ছিলেন কংগ্রেসের স্তম্ভ, তাও কেন আরএসএসের সভায় গিয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়?
Pranab Mukherjee on RSS : ১৯৮৬ সালের জানুয়ারিতে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং কয়েক মাস পরে কংগ্রেস থেকেও বহিষ্কার করা হয়।
দক্ষ ছিলেন, ছিলেন বিচক্ষণ, দূরদর্শীও। তবু রাজীব গান্ধির মন্ত্রিসভায় ছিলেন না তিনি। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায় বাবার ডায়রির নানা কথা তুলে ধরেছেন সাম্প্রতিক কালে। শর্মিষ্ঠা জানাচ্ছেন, তাঁর বাবা রাজীব গান্ধির মন্ত্রিসভায় ডাক পাননি কারণ 'আজ্ঞাবহ' মনোভাব ছিল না তাঁর। নিজের লেখা একটি বই প্রকাশ করেছেন শর্মিষ্ঠা। "প্রণব মাই ফাদার: আ ডটার রিমেম্বারস"। বইটির প্রকাশ অনুষ্ঠানে তাঁর বাবা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক আলো-আঁধারি, বিতর্কের কথাগুলি স্বাভাবিকভাবেই উঠে এসেছে। শর্মিষ্ঠার বক্তব্য, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে যতদিন কাজ করেছেন, সেই সময়কালই ছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনের 'সুবর্ণ সময়', এমনটাই মনে করতেন তাঁর বাবাও। এই বইটি বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যুকে আরও কঠিন এক সময়ে কংগ্রেসের সামনে এনে খাড়া করেছে। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ডায়রি থেকে নেওয়া হয়েছে অনেক লেখার অংশ, অনেক মন্তব্য। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি সম্পর্কে কী মূল্যায়ন ছিল প্রণবের, তাও প্রকাশ্যে এসেছে, তর্ক শুরু হয়েছে কেন তিনি আরএসএসের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছিলেন?
শর্মিষ্ঠা বলছেন, সংসদে একটি অর্ডিন্যান্স আনা হয়েছিল। সেই প্রস্তাবিত অর্ডিন্যান্সে বলা হয়েছিল, কোনও বিধায়ক যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাঁদের সুপ্রিম কোর্ট অবিলম্বে অযোগ্য ঘোষণা না করে উচ্চ আদালতে আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সদস্য হিসাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারেন তারা। এই অর্ডিন্যান্সের অনুলিপি রাহুল গান্ধি ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় মনে করেছিলেন, সংসদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা উচিত ছিল। এই আচরণে অত্যন্ত রেগে গেছিলেন প্রণব।
আরও পড়ুন- অর্থমন্ত্রীর চেয়ারে বসে ব্যাঙ্ক লোনের ফোন পেয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়
শর্মিষ্ঠা বলছেন, দেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে তাঁর বাবা এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি দল হিসাবে কাজ করেছিলেন। তাহলে কি রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে বিরোধীদের সঙ্গে কোনও প্রভেদ ছিল না প্রণবের? সেই কারণেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের আমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলেন তিনি? শর্মিষ্ঠা বলছেন, বাবার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিন থেকে চার দিন বাদানুবাদ হয়েছিল তাঁদের। তাঁর বাবা মনে করেছিলেন, গণতন্ত্র মানেই কথা বলার জায়গা, বিরোধীদের সঙ্গে কথোপকথন। প্রণবের বক্তব্য ছিল, কংগ্রেস দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এই সংসদীয় গণতন্ত্রকে বজায় রাখার কাজটিও দলের উপরেই ন্যস্ত। গণতন্ত্র সংকীর্ণ নয়, বরং সেখানে সকলের মতামতের গুরুত্ব আছে। আরএসএস-ও সমানভাবে গুরুত্ব রাখে দেশে, রাজনীতিতে এবং বিরোধিতাতেও।
দলের বরিষ্ঠ নেতারা কী মনে করছেন এই 'অজানা' প্রণবকে নিয়ে? দলের নেতা পৃথ্বীরাজ চভন জানিয়েছেন, বই না পড়ে তিনি মন্তব্য করতে পারবেন না। শুধুমাত্র চিদম্বরমই এসেছিলেন কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে, তিনি সার্বিক ঘটনায় ব্যথা পেয়েছেন।
ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শর্মিষ্ঠা জানান, ইন্দিরা সবসময়ই খেলায় রাখতেন প্রণবের। কংগ্রেসের মধ্যে যদি এমন একজন কেউও থাকেন যার প্রতি তাঁর বাবার আনুগত্য ছিল লক্ষণীয়, তিনি একমাত্র ইন্দিরা গান্ধি। এই নিবিড় বিশ্বাসের সম্পর্ক জরুরি অবস্থার পরেই শুরু হয়েছিল। সমস্ত পরিস্থিতিতে ইন্দিরার পাশে ছিলেন প্রণব। সেই সময়ে অনেকেই ইন্দিরাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রণব ছিলেন অবিচল।
আরও পড়ুন- উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাস দমনের, অপারেশন ব্লু স্টারই ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয়?
"ইন্দিরা একটি ভুল করেছিলেন এবং তিনি তা বুঝতেও পেরেছিলেন। আমার যদি সেই রাজনৈতিক পরিপক্কতা থাকত, তাহলে জেপি এবং ইন্দিরা গান্ধির মধ্যে একটি রাজনৈতিক বৈঠক পরিচালনা করা যেত...," জরুরি অবস্থার সময় নিজের ডায়রিতে উল্লেখ করেছিলেন প্রণব। শর্মিষ্ঠা বলছেন, অনেকেই গল্প তৈরি করেছিলেন যে তাঁর বাবা আসলে রাজীব গান্ধির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সপক্ষে ছিলেন না। আসলে রাজীব গান্ধি এবং প্রণবের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করার জন্যই পুরোটি তৈরি।
১৯৮৬ সালের জানুয়ারিতে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং কয়েক মাস পরে কংগ্রেস থেকেও বহিষ্কার করা হয়। এই বিষয়টি প্রণবকে দুর্বল করেছিল, আঘাত পেয়েছিলেন স্বাভাবিকভাবেই। রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেসও গঠন করেছিলেন প্রণব কিন্তু পরে কংগ্রেসেই ফিরে আসেন। পরবর্তীকালে মনমোহন সিং এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মধ্যেও দৃঢ় পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।