ঠিক কোন কারণে বাংলায় নিষিদ্ধ দ্য কেরল স্টোরি?

The Kerala Story Banned: বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে, একের পর এক সিনেমায় দেশাত্মবোধের বাড়াবাড়ি, হিন্দুদের উপর অত্যাচার এবং মুসলিমদের সন্ত্রাস প্রকল ও প্রবল।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শব্দটি পড়ার পর 'দ্য কেরল স্টোরি' সিনেমার ট্রেলারটুকু দেখলেই উদ্দেশ্য-বিধেয় সব জলবৎ তরলং! সুদীপ্ত সেন পরিচালিত এবং বিপুল অমৃতলাল শাহের সৃজনশীল পরিচালনায় (!) সিনেমাটি রাজনৈতিক কারণে দু'প্রকার প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। এক, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যে দ্য কেরল স্টোরিকে করমুক্ত ঘোষণা করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে এই জাতীয় সিনেমার পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার। দুই, পশ্চিমবঙ্গে সিনেমাটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দুইখানি ধুয়ো তুলে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গেরুয়া ও গেরুয়া ঘনিষ্ট শিবির বলছে, মুসলিম তোষণের প্রমাণ দিয়েছেন দিদি, আরেক দল বলছে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আরএসএসের 'নির্দেশ' পালন করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আখেরে রাজ্যে অশান্তির আবহ তৈরিতে বিজেপিকে সরঞ্জাম জুগিয়েছে তৃণমূল সরকার।

সিনেমাকে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার উদ্দ্যেশ্যে ব্যবহার নতুন নয়। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে, একের পর এক সিনেমায় দেশাত্মবোধের বাড়াবাড়ি, হিন্দুদের উপর অত্যাচার এবং মুসলিমদের সন্ত্রাস প্রকল ও প্রবল। নরেন্দ্র মোদির স্তুতিবাচক সিনেমাটি যদিও বাদও দেওয়া যায়, এই জাতীয় দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক সিনেমার পরিমাণ বাড়ছে। দ্য কাশ্মীর ফাইলসে শেষ এমন বিতর্ক উঠেছিল, বিতর্ক স্তিমিত হতে না হতেই নয়া অস্ত্র হাজির! কিন্তু দ্য কেরল স্টোরি নিয়ে এত বিতর্ক কেন? সিনেমাটির প্রচারে, নির্মাতারা দাবি করেছিলেন যে, কেরল রাজ্যটি থেকে ৩২,০০০ মহিলাকে ইসলামিক স্টেটে (আইএস) নিয়োগ করা হয়েছে। কেরল হাইকোর্ট এই দাবির সপক্ষে প্রমাণ জমা করতে বললে নির্মাতাদের পিছু হটতে হয়। তবে নির্মাতাদের পাশে দাঁড়ান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কর্ণাটক নির্বাচনের প্রচারে সিনেমার ভূয়সী প্রশংসা করেন মোদি। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানকে তাঁর রাজ্যে সিনেমাটি করমুক্ত ঘোষণা করে বিতর্ক বাড়িয়েছেন। আর কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন 'দ্য কেরল স্টোরি'-র নির্মাতাদের নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, সিনেমাটি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৈরি এবং রাজ্যের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক প্রচার ছড়ানোর লক্ষ্যেই নির্মিত।

আরও পড়ুন- অশান্তির আতঙ্কে বাংলায় নিষিদ্ধ! মাত্র ৪ দিনে দেশজুড়ে ‘দ্য কেরল স্টোরি’র আয় কত?

এমন নয় যে সিনেমাটি সম্পূর্ণ মিথ্যার উপর ভিত্তি করে নির্মিত। এমন মহিলাদের ঘটনা রয়েছে যারা বিভ্রান্ত হয়েছে, প্ররোচিত হয়েছে এবং আইএসে যোগ দিয়েছে। কিন্তু সেই পরিস্থিতির গভীরে যাওয়ার বদলে সিনেমাটির মূল এজেন্ডাই হয়ে দাঁড়িয়েছে, মুসলিমদের অপমান করা। দুই ঘণ্টা আঠারো মিনিটের সিনেমায়, সিনেমাটিক স্বাধীনতার নামে অতিরঞ্জিত বিষয়, ভীতি প্রদর্শন, অযৌক্তিকতা, যৌন হিংসা এবং আধাখ্যাঁচড়া গল্প বলে অর্ধসত্য পরিবেশনের অভিযোগ উঠছে দ্য কেরল স্টোরির বিরুদ্ধে।

