কেন রাজপথে গুলি জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে? প্রকাশ্যে এল আসল কারণ

পদে থাকাকালীন জাপানের নিরাপত্তার দিকে গুরত্ব দিয়েছিলেন আবে। তাঁর বিদেশনীতি জাপানের যুদ্ধবিরোধী সংবিধানকেই আরও পুষ্ট করেছিল। এছাড়া ‘আবেনমিক্স’-এর জন্যও বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছিলেন।

 

যে বন্দুক নিয়ে জাপানে এত সতর্কতা, সেই বন্দুকই কেড়ে নিল শিনজো আবের প্রাণ। ৮ জুলাই জাপানের নারা শহরের রাস্তায় প্রকাশ্যে দু'-দু'বার গুলি করা হয় তাঁকে। হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান জাপানের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী। নিরাপত্তারক্ষীরা আততায়ীকে আটক করে ঘটনাস্থলেই। বর্তমানে পুলিশের হেফাজতে সে। আততায়ীর নাম তেতসুয়া ইয়ামাগামি। বয়স একচল্লিশ। পুলিশের কাছে সে গুলি চালানোর কথা স্বীকার করে নিয়েছে। জানিয়েছে, তার বন্দুকটি ঘরে বানানো। পুলিশ জানিয়েছে, একটি ‘বিশেষ দল’-এর প্রতি তার রাগ ছিল। সেই কারণেই এই হত্যা।

প্রেস কনফারেন্সে পুলিশ জানায় এমন আরও অনেক হাতে বানানো বন্দুক আততায়ীর ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এমনকী, তার ঘর থেকে বিস্ফোরকও পাওয়া গিয়েছে। পুলিশ ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের আপাতত সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে অন্যত্র। আততায়ীর জবানিতে এই ‘বিশেষ সংগঠন’-টির সঙ্গে ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রীর যোগসাজশ ছিল। কেন সেই ‘বিশেষ সংগঠন’-এর বাকি সদস্যদের ছেড়ে শিনজো আবেকেই বেছে নিল আততায়ী— তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। জাপানের এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ইয়ামাগামি আবেকে খুন করার উদ্দেশ্য নিয়েই গুলি চালিয়েছিল কি? ইয়ামাগামি শুধুমাত্র গুলি চালানোর কথাই স্বীকার করেছে, বাকিটা তদন্তসাপেক্ষ– উত্তরে জানিয়েছে পুলিশ। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা এই আক্রমণের কড়া নিন্দা করে বলেন, “এই আক্রমণ বর্বরোচিত এবং ঘৃণ্য। এ বরদাস্ত করা হবে না। নির্বাচন আমাদের গণতন্ত্রের বুনিয়াদ। নির্বাচনের সময় এমন হিংসাত্মক ঘটনা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।”

আবে-র গলার পাশে দু'টি বুলেটের ক্ষত পাওয়া গিয়েছিল। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, হৃদযন্ত্রও জখম হয়েছিল তাঁর। আহত অবস্থাতেও জ্ঞান ছিল। কিন্তু ৬৭ বছর বয়স। অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, হাসপাতালে নিয়ে আসার সময়েই কোনও সাড় পাওয়া যাচ্ছিল না। চিকিৎসাধীন অবস্থায় চার ঘণ্টা ধরে ১০০ ইউনিট রক্ত দেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু তাতেও কোনও ফল হয় না। অবশেষে বিকেল পাঁচটা বেজে তিন মিনিটে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

আরও পড়ুন: প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে! ফিরছে ইন্দিরা হত্যার স্মৃতি

৮ জুলাই টোকিও থেকে তিনশো মাইল দূরে, নারার দক্ষিণাঞ্চলের শহরে নির্বাচনী প্রার্থী সাতোর সমর্থনে ভাষণ দিচ্ছিলেন আবে। সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ ঘটনাটা ঘটে। অনেকেই দেখেছে, পিছন থেকে একটি বড় বন্দুক তুলে দু'বার গুলি ছোঁড়েন আততায়ী। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আবে। ভয়ে, আতঙ্কে প্রচণ্ড চেঁচামেচি শুরু হয়। আবের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ছিল। তা সত্ত্বেও কী করে ইয়ামাগামী তাঁর কয়েক মিটারের মধ্যে পৌঁছল, ভাবার বিষয়। কারওরই নজরে এল না?

