নিজেদের সন্তানকেই হত্যা করে জারোয়ারা, কিন্তু কেন?

ভারতের আন্দামান উপকূল অঞ্চলের চারটি আদিম উপজাতির মধ্যে অন্যতম হল জারোয়া। অনুমান করা হয়, তারা জাঙ্গিল উপজাতির বংশধর। আবার অনেকে তাদের আফ্রিকা থেকে চলে আসা প্রথম সফল উপজাতি হিসেবেও মনে করে থাকেন। বর্তমানে দক্ষিণ আন্দামান এবং মধ্য আন্দামানের কিছু অংশে তাদের বাস। জারোয়া উপজাতি আজও তামাম দুনিয়ার মনে বিশেষ কৌতূহলের জন্ম দেয়। তাদের জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস কিংবা ভাষা-সংক্রান্ত বিষয়ে বহির্জগতের মানুষের আগ্রহের অন্ত নেই। তাদের বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্যের সীমাবদ্ধতা এখনও রয়েই গেছে। কিন্তু ২০১৬ সালে আন্দামানে ঘটে যাওয়া এক নৃশংস শিশুহত্যার ঘটনা আবিশ্ব মানুষকে বাকরুদ্ধ করেছিল।  

২০১৬ সালের ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী একজন মিশ্র জাতির জারোয়া শিশুকে শ্বাসরোধ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল এবং পরের দিন সমুদ্রের ধারে শিশুটির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। এই খবর প্রকাশ হওয়ার আগে পর্যন্ত জারোয়াদের এই নীতি নিয়ে কারওরই বিশেষ ধারণা ছিল না।  কিন্তু পরবর্তী সময় জানা যায়, জারোয়ারা তাদের জাতির পবিত্রতা বজায় রাখার স্বার্থে, কোনও মিশ্র জাতির শিশুকে নিজেদের সমাজে জায়গা দেয় না। জন্মানোর কিছুদিনের মধ্যেই মিশ্র শিশুদের পবিত্রতার বলি হতে হয়। যদিও ২০১৬ সালের মৃত শিশুটিকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা তার মা করলেও, তার পক্ষে শিশুটির শেষ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। শোনা যায়, তিনি নাকি পাঁচ মাস ধরে তাঁর সন্তানের গায়ের রংটুকু অবধি সবার থেকে গোপন করে রেখেছিলেন। অবশেষে একদিন রাত্রে যখন তিনি ঘুমোচ্ছিলেন, তখন শিশুটিকে একজন মদ্যপ জারোয়া তুলে নিয়ে যায় এবং পরের দিন তাঁর মৃতদেহ মেলে সমুদ্রতটের কিনারে।   

আন্দামানের একটি নির্দিষ্ট পরিসরের মধ্যে আবদ্ধ থাকা জারোয়ারা, অন্য কোনও জাতিকে যে বিশেষ পছন্দ করে, এমনটা নয়। মিশ্র জাতির শিশুহত্যার পিছনে যে শুধুমাত্র নিজেদের জাতির পবিত্রতা রক্ষাই রয়েছে, এমনটা ভাবলে আসলে খানিক বোকামিই করা হবে। আসলে জারোয়াদের সঙ্গে অন্য জাতির সংঘাত বহুদিনের এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সংঘাতের তিক্ততা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই তিক্ততার কারণ খুঁজতে হলে আমাদের কয়েক বছর পিছিয়ে যেতে হবে।

আরও পড়ুন: ভারতীয়দের নির্বিচারে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হত কলকাতার এই রাস্তায়

