নয়াদিল্লি স্টেশনে পদপিষ্ট হওয়ার ভিডিও সরাতে হবে! কেন এমন নির্দেশ রেলের?
Videos of New Delhi Rail Station Stampede: স্টেশনে প্রবল ভিড়ে মর্মান্তিক সেই ঘটনায় হতাহতদের ভিডিও সম্বলিত ২৮৫টি সোশ্যাল মিডিয়া লিঙ্ক সমাজমাধ্যম থেকে সরানোর জন্য X (আগেকার টুইটারকে) নির্দেশ দিয়েছে রেলমন্ত্রক।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লি রেলওয়ে স্টেশন পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনায় প্রাণ হারান কমপক্ষে ১৮ জন মানুষ। ঘটনায় কুম্ভমেলাগামী ভক্তস্রোত সামলাতে ব্যর্থ হওয়া রেল প্রশাসনের গাফিলতির চিত্রই উঠে এসেছিল। দু'টি প্রয়াগরাজগামী ট্রেনের ঘোষণা নিয়ে বিভ্রান্তির কারণে নয়াদিল্লি রেল স্টেশনের ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মের কাছে এই পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনাটি ঘটেছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে জানা যায়, মৃত ১৮ জনের মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে শ্বাসরোধের কারণে, যা বুকে প্রচণ্ড চাপের কারণে ঘটেছিল। রক্তক্ষরণজনিত শকে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে, যা বুকে গুরুতর আঘাতের কারণে ঘটেছে। এসময় মাথায় প্রচণ্ড চাপের কারণে একজনের মৃত্যু হয়।
স্টেশনে প্রবল ভিড়ে মর্মান্তিক সেই ঘটনায় হতাহতদের ভিডিও সম্বলিত ২৮৫টি সোশ্যাল মিডিয়া লিঙ্ক সমাজমাধ্যম থেকে সরানোর জন্য X (আগেকার টুইটারকে) নির্দেশ দিয়েছে রেলমন্ত্রক। রেল মন্ত্রক বলছে এই ভিডিওগুলি 'নৈতিক নিয়ম' মেনে পোস্ট করা হয়নি। X-এর নিজস্ব কনটেন্ট নীতির উল্লেখ করে মন্ত্রক গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে জানিয়েছে, ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ওই ভিডিও সরিয়ে নিতে হবে।
মন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা আছে, "এটি শুধুমাত্র নৈতিক নিয়মের পরিপন্থী নয়, x.com-এর বিষয়বস্তু নীতিবিরুদ্ধও। এই ধরনের ভিডিও শেয়ার করা অযৌক্তিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, আজকাল "ট্রেনের প্রচণ্ড ভিড়" হচ্ছে, এই ধরনের ভিডিও "ভারতীয় রেলওয়ের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে"।
হিন্দুস্তান টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "মৃত ব্যক্তিদের ছবি আছে এমন সংবেদনশীল বা অস্বস্তিকর" ভিডিও সম্পর্কে উদ্বেগ উল্লেখ করে বিশিষ্ট সংবাদমাধ্যমের নেটওয়ার্ক সহ একাধিক অ্যাকাউন্ট থেকে টুইটগুলি সরাতে X-কে ৩৬ ঘণ্টা সময় দিয়েছিল রেল। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এই ক্ষমতা প্রয়োগ করল রেল। গত জানুয়ারিতে ইউটিউব এবং ইনস্টাগ্রামকে এমনই একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। "বিভ্রান্তিকর এবং সংবেদনশীল/উস্কানিমূলক তথ্য" সম্বলিত বিষয়বস্তু যা "অনাকাঙ্খিত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে," তা সরিয়ে নিতে বলা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে একটি ইউটিউব ভিডিও, একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্ট এবং দুটি ইনস্টাগ্রাম রিলকে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে ওই নোটিশটি কোনও নির্দিষ্ট ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত কিনা তা স্পষ্ট করা হয়নি।
আরও পড়ুন- মানুষের বিষ্ঠায় দূষিত সঙ্গম! কুম্ভে স্নান ডেকে আনতে পারে যে বিপজ্জনক রোগগুলি
X-এর নীতি অনুসারে, 'গ্রাফিক মিডিয়া' তখনই সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করা যেতে পারে যদি তাতে হিংসা, রক্তপাত বিশেষভাবে প্রদর্শিত না হয় এবং হিংসাকে কোনওভাবেই গর্ব করে প্রচার না করাআ হয়। এছাড়াও মৃত্যুতে 'মর্যাদা এবং গোপনীয়তা' প্রদান এবং জনগণের তথ্য গোপনীয়তা রক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার কথাও নীতিতে উল্লিখিত আছে, বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক বা সংবাদযোগ্য ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে।
To uphold the dignity of victims, especially women, only sensitive content and Disturbing images were requested for removal. Such content caused distress to families.