সিনেমার গল্পটি মূলত তিনটি মেয়েকে কেন্দ্র করে যারা কাসারগোডে নার্সিং পড়তে এসেছে। যদিও মূল পঠনপাঠনের চেয়ে ধর্মতত্ত্বেই তাঁদের বেশি আগ্রহী বলে মনে হয়। তাদের মধ্যে অন্তত দু'জন, দু'জনই হিন্দু, তাদের হিজাব পরা রুমমেটের ধর্মোপদেশ শুনে অবাক। এই হিজাব পরিহিতা চরিত্রটিকে দিয়ে সিনেমা পরিচালক যা যা বলিয়েছেন, তা শুনলেই বোঝা যায় ঠিক কোনখানে রাজনৈতিক এজেন্ডা হয়ে উঠেছে এই সিনেমাটি। ইসলামের নীতি সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া ছাড়াও এই চরিত্রটি অন্য ধর্মকে গালাগালি দেয়, এই জাতীয় চরিত্ররা মাদক সরবরাহ করে, শ্লীলতাহানি করে, ধর্ষণ করে, 'জাতীয়তাবাদ হারাম'-এর মতো কথা বলে এবং হত্যা করে। হিজাব পরা বন্ধুকে দিয়ে বলানো হয় কেন ধর্ষণ এড়াতে হিজাব পরে থাকা দরকার। বলানো হয় শিব 'অকর্মণ্য' ঠাকুর কারণ শিব স্ত্রীর মৃত্যুতে কাঁদে। যে পুরুষ কাঁদে, সে দেবতা কীভাবে হয়! কেন এই নার্সিং পড়তে আসা 'শিক্ষিত' যুবতীরা এত নির্বোধ এবং অজ্ঞ, এও এক যৌক্তিক প্রশ্ন বটে!

সিনেমায় শালিনী উন্নিকৃষ্ণান এক হিন্দু পরিবারের একজন 'সুকন্যা', তিরুবনন্তপুরমের হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার বাসিন্দা সে। শালিনী নার্সিং পড়তে যায় কাসারগোডের মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলায় একটি মুসলিম পরিচালিত কলেজে। সঙ্গে আছে গীতাঞ্জলি, একজন কমিউনিস্ট বাবার কন্যা এবং নিমা, কোট্টায়ামের একজন খ্রিস্টান মেয়ে। চতুর্থ সদস্য হলো আসিফা যাকে দিয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটিয়েছেন, বলিয়েছেন পরিচালক।

পুরুষ, আরও ভালো করে বলতে গেলে মুসলিম পুরুষরা কতখানি নির্দয় ও অমানবিক- সেই দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে গর্ভবতী মহিলার সঙ্গে জোর করে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে যে পর্যায়ের হিংসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা সিনেমার মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলে। চরিত্রগুলি দিনরাত ধর্ম ছাড়া আর কিছু নিয়েই কথা বলে না। কেরলের স্বাভাবিক খাদ্যরীতি অনুযায়ী কেউ পরোটা-বিফ ফ্রাই অর্ডার করে না বা পাজম পোরি (কলা ভাজা) খায় না। চিত্রনাট্যের প্রতি সেকেন্ডে এজেন্ডাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য হিন্দু-ইসলাম-আল্লাহ-তোমার ঈশ্বর-আমার ঈশ্বর এবং মাঝে মাঝে, 'কমিউনিস্ট' শব্দগুলি জোর করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। নিমার চরিত্রের মাধ্যমে এক সংখ্যালঘু এবং অন্য সংখ্যালঘুর মধ্যে অবিশ্বাসকে চাতুর্যের সঙ্গে উস্কে দেওয়া হয়েছে– কেরলে খ্রিস্টান অধিকারের উত্থানের উপর ভিত্তি করে।

সন্ত্রাসবাদের কুৎসিত সত্য দেখানোর চেয়েও বেশি দ্য কেরল স্টোরি দেখিয়েছে মহিলা চরিত্রগুলি আসলে কতটা নির্বোধ এবং অজ্ঞ। প্রতিটি দৃশ্যেই তাদের মগজ ধোলাই করা হয়েছে এবং তারা আজ্ঞাবহ রোবোটিক দাসের মতো তা করতে দিয়েছে। চিত্র পরিচালক ও নির্মাতারা বলতে চেয়েছেন, ৩২,০০০ মহিলাকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে এবং সিরিয়া, ইয়েমেনের মরুভূমিতে সমাহিত করা হয়েছে। কেরলে 'সাধারণ মেয়েদের' সন্ত্রাসবাদীতে পরিণত করার বিপজ্জনক খেলা চলছে এবং এটি নাকি 'ওপেন সিক্রেট'।

