আরজি কর ধর্ষণ হত্যাকাণ্ডে কি পিতৃতন্ত্রকেই বাঁচাতে চাইল সুপ্রিম কোর্ট?

RG Kar Supreme Court: সর্বোচ্চ আদালত কি বিবেকের তাড়নাতেই এই মামলা শোনার জন্য উদগ্রীব হলো, না কি এর পিছনে অন্য কোনও কারণ আছে?

আরজি কর হাসপাতালে এক মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষিতা এবং খুন হওয়ার পরে, সারা বাংলা এক অভূতপূর্ব গণরোষ প্রত্যক্ষ করল। মহিলারা লড়াইয়ের এক অসাধারণ নিদর্শন তৈরি করলেন। অদলীয় কিন্তু আদ্যন্ত রাজনৈতিক স্লোগান তুলে, ভারতের আটাত্তরতম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে জমায়েত হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন মূলত মহিলারাই। বলেছিলেন, ‘রাতের দখল নাও’। প্রাথমিকভাবে কলকাতার মাত্র তিনটি জায়গায় জমায়েত হওয়ার ডাক দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের বিভিন্ন শহরে। শিলিগুড়ি থেকে বোলপুর হয়ে কলকাতার অন্তত দেড়শটি জায়গায় জমায়েত হয়েছিলেন লাখো লাখো মহিলা এবং পুরুষরাও। ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক থেকে শুরু করে সকল পেশার সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এই আন্দোলনে শরিক হন। রাতারাতি স্বাধীনতা দিবসের মানেটাই যেন বদলে যায়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং সেই সংক্রান্ত আলোচনা নয়, নারী আন্দোলন, নারী স্বাধীনতা, নারীদের নির্ভয়ে বাঁচার স্বাধীনতার কথাই অনুরণিত হয়। যে মহিলা চিকিৎসক টানা ৩৬ ঘণ্টা কাজ করার পরে, বিশ্রাম নেওয়ার সময়ে ধর্ষিতা হন, খুন হন, সেই মৃতা চিকিৎসকই সামনে নিয়ে আসেন এক অমোঘ প্রশ্ন। নিজেদের কাজের জায়গায় কোনও নিরাপত্তাই নেই মহিলাদের?

২০১২ সালে রাজধানী দিল্লির বুকে ২২ বছরের এক তরুণীর ধর্ষণের ঘটনার পরে এভাবেই সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নামেন। দিল্লির ‘নির্ভয়া’ কাণ্ডের পরে সারা দেশে যখন আন্দোলন চলছে, তখন শুধুমাত্র দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হস্তক্ষেপ করেনি। একদিকে ফাস্টট্র্যাক আদালতে বিচার শুরু হয়, বিচারবিভাগীয় কমিটি গঠন করা হয়। ধৃতদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা হয় একদিকে আর অন্যদিকে বিভিন্ন মহিলা সংগঠনের সঙ্গে কথাও বলে শীর্ষ আদালত যাতে ভবিষ্যতে যদি এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটে সেক্ষেত্রে কীভাবে আইনকে আরও কঠোর বানানো যায়। সেই ঘটনায় ফাঁসির সাজা হয়েছিল কিন্তু তারপরেও কি ধর্ষণ কমল? নির্ভয়ার ঘটনার সঙ্গে এই ঘটনার আপাতত একটাই পার্থক্য। বিষয়টা মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা নিয়ে আলোচনা হওয়ার ছিল। অথচ দেশের সর্বোচ্চ আদালত পশ্চিমবঙ্গের এই ঘটনাকে প্রধানত মহিলা চিকিৎসকদের সুরক্ষার বিষয় হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। প্রশ্ন এবং বিতর্ক হওয়া উচিত ছিল, কীভাবে একজন সাধারণ আশাকর্মী তাঁর কাজের জায়গায় নিরাপত্তা পেতে পারেন? বিতর্ক হওয়া উচিত ছিল একজন মহিলা গিগ কর্মী যদি দেখেন রাত দশটায় সাধারণ শৌচাগার বন্ধ, তখন তাঁর কত ধরনের অসুবিধা হতে পারে? অন্য যেকোনও বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত মহিলাদের নিরাপত্তা কীভাবে দেওয়া যাবে? অথচ আলোচনা শুধুমাত্র মহিলা চিকিৎসকদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তায় আবদ্ধ হয়ে গেল। মনে প্রশ্ন জাগেই, আজকের বিচারব্যবস্থা সত্যিই অন্ধ এবং পক্ষপাতদুষ্ট নয় তো?