ঘটনার পরে পরে আন্তর্জালে যে সমস্ত ছবি ঘুরছে, তাতে স্পষ্ট আততায়ী আবের ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। গুলি করার পর আততায়ী পালানোর কোনও চেষ্টাই করেনি। নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে আটক করে। অস্ত্রটিকেও বাজেয়াপ্ত করা হয়। স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, ইয়ামাগামি জাপানের মেরিটাইম সেলফ ডিফেন্স ফোর্সের প্রাক্তন সদস্য। ভারতের নেভি যেমন, তেমনই জাপানের মেরিটাইম। ২০০৫ সালে ইয়ামাগামি অবসর নেন। এই সপ্তাহেই জাপানের উচ্চকক্ষের নির্বাচন। লিবারাল ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়েই নির্বাচনী প্রচারের ভাষণ দিচ্ছিলেন আবে। গোটা দেশের মন্ত্রীদের পত্রপাঠ টোকিও ফেরার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। জাপানের সামাজিক মাধ্যমে 'হিংসা নয়, আমরা গণতন্ত্র চাই' হ্যাশট্যাগটি ট্রেন্ডিং ছিল। বহু মানুষই সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিচ্ছিলেন।

আবে জাপানে দীর্ঘতম প্রধানমন্ত্রিত্বের নজির গড়েছিলেন। ২০০৬ সালে বছরখানেক, ফের ২০১২ থেকে ২০২০ অবধি টানা এই পদে আসীন ছিলেন তিনি। ২০২০ সালে স্বাস্থ্যভঙ্গর কারণে পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। পরে জানিয়েছিলেন, আলসেরাটিভ কোলিটিসে ভুগছেন। পদে থাকাকালীন জাপানের নিরাপত্তার দিকে গুরত্ব দিয়েছিলেন আবে। তাঁর বিদেশনীতি জাপানের যুদ্ধবিরোধী সংবিধানকেই আরও পুষ্ট করেছিল। এছাড়া ‘আবেনমিক্স’-এর জন্যও বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছিলেন। আবের পরে প্রধানমন্ত্রী হন ইয়োশিহিদে সুগা, পরে ফুমিও কিশিদা নির্বাচিত হন।

জাপানের বন্দুকের অপব্যবহার হয় না বললেই চলে। হ্যান্ডগান নিষিদ্ধ জাপানে। আর রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা তো শোনাই যায় না। একটা পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। ২০১৪ সালে জাপানে বন্দুকের অপব্যবহারে মারা গিয়েছিল মাত্র ছ'জন, সে বছর আমেরিকাতে মারা গিয়েছিল ৩৩,৫৯৯ জন। জাপানে বন্দুকের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য কঠিন পরীক্ষা পাশ করতে হয়। তারপর মানসিক স্বাস্থ্যের পরীক্ষা। এতসব বিধিনিষেধের পরেও শুধুমাত্র শটগান এবং রাইফেল কেনার অনুমতি পাওয়া যায়।

ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন-সহ পৃথিবীর নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এই আক্রমণের নিন্দা করেছেন। জাপানের আমেরিকান অ্যাম্বাসাডর রেহ্‌ম এমানুয়েল বলেছেন, আবে 'একজন অসাধারণ নেতা', পাশাপাশি আমেরিকার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বন্ধুভাবাপন্ন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইয়ল এই ঘটনাকে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলেছেন। আবে-র মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে তিনি বলেন, "জাপান এক শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদকে হারাল।" চিনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জাও লিজিয়ান বলেন, গোটা চিন এই ঘটনায় স্তম্ভিত। তিনি বলেন, "এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে চিন-জাপান সম্পর্কের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার কোনও মানে হয় না।" যদিও চিনের সামাজিক মাধ্যমে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনও মন্তব্য করননি তিনি। চিনের সামাজিক মাধ্যমে এই খুন বিস্তর প্রশংসা কুড়োচ্ছে, কোরিয়ার সমাজমাধ্যমেও এমনটা দেখা গিয়েছে। চিন এবং দক্ষিণ কোরিয়া- উভয়ের সঙ্গেই জাপানের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই কিঞ্চিৎ জটিল। আবে-কে এই দুই দেশের মানুষই অপছন্দ করতেন তাঁর সামরিক ঝোঁকের জন্য।

 

More Articles