চেক ভাঙিয়ে পাহাড়প্রমাণ সোনা কিনেছেন অভিষেক-পত্নী রুজিরা! শুভেন্দু-উবাচ যেন সিনেমা
বিশেষত অভিষেক-বিরোধিতা তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফের রুজিরা নিয়ে বিস্ফোরক দাবি করলেন তিনি।
২০১৯ সাল। লোকসভা নির্বাচনের আবহে বঙ্গরাজনীতির আঙিনায় প্রকাশ্যে আসে এক নতুন নাম। সঙ্গে সঙ্গেই অভিষেকের সুখের সংসারে শুরু হয় সমালোচনার টানাপোড়েন। আকস্মিকভাবে বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসেন রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি ডায়মন্ডহারবারের সাংসদ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো, বর্তমানে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী। অভিযোগ ওঠে, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক থেকে ফেরার সময় কলকাতা বিমানবন্দরে অতিরিক্ত সোনা-সহ ধরা পড়েছেন অভিষেকের স্ত্রী। যদিও প্রশাসন এবং পরবর্তীকালে এই কাণ্ডে কলকাতা হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণে খুব একটা ধোপে টেকেনি এই অভিযোগ। তারপর গঙ্গা দিয়ে বয়েছে অনেক জল। সেই স্রোতের ধাক্কা দিল্লির যমুনা ছাড়িয়ে পৌঁছেছে হাজরার শান্তি ভবনে। কয়লা পাচার দুর্নীতি-র আঁচ লেগেছে রুজিরার গায়ে। সিবিআই-ইডি-র যৌথ চাপে বারবার ডাক পড়েছে অভিষেক-পত্নীর। পরিবারে ইডি-সিবিআই উত্তাপে সরব হয়েছেন অভিষেক, মমতা।
কিন্তু এই আবহ, এই বিতর্ক থামেনি আজও। দুর্নীতি প্রশ্নে বারবার সরব হচ্ছেন বিরোধীরা। কয়লা অথবা গরু, বালি- সব ক্ষেত্রেই যে অভিষেক এবং তাঁর পরিবার জড়িত, সেই দিকেই ইঙ্গিত বিরোধী নেতাদের। এবার সেই তীব্রতা আরও বিস্ফোরক করলেন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা, বর্তমানে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী। বিশেষত অভিষেক-বিরোধিতা তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফের রুজিরা নিয়ে বিস্ফোরক দাবি করলেন তিনি।
রবিবার উত্তরপাড়ার দোলতলা থেকে গৌরী সিনেমা হল পর্যন্ত মিছিল করে বিজেপি। ১৩ সেপ্টেম্বরের নবান্ন অভিযান কর্মসূচির সমর্থনে এই মিছিল। যেখানে উপস্থিত ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী, অশোক দিন্দা-সহ বিজেপির একাধিক নেতারা। ওই মিছিল শেষে গৌরী সিনেমা হলের সামনের পথসভা থেকে আক্রমণ শানান নন্দীগ্রামের বিধায়ক। মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাতে একটি চেক নিয়ে তিনি বলেন, "ব্যাংককে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল রুজিরা নারুলার, ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বন্ধ করেন। তিনি ব্যাংকক যান। সঙ্গে নিয়েছিলেন বোন মেনকা গম্ভীরকে।" শুভেন্দুর দাবি, "বোনের অ্যাকাউন্টে সব টাকা ট্রান্সফার করা হয়, সেই টাকা দিয়ে আট ব্যাগ সোনা কেনেন অভিষেকের স্ত্রী।" বিজেপি নেতার আরও দাবি, "ওই সোনার ব্যাগ কলকাতা বিমানবন্দরে আটকানো হয়, তারপর তৎকালীন বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ প্রধান জ্ঞানবন্ত সিংহ প্রায় দুশো পুলিশ নিয়ে গিয়ে ওই ব্যাগ ছোটদার দোকান ভেঙে করা বাড়িতে পৌঁছে দেন!"- শুভেন্দুর এই দাবি আগেও প্রকাশ পায়। কিন্তু হাতে চেক নিয়ে রুজিরার বিরুদ্ধে এই অভিযোগের বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি আগে দেননি। যেখানে 'ছোড়দার দোকান ভেঙে করা বাড়ি' অর্থাৎ অভিষেকের শান্তিনিকেতনের দিকেই ইঙ্গিত বলে মনে করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে অভিষেকের ঘরে দুর্নীতির ছোঁয়া লাগাতে সফল হয়েছেন এই বিজেপি নেতা!