আরও পড়ুন- সেই রাতে যৌনহেনস্থা আর এক মহিলাকেও? যে ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এল আরজি কর-অভিযুক্তের পলিগ্রাফ টেস্টে

আরজি কর কাণ্ডের পর মূল দাবি ছিল- বিচার চাই। একটাই চাহিদা, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যেভাবে এই ঘটনাকে ধামাচাপা দিয়ে
আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেছিল, তাতে যেন তারা সফল না হতে পারে। ঘটনার সঙ্গে যারা সরাসরি বা পরোক্ষভাবেও জড়িত, তারা যেন শাস্তি পায়। কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ যখন নির্যাতিতার দিকেই আঙুল তোলেন, আগুনে যেন ঘৃতাহুতি পড়ে। একজন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হলেও, ক্ষোভ প্রশমিত হওয়ার কোনও লক্ষণই দেখা যায় না। পাশাপাশি সমাজমাধ্যমে ছড়াতে থাকে নানা অপতথ্য এবং গুজব। ১৪ তারিখ রাতে আরজি করে দুষ্কৃতীদের হামলার পরে তা আরও বাড়তে থাকে। গণউন্মাদনা তৈরি হয়, দাবি ওঠা শুরু হয়, এই ঘটনার দায়িত্ব নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। ঘটনার তদন্তভার তুলে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যখন উচিত ছিল ঘটনার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া এবং ইস্তফা দেওয়ার, তখন  তা না করে তিনি নিজেই অভিযুক্তের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হন! তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, ফলে আন্দোলন আরও তীব্র হয়।

অনেকেই প্রশ্ন তোলা শুরু করেন, তাহলে কি রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল এতই খারাপ যে সেখানে একজন মহিলা চিকিৎসকও নিরাপদ নন? হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসকদের জন্য একটি অস্থায়ী বিশ্রাম কক্ষও যদি তৈরি না করা যায় তাহলে আঙুল উঠতে বাধ্য রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর দিকেই। সেই উত্তর তো তাঁকেই দিতে হবে, তাঁর দায়বদ্ধতা নিয়ে তো কথা উঠবেই। চিকিৎসকেরা প্রতিবাদে কর্মবিরতি ঘোষণা করেন। সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিবাদ দেখে দেশের সর্বোচ্চ আদালত নড়েচড়ে বসে এবং স্বতঃপ্রণোদিত
হয়ে এই ঘটনায় মামলা শোনার আগ্রহ প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। রাজ্য এবং সিবিআইকে সর্বোচ্চ আদালতের তরফে জানানো হয়, মামলা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য যাতে তাঁদের হাতে দেওয়া হয়। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, সর্বোচ্চ আদালত কি বিবেকের তাড়নাতেই এই মামলা শোনার জন্য উদগ্রীব হলো, না কি এর পিছনে অন্য কোনও কারণ আছে?

যদিও প্রধান বিচারপতি বলেছেন, এই ঘটনা শুধু পশ্চিমবঙ্গের একটি হাসপাতালের ঘটনা নয়, এর একটা দেশব্যাপী অভিঘাত আছে। প্রাথমিক শুনানিতে শীর্ষ আদালত প্রথমেই চিকিৎসকদের ধর্মঘট তুলে নেওয়ার আবেদন করে এবং জানায় যে চিকিৎসক, বিশেষ করে মহিলা চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য একটি জাতীয় টাস্ক ফোর্স গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। যে টাস্ক ফোর্স হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত ব্যক্তির নিরাপত্তার দায়িত্ব দেখভালের সিদ্ধান্ত নেবে এবং ৩ সপ্তাহের মধ্যে সেই সংক্রান্ত রিপোর্ট জমা করবে। পাশাপাশি আদালত রাজ্য সরকারকে জানায়, কোনও সংগঠন যদি শান্তিপূর্ণভাবে আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদ করে, তাহলে তাদের প্রতিবাদকে যেন সম্মান দেওয়া হয়। জোর করে যেন সেই প্রতিবাদ বন্ধ না করা হয়। আরজি করের ঘটনায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের ফল যে সুদূরপ্রসারী হতে পারে, এই ঘটনায় যে ব্রাহ্মণ্যবাদ, মনুবাদ এবং পিতৃতন্ত্রের কাঠামোই প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে, সেই বিষয়টি আন্দাজ করেছে আদালতও। পিতৃতন্ত্র এবং মনুবাদ মহিলাকে গৃহবন্দি করে রাখার নিদান দেয়। ব্রাহ্মণ্যবাদ নারীদের অধীনস্থ করে রাখতে চায়। প্রধান বিচারপতি বিষয়টিকে শুধুমাত্র চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে কি সমাজের এই পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকেই আড়ালে বাঁচিয়ে দিলেন না?