দ্বন্দ্ব অহর্নিশ

ইংরেজরা যখন আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে যায়, তখন তারা আন্দামানে বসবাসকারী বিভিন্ন স্থানীয় উপজাতি গোষ্ঠীর প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। ব্রিটিশরা সেই সময়ে এই সমস্ত উপজাতির মানুষদের জন্য বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়। এই ধরনের সাহায্যমূলক পদক্ষেপে অনেক উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ সন্তুষ্ট হলেও জারোয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে তারা পরাজিত হয়। এরপর, ১৯০৫ সালে ক্ষিপ্ত জারোয়ারাদের থেকে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলি রক্ষার জন্য জঙ্গলে পুলিশ পোস্ট বসানোর ব্যবস্থা করে ইংরেজরা। জারোয়াদের প্রতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টাও ব্রিটিশ সরকার চালিয়েছিল। কিন্তু জারোয়ারা তাদের বিরোধী মনোভাব অক্ষুণ্ণ রাখে এবং ব্রিটিশ আগমনকে তাদের এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি তাদের একচ্ছত্র অধিকার খর্ব করার ব্যবস্থা হিসেবেই দেখে।     

রক্ষকই ভক্ষক   

ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর পাঁচ এবং ছয়ের দশকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে, তখনকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা অনেককেই পুনর্বাসন প্রকল্পে আন্দামানে জমিজমা দেওয়া হয়। ফলে প্রচুর বৃক্ষছেদন করা হয়। এমনকী, সেই প্রকল্প ধীরে ধীরে জারোয়াদের বাসভূমি অবধি পৌঁছে যায়। স্বাভাবিকভাবেই, জারোয়ারা বিষয়টি ভাল চোখে নেয়নি। সেজন্য ভারত সরকার ১৯৫৬ সালে জারোয়া উপজাতির জন্য সংরক্ষিত এলাকা চালু করে। জারোয়াদের সংরক্ষণের জন্য জঙ্গলে পুলিশ পোস্ট চালু করা হয়। কিন্তু জারোয়াদের সংরক্ষণের জন্য পুলিশরক্ষীরাই ক্রমে জারোয়াদের শোষণের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।পুলিশরক্ষীদের এহেন আচরণে উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ জারোয়াদের বনসম্পদ অবৈধ আহরণে নেমে পরে। ফলে, জারোয়া এবং অন্যদের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়, তাতে উভয় পক্ষেরই অনেক হতাহত হয়।

পর্যটন

ব্রিটিশদের মতো ভারত সরকারও জারোয়াদের সন্তুষ্ট করার জন্য তাদের এলাকায় কাজ দিয়ে প্রমোদ ভ্রমণের বন্দোবস্ত করে। এই ভ্রমণে পর্যটকরা জারোয়াদের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবহার সামগ্রী, তাদের বসবাস এলাকার কাছে রেখে আসত। বন্ধুত্ব স্থাপনের এই পদ্ধতি ফলপ্রসূ হয় এবং ১৯৭০ সালে প্রথম জারোয়ারা তাদের এলাকায় পর্যটকদের তরী নামাতে দেয়।

আরও পড়ুন: গাজন থেকে বেসমা পুজো, গ্রাম থেকে শহরে – বৈশাখ যে ভাবে আসে

বুক চিরে রাস্তা

আন্দামানের জনসংখ্যা বাড়তে থাকায়, ওই এলাকায় পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য ১৯৮৮ সালে ৩৪৩ কিমি দৈর্ঘ্যের ‘আন্দামান ট্র্যাঙ্ক রোড’  তৈরি হয়। ওই রাস্তার মধ্যে ৩৫ কিমি গেছে জারোয়াদের জন্য সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে দিয়ে। জারোয়ারা প্রথম থেকেই তাদের এলাকার মধ্যে দিয়ে রাস্তা তৈরিতে প্রবল বাধা দান করে এবং তির-ধনুক নিয়ে রাস্তা নির্মাণকর্মীদের আক্রমণ করতে থাকে।  

ফিরে আসা

১৯৯৬ সালে এনমি নামে একজন জারোয়া যুবক জারোয়াদের জন্য সংরক্ষিত এলাকার সীমানায় আহত হলে, তাঁকে পোর্টব্লেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ৫ মাস চিকিৎসাধীন থাকার পরে নিজে উপজাতির কাছে সে ফিরে গেলে, জারোয়া এবং অন্যান্যদের মধ্যে বৈরি খানিক কমে।

