রাহুল গান্ধিরাই রাষ্ট্রের নতুন 'শহুরে নকশাল'? কেন নয়া তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান মোদি-শাহরা?
Urban Naxal: রাহুল গান্ধীকে আর্বান নকশাল বলে দেগে দেওয়ার প্রধান কারণ দেশের প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম ঘনিষ্ঠ ও অনেকের মতে তার লাইফ লাইন গৌতম আদানি ও তার কর্পোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে লোকসভার বিরোধী দলনেতার নীতিগত অবস্থান।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের অধিনায়কত্বে গড়ে ওঠা চলমান সরকারি রাজনীতির ন্যারেটিভে 'আর্বান নকশাল' একটি বহু প্রচলিত শব্দবন্ধ। প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে আমাদের নিয়মিত জানানো হয়, কেন দেশের উন্নতি সুনিশ্চিত করতে এই প্রজাতিটিকে (এই প্রজাতির আরেক নাম টুকরে টুকরে গ্যাং) সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলতে হবে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী একটি জনসভায় বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে এই সমস্ত কলমবাজ আর্বান নকশালরা ভারতকে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি হয়ে উঠতে দিতে চাইছে না। আর এই আর্বান নকশালদের শায়েস্তা করতে সরকার ঠিক কতটা তৎপর, তা ভুক্তভোগীরা ভালোই জানেন। সদ্য প্রয়াত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ও ৯৫ শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধী জি এন সাইবাবা, জেলখানায় বিনা চিকিৎসায় মরে যাওয়া অশীতিপর ফাদার স্ট্যান স্বামী থেকে শুরু করে দেশের অধিকার আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা (ভীমা কোঁরেগাও মামলায় অভিযুক্ত সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন, গৌতম নওলাখা থেকে শুরু করে ছাত্র নেতা উমর খালিদ— তালিকা শেষ হবে না) সবাই আজ সরকারের চোখে দেশদ্রোহী। এক কথায় বর্তমান সরকারের কর্পোরেট উন্নয়ন মডেল, ধর্মীয় বিদ্বেষ, বিভাজনের নীতি ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে মানুষেরা সরব, মোদি-শাহের জমানায় তাঁরা সবাই আর্বান নকশাল। এ পর্যন্ত গল্পে কোনও গোলমাল নেই, এমনকী গল্পগুলো কমবেশি সবারই জানা।
সমস্যা হল সেই গল্পেই এবার গোল বেঁধেছে। এই গোল বাঁধার কারণ আর্বান নকশালদের অন্তহীন তালিকায় নতুন এক নাম সংযোজন। এই নতুন নামটি হল সংসদীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সংসদে বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধি। ভোটের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের তরজা অনেক সময়ই লক্ষণরেখা অতিক্রম করে কিন্তু এবারের বিষয়টির গুরুত্ব একেবারেই আলাদা। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা, মহারাষ্ট্রে বিজেপির প্রধান মুখ দেবেন্দ্র ফড়নবীস গত কয়েকদিন ধরে যে কথাগুলো বলে যাচ্ছেন, তা কোন আলটপকা বক্তব্য নয় বরং বিজেপির পক্ষ থেকে এক পরিকল্পিত আগ্রাসন। এই প্রচারে বলা হচ্ছে রাহুল গান্ধি আর্বান নকশালদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন এবং রাহুল আজ কংগ্রেসের রাজনীতি ভুলে অতি বাম রাজনীতির মতাদর্শ ফেরি করছেন। দেশের শ-দেড়েক এই ধরণের গ্রুপ/ গোষ্ঠী /এনজিও আছে যাদের থেকে রাহুল গান্ধি সাহায্য নিচ্ছেন। বছর খানেক আগে রাহুল গান্ধির দু'টি বহু আলোচিত পদযাত্রা, যথাক্রমে ভারত জোড়ো যাত্রা এবং ন্যায় যাত্রা আর্বান নকশালদের পরিকল্পনার ফসল। এখন এটা পরিষ্কার যে 'ভারত জোড়ো যাত্রা' আদতে ছিল 'ভারত তোড়ো যাত্রা'। একই সঙ্গে ফড়নবীস অভিযোগ করেছেন যে রাহুল গান্ধি প্রতিটি জনসভায় বিজেপির ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখার সময় লাল মলাটের সংবিধানের যে সংক্ষিপ্ত নোটবুকটি দেখান, তা আসলে নকশালদের 'রেডবুক'। এটা যদি সত্যি সংবিধান হত তাহলে তার মলাটটি নীল রঙের হত। যদিও পরবর্তী সময়ে রেডবুক সংক্রান্ত বালখিল্য অভিযোগটি হালে পানি পায়নি। তবে একথা অস্বীকার করার কারণ নেই যে রাহুল গান্ধির সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য সংসদীয় রাজনীতির পূর্ব নির্ধারিত সীমারেখাকে অতিক্রম করে নতুন কিছু ভাবনার জন্ম দিয়েছে। বিজেপির বক্তব্য তাই দেখতে গেলে এক প্যানিক রিঅ্যাকশন। এই প্রসঙ্গে রাহুল গান্ধির জবাবটিও গুরুত্বপূর্ণ। ঝাড়খন্ডের এক নির্বাচনী জনসভায় তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে এদেশে যে বা যারা মোদি- শাহের ঘৃণার রাজনীতি ও কর্পোরেট ভজনার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবে, তাদেরই আর্বান নকশালের তকমা জুটবে।
আরও পড়ুন: কেন নরেন্দ্র মোদির মুখে ‘আর্বান নকশাল’ প্রসঙ্গ উঠছে ফের?
