২০২৪-এ ফিরে এল ২০১৯! কেন মমতারা বারবারই 'বেলতলায়' যান?
Mamata Banerjee INDIA : যখন আসন সমঝোতা নিয়ে কংগ্রেসি-চালে মমতা ক্ষুব্ধ তখন রামমন্দির মমতাকে বাড়তি অক্সিজেন দিল।
এ যেন ২০১৯-এরই পুনরাবৃত্তি! ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে একে একে হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, কংগ্রেস, ডিএমকে, আম আদমি পার্টি, এনসিপি-সহ বিভিন্ন বিজেপি-বিরোধী দলের নেতারা। 'ইউনাইটেড ইন্ডিয়া'র শপথ নিয়েছিলেন তাঁরা। ঠিক করেছিলেন নরেন্দ্র মোদিকে হারাবেন। মঞ্চে এসেছিলেন বিক্ষুব্ধ বিজেপি নেতা যশবন্ত সিনহা। তার আগেই মুম্বই থেকে শপথ নেওয়া হয়ে গিয়েছিল সংবিধানকে রক্ষা করার।
তখনও কংগ্রেস কী করবে এবং বামেরা আদৌ মমতার মঞ্চে যাবেন কিনা, তা নিয়ে দোলাচল ছিল। সেই সভায় রাহুল গান্ধি পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন লোকসভার দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গেকে। বাম নেতারা স্বাভাবিকভাবেই দিল্লির মিটিংগুলিতে থাকলেও, মমতা মঞ্চ থেকে শতহস্ত দূরেই ছিলেন। ব্রিগেডের সমাবেশের পর তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে উজিয়ে গিয়েছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশে, ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ফ্রন্টের আহ্বায়ক চন্দ্রবাবু নাইডুর এলাকা থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করতে।
কিন্তু মাস গড়াতে না গড়াতেই মমতা বুঝে যান, এই ফ্রন্টের ভবিষ্যৎ খুব একটা উজ্জ্বল নয়। একইসঙ্গে মমতা এটাও বোঝেন রাজ্যেও তাঁর ঘর গোছানো নেই। তার থেকে ভালো নিজের ঘর গুছিয়ে যতটা বেশি আসন পাওয়া যায়, ততটা নিশ্চিত করা। আর সর্বভারতীয় প্রচারে মমতা বিশেষ মন দেননি। রাজ্যে মরিয়া চেষ্টা করেও বিজেপির ১৮টি আসন পাওয়া অবশ্য ঠেকাতে পারেননি তৃণমূল নেত্রী।
পাঁচ বছর পরে আরও একটি লোকসভা নির্বাচনের সামনে এসে এ যেন ২০১৯ ফিরে এল!
আরও পড়ুন- স্মার্ট-দুর্নীতির দক্ষ খিলাড়ি মোদি সরকার
এবার অবশ্য বেশ আগে থেকেই কোমর বেঁধে নেমেছিলেন বিরোধী দলগুলির নেতারা। পটনায় প্রথম বৈঠক হলো ২৩ জুন ২০২৩। তার আগে ঠিক চন্দ্রবাবু নাইডুর মতোই সারা দেশ ঘুরে ঘুরে বিরোধীদের একজোট করার কাজটি শুরু করেছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ও জনতা দল ইউনাইটেড নেতা নীতিশ কুমার। সেবারের মতো বাম থেকে কংগ্রেস হয়ে তৃণমূল, এমনকী আম আদমি পার্টি সবাই এক হয়ে বসে আদর্শগত লড়াইয়ের রূপরেখা ঠিক করলেন। বেঙ্গালুরু ও মুম্বইতে দু'টি বৈঠক হয়ে গেল। সেখানে জোটের নাম ধামাকাদার 'ইন্ডিয়া' হবে বলে ঠিকও হয়ে গেল।
সেই অভিঘাতে তখন ভারতের তামাম মোদি-ভক্ত মিডিয়া ঠিক করে উঠতে পারছে না যে বিরোধী জোটের ইন্ডিয়া নামটি ঠিক কীভাবে উচ্চারণ করবে! আই-এন-ডি-আই-এ বলবে না ইন্ডিয়া বলবে বুঝতে না বুঝতেই সরকারি দল সংবিধানে লিখে রাখা দেশের নাম ভারতকে ফিরিয়ে আনল সরকারি ঘোষণায়, কথাবার্তায়। পাছে ইন্ডিয়া বললে বিরোধী জোটকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে যায়!
ব্যাস ওইটুকুই!
