অপরিপক্ক নৌশাদের হাতে কীভাবে ঘোল খেয়ে গেলেন পক্ককেশ বামেরা?
ISF and CPIM: ডায়মন্ড হারবারে প্রার্থী না হয়ে, বামেদের এতদিন অপেক্ষা করিয়েও জোট না করে আইএসএফ বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তাঁদের বিজেপি-তৃণমূলের বিরুদ্ধে সদর্থক লড়াই করার কোনও বাসনাই নেই।
ভারত ও আমেরিকার মধ্যে অসামরিক পরমাণু চুক্তির প্রতিবাদ করে ২০০৮ সালে প্রথম ইউপিএ সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছিল সিপিআইএম। তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট ভেবেছিলেন কংগ্রেস পরিচালিত সরকার ফেলেই দেবেন। কিন্তু সিপিআইএম-এর বন্ধু সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং যাদব ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে কংগ্রেসকে সমর্থন করে সরকার বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। এই মুলায়ম সিংই ১৯৯৮-৯৯ সালে বাম ধর্মনিরপেক্ষ জোটের (যাতে কংগ্রেসও সামিল ছিল) অংশ হয়েও সনিয়া গান্ধির নেতৃত্ব মানতে চাননি, তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসতে দেননি।
২০০৮ সালে বঙ্গ ব্রিগেডের নেতারা প্রকাশ কারাটের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিলেন। অনেকে সমালোচনা করেছিলেন যে, প্রকাশ কারাট আর যাই হোক সিপিআইএমের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক হরকিষেণ সিং সুরজিৎ নন। সুরজিৎ জাতীয় রাজনীতির কুশীলবদের এত ভালো চিনতেন যে, কেউ মুখ খোলার আগেই বুঝে যেতেন কে কী বলতে বা করতে চলেছে। প্রকাশ কারাট বুঝতেই পারেননি একসময় সনিয়া গান্ধির বিরোধিতা করা মুলায়ম সেই সনিয়ার কংগ্রেসকেই বাঁচাতে এগিয়ে যাবেন।
মুলায়মের এরকম পাল্টি খাওয়ার ঘটনা অনেক আছে। সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু প্রকাশ কারাটের তীব্র সমালোচনা করা বঙ্গ সিপিআইএমের পক্ককেশ নেতারা যে অপরিপক্ক রাজনীতিক নৌশাদ সিদ্দিকির কাছে ঘোল খেয়ে গেলেন সেই গল্পটিই এখানে মূল প্রতিপাদ্য।
আরও পড়ুন- নজরে সন্দেশখালি প্রতিবাদী প্রাক্তন বিধায়ক নিরাপদই বসিরহাটে ভরসা বামেদের
এতক্ষণে আমাদের জানা হয়ে গেছে যে, আইএসএফ-বাম-কংগ্রেসের জোট ভেস্তে গেছে। ২০২১ সালের নির্বাচনে এরকম একটি জোট হলেও বা ২০২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে আইএসএফ ও বামেদের জোট হলেও এবারের ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে সেই জোট ভেঙে গেছে। নৌশাদ সিদ্দিকির আইএসএফ নিজেদের মতো প্রার্থী দিয়ে দিয়েছে। কোনও কোনও জায়গায় বামেদের সম্ভাবনাময় আসনগুলিতেও। কিন্তু বাম নেতারা এই সেদিন পর্যন্তও আশাতে ছিলেন যে আইএসএফের সঙ্গে তাঁদের জোট হবে এবং কয়েকটি আসন থেকে আইএসএফ তাদের প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেবে।
আইএসএফের নেতা নৌশাদ সিদ্দিকি ডায়মন্ড হারবারে তৃণমূলের দ্বিতীয় নম্বর, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বেন এই কথা ঘোষণা করার পরেও পিছিয়ে এসেছেন। আর সিপিআইএম নৌশাদের কথা ভেবে সেখানে প্রার্থীও ঘোষণা করতে পারেনি। অপেক্ষা করেছে। রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন নিয়েই যদি এমন দোলাচলে থাকে একটি বিরোধী শক্তি তাহলে তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী জনগণের কাছে কী বার্তা যাবে!
সাংবাদিক সম্মেলন করে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু দাবি করেছেন যে, তিনি সেই ১৯৫৭ সাল থেকে নির্বাচনী রাজনীতি করে আসছেন। তখন অনেক রাজনীতিকের জন্মই হয়তো হয়নি। কিন্তু এই সেদিনের ছোঁড়া নৌশাদ তবে বিমান বসুকে বোকা বানিয়ে ছেড়ে দিলেন কীভাবে?