সাফারির নামে শোষণ

জারোয়াদের সঙ্গে অন্যদের সম্পর্ক খানিক স্বাভাবিক হওয়ার পরে, অদ্ভুতভাবেই জারোয়াদের বঞ্চনা আরও তীব্রতর হয়ে উঠেছে। জারোয়াদের নিয়ে বর্তমানে জঙ্গল সাফারির নামে জারোয়া সাফারি চলছে। বিভিন্ন টুর অপারেটররা এই কাজগুলি করে থাকে। খাদ্য ও পানীয়-র লোভ দেখিয়ে তাদের ছবি তোলা হচ্ছে। জারোয়া মহিলারা ক্রমাগত যৌন লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন, এমনকী, অনেক সময়ে খাবারের বিনিময়ে তাদের নগ্ন হয়ে নাচতেও বাধ্য করা হয়ে থাকে। পর্যটকদের সঙ্গে এলাকার শান্তিরক্ষা বাহিনীও এই একই কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ছেন। এখন বহিরাগতরা জারোয়া এলাকায় প্রবেশ করতে ভয় পায় না। অনেকসময় আবার কিছু জারোয়া খাদ্য, পানীয় বা বিভিন্ন সামগ্রীর লোভে জারোয়া এলাকায় বাইরের লোকের প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। শুধুমাত্র বনসম্পদ আহরণের মধ্যে তাদের যাত্রা সীমাবদ্ধ থাকছে না, জারোয়া মহিলারা তাদের লিপ্সার শিকার হচ্ছেন।

এলাকায় জারোয়াদের স্বার্থরক্ষার্থে পুলিশ বাহিনী রয়েছে, বনবিভাগের কর্মীরা আছে, রয়েছে তাদের স্বার্থরক্ষার্থে বিভিন্ন আইন। কিন্তু জারোয়াদের ওপর, এই ধরনের অত্যাচার বহুদিন ধরে, একইভাবে চলেই আসছে। জারোয়াদের জন্য রেশন, খাদ্যসামগ্রী ইত্যাদি নিয়ে ‘অর্গানিক জারোয়া’ নামে এক সম্পূর্ণ তথ্যচিত্র একজন ফরাসি চিত্র পরিচালক নির্মাণ করেন। ২০১৪ সালে তথ্যচিত্রটি মুক্তি পায়। সেখানে এই বঞ্চনার ছবি উঠে আসে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জারোয়াদের সুরক্ষার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা বলছেন, এই বিষয়ে তাঁরা অবগত নন। এর থেকেই প্রশাসন জারোয়াদের সুরক্ষায় কতখানি সজাগ, তা বোঝা যেতে পারে।

যে এলাকায়, জারোয়াদের সঙ্গে অন্যদের মিশ্রণ বেশি হয়েছে, সেই এলাকায় মাদক দ্রব্য এবং যৌন অত্যাচার মাত্রারিক্ত। অবস্থা আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে যে, কিছু অ-জারোয়া জারোয়া এলাকায় কুঠি বানিয়ে সেখান থেকে এই ধরনের অবৈধ কাজকর্ম চালাচ্ছে নির্দ্বিধায়। এই কারণে মিশ্র জাতির সন্তান জন্ম নেওয়ার মতো ঘটনাগুলি ঘটছে। যেহেতু পুলিশ-প্রশাসন এই সমস্ত অপরাধের ব্যাপারে উদাসীন এবং অনেকসময় নিজেরাই লিপ্ত- তাই আইনভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নামমাত্র বা হাতে গোনা। দীর্ঘদিন ধরে, অ-জারোয়াদের দ্বারা অত্যাচারিত এবং শোষিত হয়ে যে মিশ্র জাতির যে কোনও মানুষের ওপরেই জারোয়ারা যে ক্রোধ উগরে দেবে, তা বলার অবকাশ রাখে না। জারোয়া এবং বাকিদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটলেই একমাত্র জারোয়া সমাজে মিশ্র জাতির শিশুহত্যা রোধ করা সম্ভবপর হবে।  

 

 

More Articles