এক তপস্বীর কৃচ্ছসাধন কাহিনি
Narendra Modi at Ram Mandir : কনকনে শীতে প্রধানমন্ত্রী অযোধ্যার সরযূ নদীর তীরে ধ্যান করেছেন। এত কৃচ্ছসাধন কীসের জন্য? রাম না ভোট?
তিনি প্রধানমন্ত্রী, না কি তিনি উপাসক! তিনি মানুষের সেবক না কি ঈশ্বরের? মানুষের মোদি, না মন্দিরের? একটি ইতিহাস কাঁপানো রামমন্দির দেখল ভারত। ২০২৪ সালের পাখির চোখে মোক্ষম তিরটি মেরেছেন নরেন্দ্র মোদি। তির মারার আগে প্রস্তুত হয়েছেন, বহু বছর ধরে। ১৯৯২ সালে বাবরি ধ্বংস হওয়া থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি রামের জন্মভূমি বলে 'প্রমাণ' করে দেওয়া অযোধ্যায় রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা, কঠোর রাজনৈতিক শৃঙ্খলায় চলেছে সবটা। জনগণের কাছে রাম নন, খোদ নিজেই যেন হয়ে উঠেছেন অবতার! কেন দেবতাকে হাতিয়ার করতে হলো ভোট জিততে? না কি এই নিষ্ঠাপালন, এই মন্দির দেখে বিহ্বলতা মোদির নিজেরই অন্তরের?
নরেন্দ্র মোদির রাম মন্দিরের এই বিশেষ ক্ষণের আগে ১১ দিন উপবাস করেছেন। মেনে চলেছেন কঠোর আচার-অনুষ্ঠান। টানা ১১ দিন, এই শীতের কালে মেঝেতে ঘুমিয়েছেন মোদির। নুন খাননি এক ফোঁটাও। ডাবের জল খেয়েছেন। রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠার পুজোয় বসেছিলেন যে যে পুরোহিতরা, তাঁদের মতে অযোধ্যার রাম মন্দিরে অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন মোদি।
১২ জানুয়ারি থেকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত ১১ দিনের উপবাসের সময় প্রধানমন্ত্রী মোদি ৪০টি নিয়ম মেনে চলেছিলেন৷ শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থের স্বামী গোবিন্দ দেব গিরি মহারাজের মতে, আচার অনুষ্ঠানের অংশ হিসাবেই প্রধানমন্ত্রী মোদি এই সময়ে কোনও বিদেশ ভ্রমণ করতে পারেননি, তবে দেশের ধর্মীয় স্থানগুলি ঘুরেছেন।
আরও পড়ুন- কেন দক্ষিণ ভারতীয় প্রতিমার ছাঁচে গড়া রামলালার মূর্তি?
ডাবের জল খেয়ে প্রধানমন্ত্রী উপোস পালন করেছেন। বলা হয়েছিল দিন তিনেক এইসব আচার পালন করলেই হবে। কিন্তু মোদি অটল! তিনি ১১ দিনের নিয়মই মানবেন। রাম মন্দিরের শিশু রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠার আগে তাই দেশবাসীকে নিজের কড়া সাধনার ছবি দেখিয়েছেন তিনি।
পণ্ডিত সদানন্দ পাঠকের মতে, প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর এই একাদশ দিনের উপবাসের সময় সমস্ত এক ফোঁটা নুনও ছুঁয়ে দেখেননি। সৈন্ধব লবণ খাওয়া যেত ঠিকই, ফলমূলও খাওয়া যেত। কিন্তু মোদি বলেছেন, কেবল ডাবের জল! এই মাঘের শীতে বিছানায় নয় মেঝেতে শুয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। আচার অনুযায়ী, বিছানায় ঘুমানো বা বসা নিষেধ। পাশাপাশি গো সেবা করেছেন তিনি। গরুদের খাইয়েছেন। ঈশ্বরের কাছে ভোগ নিবেদন করার পর নৈবেদ্য নিয়েছেন। এই ১১ দিন দাড়ি কামানো এবং নখ কাটাও রীতি অনুযায়ী নিষিদ্ধ ছিল। কনকনে শীতে প্রধানমন্ত্রী অযোধ্যার সরযূ নদীর তীরে ধ্যান করেছেন। এত কৃচ্ছসাধন কীসের জন্য? রাম না ভোট?
তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিজেপির মুখ। দেশের মানুষের অর্ধেক আস্থা জিতে বসেই আছেন। এর পরেও এমন সনাতনী ঋষির আচরণ তাঁকে কেন করতে হচ্ছে?
তড়িঘড়ি অসমাপ্ত রাম মন্দিরে বিগ্রহের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সরসংঘচালক মোহন ভাগবত ও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ- এরা কী প্রমাণ করতে চাইলেন? প্রধানমন্ত্রীকে 'মহাপুরুষ' বলেছেন গোবিন্দ গিরি দেব। বলেছেন, এমন সাত্ত্বিক রাষ্ট্রনেতা পাওয়া দেশের সৌভাগ্য! একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে 'সাত্ত্বিক' প্রধানমন্ত্রীর দরকারই বা পড়ছে কেন? যোগী আদিত্যনাথ বলছেন, অযোধ্যা বিশ্বের সাংস্কৃতিক রাজধানী হতে চলেছে। রামমন্দিরই ভারতের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ ঘটাবে। মন্দির কীভাবে কোনও দেশের ‘সংস্কৃতি’ নির্ধারণ করতে পারে? তাও ভারতের মতো এমন বিচিত্র ভাষা, পোশাক, খাদ্য, জীবনের দেশে?
আরও পড়ুন- ২২ জানুয়ারিই বজরং দলের হাতে হত্যা হয় পাদ্রীর! প্রাণ প্রতিষ্ঠার আড়ালে হারাচ্ছে যে ঘটনার স্মৃতি
সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের চেয়েও কি তবে রামমন্দির বেশি কার্যকরী? ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নিজেকেই তাই 'অবতার', ‘মহাপুরুষ' করে তুলতে হচ্ছে তাঁকে? অরি রামভক্তি কীসের লক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা গলাদের থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধর্মীয় স্লোগানে।
মোদি তো বলেই দিয়েছেন, রামের রূপে এ রাষ্ট্রচেতনার মন্দির। রামই ভারতের চেতনা, রামই ভারতের বিধান, রামই নীতি, রামই নিত্যতা, রামই জ্ঞাপক, রামই বিশ্ব, রামই বিশ্বাত্মা। ভারতবর্ষ অর্থাৎ রাম- এই যদি প্রমাণের চেষ্টা হয় তাহলে বলা বাহুল্য সাংবিধানিক কোনও নীতি, কোনও মৌলিক অধিকার ইত্যাদির প্রশ্ন সেখানে খাটেই না। বিজেপি এমন হিন্দুরাষ্ট্রই চেয়েছিল। রামই দেশের চালক, মোদি খানিক পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পেয়েছেন। রামেরই রাজ্য শাসন করছেন একজম যার ইতিহাসে রয়েছে গুজরাতের ভয়াবহ দাঙ্গার ঘটনা। শিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য নয়, চাকরি নয়। কেবল রামকে ধরিয়ে দিলেন তিনি ১৪০ কোটির হাতে। ধর্মনিরপেক্ষতা নেই, গণতান্ত্রিক দেশে নেতা না হয়ে সাত্ত্বিক প্রধানমন্ত্রী, অবতার প্রধানমন্ত্রী হতে হচ্ছে একজনকে! জনতার রাজা তিনি, রাজ্য তারই! কিন্তু প্রশ্ন তবু উঁকি দেয়, অতিভক্তি কীসের যেন লক্ষণ!