আরও পড়ুন: প্রতিপক্ষ গোটা বিজেপি নয়, অভিযোগেই প্রমাণ লড়াইটা আসলে অভিষেক বনাম শুভেন্দুর
২ সেপ্টেম্বর নিজাম প্যালেসে দাঁড়িয়ে, ইডি-র জিজ্ঞাসাবাদের পর শুভেন্দু সম্পর্কে বিস্ফোরক অভিযোগ করেন অভিষেক। তিনি বলেন, "আট মাস আগে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত পলাতক বিনয় মিশ্রর সঙ্গে কথা হয়েছে শুভেন্দু অধিকারীর, ওকে কেস মিটিয়ে নেওয়ার কথাও বলেছেন শুভেন্দু।" আদালতে অডিও ক্লিপ জমা দেবেন বলেও জানান অভিষেক। এরপরেই অস্বস্তিতে পড়েন শুভেন্দু। পাল্টা দাবি করেন, "ওই অডিও ক্লিপের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত নম্বর প্রকাশ করুন, যদি না পারেন, তাহলে সারদায় সুদীপ্ত-র চিঠির মতো এটাও সাজানো প্রমাণ হবে।" শুভেন্দু দাবি করেন, বিনয়ের জেলবন্দি ভাই বিকাশ মিশ্রর সঙ্গে রোজ সন্ধ্যা সাতটায় কথা হয় অভিষেকের। রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, যে লড়াই তৃণমূল বনাম বিজেপির ছিল, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে তাই-ই যেন শুভেন্দু বনাম অভিষেকে পরিণত হয়েছে, যা বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট চিন্তার। যদিও এই আবহ এবং অভিষেকের স্ত্রী-র বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে সরব হয়েছেন তৃণমূল নেতারা। পাল্টা শুভেন্দুকে আক্রমণ শানিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু কে কার বিরুদ্ধে কতগুলো মানহানির মামলা দায়ের করবেন, তা নিয়েও সন্দিহান রাজনৈতিক মহলের একাংশ। কেন বারবার অভিযুক্ত হচ্ছেন অভিষেকের স্ত্রী? কী কারণে তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ?
কে রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়?
অভিষেকের স্ত্রী সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য না পাওয়া গেলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তাঁর নাম রুজিরা নারুলা। যে নাম নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই দাবি করেন, তাঁর নাম জস্মিত আহুজা। যাঁর পারিবারিক অনেকেরই বসবাস থাইল্যান্ডে। অর্থাৎ ভারত এবং থাইল্যান্ড এই দুই দেশেই বসবাস তাঁদের। বিদেশে হোটেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নারুলা পরিবার। এদিকে দিল্লির রাজৌরি এলাকায় নারুলাদের বিখ্যাত মোবাইলের দোকান ছিল বলেও জানা যায়। রুজিরা, স্কুল শেষের পরে দিল্লির আইআইপিএম (IIPM) থেকে পড়াশুনা করেন। তারপর শিক্ষার প্রয়োজনে সুইজারল্যান্ডে কাটান বেশ কিছুদিন। রুজিরার কাছে 'ওভারসিজ সিটিজেন অফ্ ইন্ডিয়া' বা 'ওসিআই' কার্ড রয়েছে। অর্থাৎ ভারত এবং থাইল্যান্ডের দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধার মতো সুবিধা ভোগ করতে পারতেন তিনি। শুধু হোটেল নয়, জানা যায়, নারুলাদের আমদানি-রফতানি-সহ সোনার ব্যবসাও রয়েছে। এছাড়াও একটা সময়ে রিয়াল এস্টেটের ব্যবসা করে এই পরিবার। বরাবর প্রতিপত্তিশালী পরিবারের যাতায়াত ছিল বিদেশে। সেই সূত্রেই রুজিরার বিদেশ গমন।
নাম-বিতর্ক
রুজিরার বাবার নাম নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ২০০৯-র ১৪ নভেম্বর প্যানকার্ড পান রুজিরা। বিয়ের পর 'ওভারসিজ সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া কার্ডে'-র (ওসিআই) জন্য আবেদন করেন তিনি। তবে ২০১০ সালের ৮ জানুয়ারি রুজিরার পিআইও কার্ড দেয় থাইল্যান্ডের ভারতীয় দূতাবাস। সেখানে তাঁর বাবার নামের জায়গায় লেখা নিফন নারুলা। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সূত্রে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী ওসিআই কার্ড পাওয়ার জন্য বিয়ের সার্টিফিকেট জমা দিয়েছিলেন রুজিরা। সেই সার্টিফিকেটে আবার দিল্লির বাসিন্দা গুরশরণ সিং আহুজা নামে এক ব্যক্তিকে বাবা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দুই স্থানে বাবার নাম আলাদা হওয়ায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শো-কজের মুখোমুখি হন রুজিরা।