প্রাথমিক উত্তেজনা তৈরি করে অচিরেই মিইয়ে গেল ইন্ডিয়া জোট। পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের আগে পর্যন্ত তাও এক রকম ছিল। কর্ণাটকে নির্বাচনে জিতে কংগ্রেসও আত্মবিশ্বাসী ছিল খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু ডিসেম্বরে পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে হেরে গিয়ে খেলা উল্টোদিকেই ঘুরে গেল।
তবু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা যেন উদার হচ্ছেন এই ভাব করে দিল্লি গেলেন। সন্ধেবেলায়, বিরোধীদের প্রধানমন্ত্রীর মুখ এখনই প্রকাশ্যে আনা হবে না বলেও, পরের দিন সকালে বিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের নাম ঘোষণা করে জল ঘোলা করে দিলেন তৃণমূল নেত্রী। খাড়গের ঘাড়ে ক'টা মাথা রয়েছে যে তিনি রাহুল গান্ধির জায়গায় নিজেকে তুলে ধরবেন?
অন্যদিকে যখন আসন সমঝোতা নিয়ে কংগ্রেসি-চালে মমতা ক্ষুব্ধ তখন রামমন্দির মমতাকে বাড়তি অক্সিজেন দিল। তিনি বুঝলেন মেরুকরণ হলে তৃণমূলই বাংলাতে ফায়দা তুলবে। তাই কংগ্রেসকে টাটা করে তিনি নিজের গাড়িতে 'একলা চলো রে' বলে উঠে বসলেন। কারণ তিনি তখন বুঝে গেছেন ইন্ডিয়া জোটের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল নয়।
ঠিক ২০১৯-এ যেমন ভেবেছিলেন, তেমনই ২০২৪-এ এসে মমতা নিজের ঘর গোছাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বাংলার বাইরে তৃণমূলের পক্ষে কোনও আসন জেতার সম্ভাবনা নেই। অন্যের সঙ্গে জোট করে জিতলেও দু'একটির বেশি তো নয়। তার থেকে দুর্বল রাজ্য বিজেপির কল্যাণে যদি মেরুকরণের রাজনীতিতে তিনি খান ৩০-৩৫টি আসন জিতে নিতে পারেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাহলে তাঁর নিজের জায়গা ঠিক রাখতে পারবেন দিল্লিতে। ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগেও তিনি এক গোলে এগিয়ে থাকবেন। সুতরাং আঞ্চলিক দলের জোট বা নির্বাচন-পরবর্তী জোটের কথা আউড়াচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।
এদিকে, ঠিক চন্দ্রবাবু নাইডু যেমন ২০১৯-এ অন্ধ্রপ্রদেশে গোহারান হেরে নির্বাচনের পরে এনডিএ-তে নাম লেখাতে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন, শেষমেশ লেখালেনও, সেই ভুল নীতিশ করতে রাজি হলেন না। লালু প্রসাদের আরজেডি-র সঙ্গে জোট করে কী হবে না হবে, তার থেকে ইন্ডিয়া জোটের আহ্বায়ক না হতে পারার অতৃপ্ত আত্মাকে তিনি তৃপ্তি দিলেন নির্বাচনের আগেই এনডিএ জোটে চলে গিয়ে।
আরও পড়ুন- রাহুল গান্ধির সঙ্গে দু’ দশ মিনিট
২০১৯-এ আরও একজন বিজেপি-বিরোধী নেতা জোট করার জন্য খুব ঘুরেছিলেন সারা দেশ জুড়ে। তিনি তেলেঙ্গানার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তথা ভারত রাষ্ট্র সমিতির নেতা কে চন্দ্রশেখর রাও। তিনি খুল্লাম খুল্লা এনডিএ জোটে না ভিড়লেও, বিজেপির সঙ্গে সুসম্পর্কই বজায় রেখেছিলেন। তখনও জোটের মুখ কে হবে তা নিয়ে ঠান্ডা লড়াই ছিল। মমতা, চন্দ্রবাবু না কেসিআর। এবারও নীতিশ খুব করে চেয়েছিলেন জোটের আহ্বায়ক হতে। বুঝেই হোক বা না বুঝে নীতিশকে একঘরেই করে দেওয়া হয়েছিল ইন্ডিয়া জোটে।
নির্বাচনের মুখে ভোটের অঙ্ক কষে সুবিধাবাদী জোট করতে গেলে এই রকমই হয়। তবে ইন্ডিয়া জোট একদম শুরুর দিকে আশার আলো দেখালেও, বিরোধীদের 'স্বভাব যায় না মলেও'।
তাই তৃণমূল, আম আদমি পার্টি, জনতা দল ইউনাইটেড-কে বিজেপির বি-টিম বলে সন্দেহ করে অনেকে। এদের কাজই যেন বিরোধী জোটের হাওয়া তুলে তারপর জল ঘোলা করে বেরিয়ে এসে কংগ্রেসকে গালাগালি দেওয়া। এতে আদতে লাভ হয় বিজেপিরই। বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলি ভালো ফল করলেও, কংগ্রেস যদি ভালো ফল না করে তবে বিজেপিকে আটকানো খুবই কঠিন। মোদির সঙ্গে জোরদার লড়াইয়ের কথা তো ভুলেই যান।
২০১৯ তাই যেন ঘুরে ফিরে আবার এল ২০২৪-এ!