— Spokesperson Railways (@SpokespersonIR) February 21, 2025
Please refrain from spreading fake news. pic.twitter.com/Q63J9zMxLk
রেল মন্ত্রক ওই বিজ্ঞপ্তি জারির পরে স্বীকার করে যে মন্ত্রক X-কে পদপিষ্ট হওয়ার সমস্ত ভিডিওগুলি সরিয়ে নিতে বলেছিল। রেলের মুখপাত্র, X-এ একটি পোস্টে জানান, "ভুক্তভোগীদের, বিশেষ করে মহিলাদের মর্যাদা ও শ্লীলতা বজায় রাখতে" নাকি সংবেদনশীল বিষয়বস্তু এবং অস্বস্তিকর ছবি সরাতে অনুরোধ করেছে রেল। রেলের দাবি, পদপিষ্ট হওয়া মানুষদের পরিবারের সদস্যরা মন্ত্রককে এই অনুরোধ করার পরেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কারণ এই জাতীয় ছবি এবং ভিডিওগুলি মৃতদের প্রতি অসম্মানজনক এবং তাঁদের আত্মীয়দের জন্য খুব অস্বস্তিকর, যন্ত্রণার।
উল্লেখ্য, গত ডিসেম্বরে রেল মন্ত্রক তথ্য প্রযুক্তি আইনের ধারা ৭৯(৩)(বি)-এর অধীনে সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি থেকে বিষয়বস্তু সরানোর বিজ্ঞপ্তি জারি করার জন্য তার তথ্য ও প্রচারের নির্বাহী পরিচালককে (রেলওয়ে বোর্ড) ক্ষমতা দেয়৷ আগে, এই ধরনের অনুরোধ বা নির্দেশ জারি করতে পারত আইটি মন্ত্রক, ধারা ৬৯এ-এর ব্লকিং কমিটির মাধ্যমে।
১৭ ফেব্রুয়ারির বিজ্ঞপ্তিতে রেল মন্ত্রক বলেছে, "বেআইনি বিজ্ঞাপন, অনুমোদন, প্রচারমূলক পোস্ট যেখানে প্রকাশিত হয় সেই সমস্ত URL, অ্যাকাউন্ট, ইত্যাদি থেকে বিষয়বস্তু অপসারণ/মুছে দেওয়ার জন্য" নোটিশ জারি করার ধারার ক্ষমতা রেল সংশ্লিষ্ট আইনেই পেয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, যদি সংস্থা সরকারের অবহিত করার পরেও ওই ভিডিও বা পোস্ট বা ছবি অপসারণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই কোনও সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটি নিরাপদ আশ্রয় সুরক্ষা (তৃতীয় পক্ষের বিষয়বস্তুর জন্য দায়ী হওয়া থেকে সুরক্ষা) পাবে না।
বিজ্ঞপ্তিতে তথ্য প্রযুক্তি (ইন্টারমিডিয়েরি গাইডলাইনস এবং ডিজিটাল মিডিয়া এথিক্স কোড) বিধিমালা, ২০২১-এর বিধি ৩(১)(ডি) উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিধি অনুযায়ী বিষয়টি জানার পাওয়ার পরে অর্থাৎ হয় আদালতের আদেশ বা অনুমোদিত সংস্থা দ্বারা জারি করা বিজ্ঞপ্তির আকারে তা গোচরে আসার পরে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অবশ্যই ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে অবৈধ বিষয়বস্তু সরিয়ে ফেলতে হবে। এতে আইটি বিধিমালার ৭ নম্বর বিধির উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এই নিয়মগুলি অনুসরণ না করলে সংস্থা 'নিরাপদ আশ্রয়' হারাতে পারে।
আরও পড়ুন- ‘১৪৪ বছর’ আসলে রাজনৈতিক প্রচার! এবারের মহাকুম্ভ সত্যিই বিরল?
রেল মন্ত্রকের অন্দরের খবর, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কোনও পোস্ট সরাসরি সরিয়ে নিতে বলার ক্ষমতা দেওয়ার লক্ষ্য হচ্ছে, রেললাইনে বিপজ্জনক স্টান্টের ভিডিও, রেলের সম্পত্তি ভাঙচুর এবং ভারতীয় রেল সম্পর্কে ভুল তথ্য সহ একাধিক সমস্যার সমাধান করা। রেল সূত্রে জানা যাচ্ছে, এমন অনেক ভিডিও আছে যেখানে যুবক যুবতীরা রিল তৈরি করে ভিউ পেতে, রেললাইনের উপর বিপজ্জনক স্টান্ট করে, শুয়ে পড়ে। লোকজন রেললাইনের, রেলের নানা ক্ষতি করে, আগুন ধরিয়ে দেয় এবং সেই ঘটনার আবার জাতীয় ভিডিও আপলোড করে। সেই ভিডিও দেখে যাতে আবার কেউ অনুপ্রাণিত না হয়ে যায় তাই এই ধরনের ভিডিওগুলি সরানো দরকার বলে মনে করছে রেল।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে বিহারে একটি ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আরেকটি ট্রেনে ভাংচুর করা হয়েছিল, নেপথ্যে ছিলেন রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের পরীক্ষায় অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত প্রার্থীরা। তারপরেই রেল মন্ত্রকের অনুরোধে, আইটি মন্ত্রক জনশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের বিরুদ্ধে ধারা ৬৯এ-এর অধীনে আদেশ জারি করে।
এখানে প্রশ্ন উঠছে, মৃতদের মুখ দেখা যাচ্ছে বা যেগুলি খুবই অস্বস্তি ও যন্ত্রণার সেই ভিডিও বাদে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ও অব্যবস্থাপনার চিত্র উঠে এসেছে এমন ভিডিও-ও তো ওই ২৮৫ টি লিঙ্কের মধ্যে আছে। রেল সেই লিঙ্ক সরিয়ে ফেলে আসলে কি নিজেদের অব্যবস্থা ঢাকতে চাইছে? যদি রেলের সম্পত্তি ভাংচুর রোখা উদ্দেশ্য হয় তাহলে নানা স্টেশনে কুম্ভের তীর্থযাত্রীরা এসি কামরায় জানলা ভেঙে যে তণ্ডব চালিয়েছে, তা রোখার জন্য পদক্ষেপ করল না কেন? বা সেই তীর্থযত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল না কেন? ভিড় সামলানোর পাশাপাশি নিজের সম্পত্তি রক্ষা করতেও কি রেল তবে ব্যর্থ?