রাহুল গান্ধিকে আর্বান নকশাল বলে দেগে দেওয়ার বিষয়টি শুধু নির্বাচনী রাজনীতির মধ্যে সীমায়িত নয়।এর প্রধান কারণ দেশের প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম ঘনিষ্ঠ ও অনেকের মতে তার লাইফ লাইন গৌতম আদানি ও তার কর্পোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে লোকসভার বিরোধী দলনেতার নীতিগত অবস্থান। ২০২২ সালের শেষদিকে আদানি গ্রুপের একচেটিয়া আগ্রাসন ও তাদের অজস্র দুর্নীতি ও আর্থিক অস্বচ্ছতার দলিল হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্টে আদানি গ্রুপের জালিয়াতিকে বলা হয় 'the largest con in corporate history '। একথা অস্বীকার করার কোন কারণ নেই যে সমস্ত কর্পোরেট মিডিয়া এই রিপোর্টকে যখন চেপে দিতে ও এই রিপোর্টকে ভারতের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের উপর আঘাত বলে প্রতিপন্ন করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে,তখন রাহুল গান্ধির ধারাবাহিক সক্রিয়তার কারণে এটা মূলধারার রাজনীতির অন্যতম অ্যাজেন্ডায় পরিণত হয়। এক বছরের ব্যবধানে হিন্ডেনবার্গের আরেকটি রিপোর্ট পরিষ্কার দেখায়, দেশে কর্পোরেট আর্থিক দুর্নীতির তদন্ত ও শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব যে সরকারি এজেন্সির হাতে অর্থাৎ 'সেবি'র ( সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া) চেয়ারম্যান মাধবী পুরি বুচ ও তার স্বামী স্বয়ং আদানি শেয়ার ঘোটালার (Adani money siphoning scandal) সঙ্গে যুক্ত। সেদিনও রাহুল গান্ধি প্রথম সেবি প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তের জন্য প্রথম জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি গঠনের দাবি তুলেছিলেন। আজ যখন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার আাদানিদের বহু বিজ্ঞাপিত পৃথিবীর বৃহত্তম সোলার এনার্জি পার্কের নামে ২৫০০ কোটি টাকার দুর্নীতির পর্দা ফাঁস করে দিয়েছে তখন রাহুল গান্ধি সাংবাদিক সম্মেলন করে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে গৌতম আদানি ও বাকি অভিযুক্তদের গ্রেফতারির দাবি তুলেছেন। গৌতম আদানি ও নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির অশুভ বাস্তুতন্ত্র (এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়)-কে প্রশ্ন করার সাহস রাহুল গান্ধি ধারাবাহিক ভাবে দেখিয়ে যাচ্ছেন যা তাকে আরো বেশি করে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে তুলেছে।
ভারতে সংসদীয় রাজনীতির যাত্রাপথ যদি আমরা লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাব বিভিন্ন বাঁক বদল যা দেশের রাজনৈতিক ভাষ্যে নানা রকমের সূদুর প্রসারী পরিবর্তন এনেছে। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি মুন্ডাকা উপনিষদের 'সত্যমেব জয়তে' উচ্চারণ করে যে প্রজাতন্ত্র যাত্রা শুরু করেছিল, তার প্রথম দুই দশক ছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বে দেশ গঠনের আখ্যান। ষাটের দশকের শেষভাগে সংসদীয় রাজনীতির আঙিনায় দু'টো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। প্রথমটি হল কংগ্রেসের মধ্যে ক্ষমতার দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব। প্রবীণ নেতৃত্বের সিন্ডিকেট বনাম নেহরু কন্যা ইন্দিরার লড়াই এতটাই জটিল ছিল যে তা প্রগতিশীল বামপন্থীদের ঘোল খাইয়ে দেয়। এই ক্ষমতার লড়াই অনেকের চোখে প্রগতি বনাম পশ্চাৎপদ সামন্ততন্ত্রের লড়াই বলে প্রতীয়মান হয়। দ্বিতীয়টি হল সারা ভারত জুড়ে বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে আঞ্চলিক রাজনীতির উত্থান। সত্তর দশকের মাঝপর্বে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি কর্তৃক জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং তার বিরুদ্ধে জয়প্রকাশ নারায়ণের অভিভাবকত্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই আরেক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল যা পরিণতি পায় জনতা দল গঠনের মধ্যে দিয়ে। সেই পরিবর্তন অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ভারতের সংসদীয় রাজনীতি আশির দশককে মনে রাখবে মন্ডল রাজনীতির জন্য। উচ্চবর্ণের আধিপত্যের বিরুদ্ধে দলিত ও ওবিসিদের উত্থান এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যার প্রভাব আজও নানান ভাবে নির্বাচনী রাজনীতিকে প্রভাবিত করে চলেছে। নব্বইয়ের দশককে আমরা মনে রেখেছি 'উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ-ভুবনায়নের' ব্যানারে আর্থিক সংস্কারের জন্য। মজার কথা হল সংস্কারের অনিবার্যতা ও দেশকে কর্পোরেট শক্তির কাছে উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল, নীতিপ্রণেতা ও মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার মধ্যে ঐক্যমত স্থাপিত হলেও তা তৃণমূল স্তরের রাজনীতিকে খুব একটা প্রভাবিত করেনি। বরং লালকৃষ্ণ আদবানীর নেতৃত্বে রথযাত্রা ও পরবর্তীতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস সংখ্যাগুরু হিন্দুত্বের রাজনীতিকে এক শক্তিশালী ভিত্তিতে স্থাপিত করে। পরবর্তী সময়ে প্রথমে গুজরাট মডেল এবং ২০১৪ সালে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদির রাজ্যাভিষেক সেই ভিত্তিকে ব্যবহার করে এক নতুন রাজনীতির জানান দেয়। হিন্দুত্ব ও নয়া উদারবাদের কর্পোরেট মডেল এক ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ফ্যাসিবাদী রাজনীতির জন্ম দেয় যা এখনো পর্যন্ত প্রবহমান রাজনীতির মূল ভাষ্য।
এই আগ্রাসী রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি জমি হারায় ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। এমনকী বিজেপি তাদের লক্ষ্য হিসাবে কংগ্রেস মুক্ত ভারতের কথা ঘোষণা করে। কংগ্রেস তুলনায় নরম হিন্দুত্ব ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির মেলবন্ধনে পরিস্থিতি সামলাতে যায় যা বাস্তবের মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। সর্বভারতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে যারা সামান্য হলেও ওয়াকিবহাল তারা জানেন, পুরনো লাইন ত্যাগ করে রাহুল গান্ধি এক নতুন রাজনীতি নির্মাণ করতে চাইছেন। এই ভাষ্যের মূল কথা হল সংবিধান নির্দেশিত সমতার ভারত, কর্পোরেট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জেহাদ, সমাজের প্রান্তিক মানুষদের লড়াইয়ে মৌখিক সমর্থন এবং অবশ্যই ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে সম্প্রীতির রাজধানী। ফলিত প্রয়োগে অনুদান ভিত্তিক ওয়েলফেয়ার পলিটিক্স, সমাজের প্রান্তিক মানুষদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য জাতগণনা ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো নিয়ে 'ভারত জোড়ো যাত্রা' অবশ্যই সাম্প্রতিক সময়ের সংসদীয় রাজনীতির এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এই রাজনীতিকে সূত্রায়িত করতে সম্প্রতি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় রাহুল গান্ধি এক নিবন্ধ লিখেছেন ( Match fixing monopoly vs fairplay business -- time to choose freedom over fear/ nov-6, 2024)। যা আমার মতে, আর্বান নকশাল সংক্রান্ত বিতর্ককে আরও অর্থবহ করে তুলেছে।
এই নিবন্ধ মোতাবেক ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষণ-শাসনের অবসান আগে হলেও আজ এখানে নতুন অবতারে (পড়ুন আদানি ও আম্বানি গোষ্ঠী) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হয়েছে। আজ একচেটিয়া আগ্রাসনের ধ্বজাধারী গুটিকয়েক কোম্পানি আমাদের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা, আমলাতান্ত্রিক কাঠামো, তথ্য সংযোগ ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দখল নিয়েছে। আজ আবার আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছি, তবে তা কোন বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে নয়, কতগুলো একচেটিয়া কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কাছে। আজকের ভারত রাহুলের কথায়, "A new breed of monopolists has taken its place, amassing colossal wealth, even India has become for more unequal and unfair for everybody else… Our institutions no longer belong to our people, they do the bidding of monopolists. Lakhs of business have been decimated and India is unable to generate jobs for her youth"। এই একচেটিয়া কর্পোরেট সংস্থাগুলো আজ ঠিক করছে আম আদমি কী খাবে, কী পড়বে, কী দেখবে, কেমন করে চিন্তা করবে! এই কর্পোরেট হাঙরদের বিপ্রতীপে রাহুল গান্ধি ভরসা রাখছেন বিভিন্ন ছোট ছোট দেশীয় বাণিজ্য গোষ্ঠীগুলির উপর। এই নতুন ভারতে রাহুল গান্ধি নিজেকে দুর্বল ও প্রান্তিক মানুষদের বন্ধু হিসাবে প্রতিপন্ন করতে চাইছেন। তাই কোনওরকম লুকোছাপা না করে নিয়মগিরির আদিবাসী মানুষদের প্রকৃতি বাঁচানোর লড়াই, তিন কৃষক বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে রাস্তার লড়াইয়ে বা দাঙ্গা-বিধ্বস্ত মণিপুরের সব হারানো মানুষের তিনি সমব্যাথী। এই রাজনৈতিক ভাবনা অবশ্যই নতুন এবং বিজেপির মতে এটা আদতে আর্বান নকশালদের দর্শন।
রাহুল গান্ধির এই রাজনৈতিক ভাষ্য এখনো পর্যন্ত কাঙ্খিত সাফল্য না দিতে পারলেও এর সম্ভাবনা অসীম। নির্বাচনী ময়দানে এই রাজনীতির টার্গেট অডিয়েন্স দলিত, মহাদলিত, আদিবাসী, ওবিসি, সংখ্যালঘু ও নারী শক্তির এক মহাজোট বন্ধন যা অবশ্যই বিজেপির সংখ্যাগুরু হিন্দু রাষ্ট্রের ও একচেটিয়া কর্পোরেট গোষ্ঠীর মেলবন্ধনের বিরুদ্ধে এক রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধা। এই ফর্মুলা সফল হলে সংখ্যা তত্ত্বের বিচারে কংগ্রেস শুধু এগিয়েই যাবে না, একই সঙ্গে কংগ্রেস সংসদীয় বাম এবং সামাজিক ন্যায়ের সওয়াল করা রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাভাবিক মিত্রে পরিণত হবে। তবে বিষয়টা বক্তৃতা ও সংবাদপত্রের নিবন্ধে লেখা যতটা সহজ, বাস্তবে তা কার্যকরী করা ততটা সহজ নয়। প্রথমত, নব্বইয়ের দশকে যে নয়া অর্থনীতির আগ্রাসন শুরু হয়, তার ভগীরথ ছিল কংগ্রেস এবং তারাই দেশের জল-জঙ্গল-জমি রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ভারত রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার পক্ষে প্রধান বিপদ হিসাবে চিহ্নিত করে। দ্বিতীয়ত, কংগ্রেসের সাংগঠনিক কাঠামো ও শ্রেণি ভিত্তিতে এখনো পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রাধান্য। তৃতীয়ত, রাহুল গান্ধি কংগ্রেসের নেতৃত্বে আসার পরে যে সমস্ত রাজ্যে কংগ্রেস শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগঢ়, রাজস্থান বা সাম্প্রতিক তেলেঙ্গানায় সরকারের যাপিত নীতিতে রাহুল গান্ধির মতাদর্শের কোনও বাস্তব প্রতিফলন ঘটেনি। এত কিছু সত্ত্বেও এই রাজনীতির ভাষ্য বিজেপির কাছে নিশ্চিত ভাবে এক বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্বজুড়ে আর্থিক সংকট যত তীব্র হবে, কর্মসংস্থান যত কমবে, তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের ক্ষমতায়নের দাবি যত স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করবে, তত এই রাজনীতি বিজেপির পক্ষে বিপদের কারণ হবে।
আরও পড়ুন:‘নেতা নয়, কংগ্রেস দল চালাচ্ছে আরবান নকশালেরা’- কেন বলছেন মোদি?
সংসদীয় রাজনীতির পাটিগণিতের বাইরে আরও কিছু কথা থেকে যায়। বিজেপি রাহুল গান্ধিকে আর্বান নকশাল বলে দেগে দিয়ে আসলে আর্বান নকশালদের ওঠানো রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোকে এক ধরণের বৈধতা দিতে বাধ্য হল। যতই সরকারের পক্ষ থেকে তাদের দেশবিরোধী শক্তি আখ্যা দিক না কেন, উন্নয়নের বিকল্প ভাষ্য, সমতার রাজনীতি ও ন্যায় সমাজের ভাবনা, যা আর্বান নকশালরা দীর্ঘ সময় ধরে তুলছেন তা অস্বীকার করে ভারতের রাজনীতি এগোতে পারবে না। এই বিতর্কের লাভ এটাই।