দিকে খেয়াল রেখেছে সংস্থাটি। চলতি বছরের ৯ অক্টোবর ৮৬ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন রতন টাটা। ১৮৬৮ সালে জামশেদজি নুসেরওয়ানজি টাটা-র হাত ধরে যে সংস্থার পথচলা শুরু হয়েছিল, তাঁকে বৃক্ষে পরিণত করেছিলেন নিজের হাতে রতন টাটা। আর সেই বৃক্ষ সর্বদা সচেষ্ট থেকেছে, যাতে ব্যবসার পাশাপাশি দেশের মানুষকে ছায়া দেওয়া যায়। ঠিক যেমন করে একদিন টাটা লবণের হাত ধরে পাল্টে গিয়েছিল আমজনতার রান্নাঘরের রূপকথা।