আরও পড়ুন- ১৩ ঘণ্টা ধরে ক্রাইম সিন খোলা! আরজি করে পুলিশের কর্তব্যে গাফিলতি, নাকি অভিসন্ধি?

অনেকে বলছেন, উত্তরপ্রদেশে বা মহারাষ্ট্রে ধর্ষণ হলে যদি সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীদের পদত্যাগ চাওয়া যায়, তাহলে বাংলায় কেন চাওয়া যাবে না। তাদের উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন করতেই হয়। নিয়ম অনুযায়ী সবার আগে প্রধানমন্ত্রী, যিনি নানা সময়ে ধর্ষকদের মান্যতা দিয়েছেন, তাঁর পদত্যাগ কেন চাওয়া হবে না? ভারতীয় মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন হেনস্থাকারী ব্রিজ ভূষণ শরণ সিং সম্পর্কে নিশ্চুপ ছিলেন মোদি। কাঠুয়া কিংবা উন্নাওয়ের ধর্ষণকারীদের সমর্থনে যখন মিছিল বেরোয় মোদি চুপ থাকেন, মণিপুরের মহিলাদের নির্যাতন দেখেও কি প্রধানমন্ত্রী চুপ থাকেন! যারা বলছেন এক দফা, এক দাবি - মুখ্যমন্ত্ৰীর পদত্যাগ, তাদের কাছে তাই প্রশ্ন রাখি, আরজি করের ঘটনা কি আর মৃতা মেয়েটির বিচারে আটকে আছে? কোনও মহিলাই কি কাজের জায়গায় নিরাপত্তা পাবেন কোনওদিন? বিজেপি এই নিয়ে চুপ কেন? বিশাখা কমিটির পরামর্শ কেন বলবৎ হলো না, তা নিয়ে কথা বলছে না কেন বিজেপি?

আরজি করের ঘটনাকে সাধারণ ধর্ষণ কিংবা খুনের ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। শুধু মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসকদের বিষয় হিসেবে দেখলে আরও ভুল হবে। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের পরে যেভাবে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আলতামাস কবীর বিভিন্ন মহিলা সমাজকর্মী এবং মহিলা সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন, আজকের প্রধান বিচারপতি কিন্তু সেইদিকে যেতে চাননি। তিনি খুব সচেতনভাবেই এই আন্দোলনের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে চেয়েছিলেন কিনা, সেই প্রশ্নও আগামীদিনে উঠবে। এই আন্দোলন যাতে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে আঘাত করতে পারে, সেভাবেই ভাবতে হবে। সংস্থাগত পরিকাঠামো ঠিক করে, সমস্ত জায়গায় মহিলাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ যদি তৈরি করা না যায়, ধর্ষণের বিরুদ্ধে এবং পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামাজিক আলোড়ন না তৈরি করা যায়, তাহলে কোনওভাবেই এই লড়াই জেতা যাবে না। এ নিছক একদিন ‘রাত দখল’ করার লড়াই নয়। রোজ রাস্তা দখল করতে হবে মহিলাদের। দিনে এবং রাতে নিরাপদ কাজের পরিবেশ এবং সমাধিকারের লড়াই এক রাতের বা এক দিনের নয় কখনই। ভালোবাসা, জীবন আর নারীদের নির্ভয় স্বাধীনতার লড়াই যেন আইনি শুনানির খাতাতেই আটকে না যায়।

 

মতামত লেখকের ব্যক্তিগত

More Articles