এর সবচেয়ে বড় কারণ বামেদের আত্মবিশ্বাসের অভাব। একে বিজেপির উত্থানে পশ্চিমবঙ্গে কোণঠাসা হয়ে গেছে বামেরা। তাই কখনও কংগ্রেস তো কখনও আইএসএফকে কাছে টানতে হচ্ছে। কিন্তু তা যে ঠিক জোটের রাজনীতি নয়, তাও স্বীকার করে নিয়েছেন বিমান বসু। এটিকে আসন সমঝোতা বলতেই ভালোবাসেন প্রবীণ বাম নেতা। এই আসন সমঝোতাটি পুরোটাই স্বার্থান্বেষী রাজনীতির অংশ। শুধুই জয়ের অঙ্ক কষে আসন সমঝোতা। বিজেপি-তৃণমূল বিরোধী ভোটারদের কাছে টানার দৃঢ় প্রয়াসই নেই। আর এই সমঝোতায় বামেদের প্রথম থেকে ঠিক পাত্তাও দিচ্ছে না কংগ্রস। নৌশাদের আইএসএফ যে পাত্তা দিলই না, তা তো দেখাই গেল।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী যেন বহরমপুরের বাইরে আর কিছুই জানেন না! বাম নেতাদের সঙ্গে আলোচনাতে তাঁর খুব যে উৎসাহ ছিল না তা বোঝাই যাচ্ছিল। অন্যদিকে, জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব বামেদের থেকে তৃণমূলের সঙ্গে জোটেই বেশি উৎসাহী ছিল। রাহুল গান্ধির ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা পশ্চিমবঙ্গে ঢোকার পরে বাম নেতারা রাহুলের কাছে যাবেন কী যাবেন না, তা নিয়ে দোটানায় ছিলেন। শেষে তাঁরা যখন দেখলেন ভাগীরথী পেরিয়ে রাহুল মুর্শিদাবাদে এলেন, তৃণমূল নেত্রী যখন রাহুলের পাল্টা রোড শো শুরু করলেন, তখন নেতারা মনে বল পেয়ে রাহুলের সঙ্গে দেখা করতে ছুটলেন।
তৃণমূলের সঙ্গে জোট না হওয়ায়, অনেক দর কষাকষির পরে মোটামুটি একটি আসন সমঝোতার জায়গায় এসেছে বাম ও কংগ্রেস। তবুও কোচবিহার ও পুরুলিয়ায় বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই করছে বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক ও কংগ্রেস।
আরও পড়ুন- তৃণমূলকে জেতাতেই ডায়মন্ড হারবার থেকে প্রার্থী হলেন না নৌশাদ?
কিন্তু নৌশাদ সিদ্দিকির অভিপ্রায় নিয়েই সংশয় রয়ে গেল। তিনি হয় ভয় পেয়েছেন বা কেউ তাঁকে ভয় দেখিয়েছেন। অথবা তিনি ধূর্ত সুযোগসন্ধানী রাজনীতিক। নয়তো এত হম্বিতম্বি করে শেষমেশ ডায়মন্ড হারবারে প্রার্থী না হয়ে, বামেদের এতদিন অপেক্ষা করিয়েও জোট না করে আইএসএফ বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তাঁদের বিজেপি-তৃণমূলের বিরুদ্ধে সদর্থক লড়াই করার কোনও বাসনাই নেই। পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে সমাজ বদল করার কথা তো অনেক দূরের।
সেই বাসনা যে বাম ও কংগ্রেসেরও এই রাজ্যে আছে তাও স্পষ্ট নয়। যদি তাই হতো, তাহলে সিপিআইএম নেতারা নিজেদের শক্তির উপর ভরসা করে লোকসভা নির্বাচনে কিছু নির্দিষ্ট আসনে জেতার জন্য ঝাঁপাতেন। অন্য আসনে জিততে না পারলেও প্রার্থী দিতেন। কিন্তু জেতার জন্য যদি কংগ্রেস ও আইএসএফের দিকে চাতক পাখির মতো বসে থাকতে হয়, তাহলে তো গোড়াতেই গলদ।
যুবনেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে ইনসাফ যাত্রা করিয়েও বাম নেতারা বুঝতে পারলেন না, কোথায় তাঁদের সমর্থন ফিরে আসছে বা সাংগঠনিক শক্তি ঠিক কতটা! সেই আসনগুলিতেই বিশেষ জোর দিতেন তাঁরা। কিন্তু এই 'অপেক্ষার' রাজনীতি করতে গিয়ে তাঁরা এই রাজ্যের বিজেপি ও তৃণমূল বিরোধী ভোটারদের কাছে সদর্থক বার্তাই পৌঁছতে পারলেন না। এটা বুঝতেই সময় লেগে গেল যে নৌশাদ সিদ্দিকি 'কারও হাতের তামাক খাচ্ছেন'। নৌশাদের ইমেজের যাই হোক, বাম রাজনীতিকদের ইমেজের দফারফা হল।
এর পরেও নিজের ক্যারিশমার জোরে বা কংগ্রেস ও বামেদের নীচুতলার কর্মীদের সাহায্যে যদি একটি বা দু'টি আসন বাম-কংগ্রেস জিতে যায়, তাহলে সেটা চমৎকার হবে।