অভিষেক-যোগ
দিল্লির আইআইপিএমে স্কুল শেষ করে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে যান অভিষেক। সেখানেই সহপাঠী রুজিরার সঙ্গে আলাপ হয় অভিষেকের। সুইজারল্যান্ডে ট্রেনিংয়ে গিয়ে যা গাঢ় হয়। বন্ধুত্ব, প্রেম। তারপর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লিতে বিয়ে করেন দু'জনে। বিরাট আয়োজনে মমতা অনুপস্থিত থাকলেও উপস্থিত ছিলেন অনেক রাজনৈতিক নেতা। অভিষেক-রুজিরার দুই সন্তান। প্রথম সন্তান কন্যা আজানিয়া। দ্বিতীয় সন্তান পুত্র। নাম আয়ানশ।
দুর্নীতি-বিতর্ক
কয়লা পাচারকাণ্ডে কীভাবে জড়িয়ে গেলেন অভিষেক-পত্নী! কেন তাঁর বিরুদ্ধে উঠছে অভিযোগ? প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-র দুর্নীতি দমন শাখা কয়লা পাচার (বেআইনি) সংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের করে। এই মামলা দায়ের হয়েছিল 'ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেডে'-র আওতাধীন সমস্ত কয়লা খনি নিয়ে। ওই মামলায় মূল অভিযুক্ত হিসেবে নাম ওঠে অনুপ মাঝির অর্থাৎ কয়লা মাফিয়া লালার। পুলিশের খাতাতে দাগি অপরাধী লালা, আসানসোলে পরিচিত কয়লা মাফিয়া হিসেবেই। এর সঙ্গেই ওই মামলায় ইসিএল-র তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার অমিতকুমার ধর, জয়েশ চন্দ্র রাই, ইসিএল-এর প্রধান নিরাপত্তা আধিকারিক তন্ময় দাস, নিরাপত্তা আধিকারিক কুনসতোরিয়া ধনঞ্জয় রাই ও এসএসআই ও নিরাপত্তার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের নামে অভিযোগ দায়ের করে সিবিআই। তদন্তে নেমে সিবিআই দাবি করে, কিছু তথ্য প্রমাণ; যা তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকেও ইঙ্গিত করছে, অভিযুক্ত বা সাক্ষী হিসেবে। সিবিআই অভিযোগ করে, কয়লা মাফিয়া লালার মাধ্যমে বেআইনি কয়লা পাচারের টাকার একটা বড় অংশ পরিচিত এক প্রভাবশালীর কাছে যেত। আর এই টাকা জমা পড়েছে তাঁর স্ত্রী-র বিদেশি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। এই ঘটনার পর থেকে কয়লাপাচার কাণ্ডে বারবার অভিষেক-রুজিরাকে তলব করেছে সিবিআই। চলেছে টানাপড়েন। জেরাও।
এই আবহেই এই মামলায় প্রবেশ করে ইডি। বেআইনি অর্থ তছরূপের অভিযোগ নিয়ে অভিষেক এবং তাঁর স্ত্রী রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জেরার জন্য সমন পাঠায় ইডি। রুজিরার বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, বারবার তলব করলেও সহযোগিতা করছেন না তিনি। দুর্নীতির আকাশে ঘনিয়ে আসে মেঘ। শান্তিনিকেতনে অশান্তির আবহ নিয়ে সরব হয় বিরোধীরা। যা তীব্র হয়, অভিষেক-বিরোধী শুভেন্দুর বিজেপি-যোগে। বারবার প্রকাশ্যে অভিযোগ ওঠে রুজিরার বিরুদ্ধে। পার্থ-অনুব্রত অথবা শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির মধ্যেই কড়া নাড়তে থাকে এই অভিযোগও। যেখানে শুভেন্দু-সম্পর্কে অভিষেকের অভিযোগের পরেই ফের বিস্ফোরক অভিযোগ করেছেন শুভেন্দু। কৌশলে রুজিরা-বিতর্ক উসকে দিয়ে ফের মনে করিয়ে দিয়েছেন, অভিষেক এবং তাঁর পরিবারের দুর্নীতি-যোগের অভিযোগের কথা। যা রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মত, রাজনৈতিক মহলের একাংশের।