আরও পড়ুন- উঠে এসেছে গুজরাত দাঙ্গার ভয়াবহতা, মোদিকে নিয়ে বিবিসির তথ্যচিত্র ফের তৈরি করল বিতর্ক

স্বাধীন সত্য যাচাইকারী সংস্থা অল্ট নিউজ সিনেমার ট্রেলারে করা দাবিগুলির উপর একটি বিস্তৃত পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছে। দেখা গেছে নির্লজ্জ মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ এই সিনেমা। দু'জন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ভুল উদ্ধৃতি, কিছু ভুয়ো সমীক্ষা, নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের আরও কোণঠাসা করার উদ্দেশ্যে সিনেমাটি এগিয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে মজার তথ্য উঠে আসছে যে, যে ৩২,০০০ নারী পাচারের কথা বলা হচ্ছে, আসলে সংখ্যাটা হয়তো তিনজন বা চারজন! সিনেমায় বারেবারে প্রমাণ করা হয়েছে, যে রাজ্যটিকে 'ঈশ্বরের নিজের দেশ' বলে মনে করে মানুষ তা আসলে 'ভুল ঈশ্বরের কব্জায়'। মুসলিম পুরুষদের দিয়ে ধর্ষণ করানো, জোর করে বিয়ে করিয়ে ধর্ম বদলে ফেলা, মুসলিম পুরুষদের দ্বারা গর্ভধারণ করিয়ে মহিলাদের সিরিয়ায় নিয়ে যাওয়া ঘটনাকে প্রশ্ন করলেই নির্মাতা নিজেরাই পিছিয়ে ৩২,০০০ থেকে ৩-এ নেমে আসেন।

যদিও পরিচালক সুদীপ্ত সেন দাবি করেছেন যে, তাঁর কাছে এই দাবির প্রমাণ রয়েছে। এখনও পর্যন্ত তিনি তা প্রকাশ্যে আনেননি। ইউটিউব চ্যানেল 'ফেস্টিভ্যাল অব ভারত'-এ একটি সাক্ষাত্কারে, পরিচালক দাবি করেছেন, ২০১০ সালে, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ওমেন চান্ডি কেরল বিধানসভায় একটি রিপোর্ট পেশ করেছিলেন যাতে বলা হয়েছিল, "প্রতি বছর প্রায় ২৮০০-৩২০০ মেয়েকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে।" সুদীপ্ত সেন সাক্ষাত্কারে বলেছেন, "দশ বছরের জন্য এই সংখ্যাটি গণনা করলে তা ৩২,০০০-৩৩,০০০-এই দাঁড়ায়। বাস্তবে, এই পরিসংখ্যান উল্লিখিত রয়েছে ২০১০ সালের এমন কোনও নথিই মেলেনি। "কান্ট্রি রিপোর্টস অন টেররিজম ২০২০: ইন্ডিয়া" শীর্ষক মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদন অনুসারে, "নভেম্বর পর্যন্ত ৬৬ জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত আইএসআইএসের সঙ্গে যুক্ত ছিল (২০২০)।” সিনেমাটির দাবি, যে চারজন মহিলার গল্পের উপর ভিত্তি করে সিনেমাটি নির্মিত, যারা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল এবং ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ISIS-এ যোগ দিতে তাদের স্বামীদের সঙ্গে আফগানিস্তানে গেছিল, তারা বর্তমানে একটি আফগান কারাগারে বন্দি রয়েছে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে, কেরলার চার মহিলা- নিমিশা ওরফে ফাথিমা ইসা, মেরিন ওরফে মিরিয়াম, সোনিয়া সেবাস্তিয়ান ওরফে আয়েশা এবং রাফায়েলার সাক্ষাৎকার- স্ট্র্যাটনিউজ গ্লোবাল ওয়েবসাইট থেকে 'খোরাসান ফাইলস: দ্য জার্নি অব ইন্ডিয়ান ইসলামিক স্টেট উইডোজ' শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল।

ভারতের অসংখ্য প্রেক্ষাগৃহে মুসলিম বিরোধী স্লোগানের ঘটনা ঘটেছে। সিনেমার স্ক্রিনিংয়ে হিংসার ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং, স্পষ্টতই, সিনেমার ক্ষমতা আছে। ক্ষমতা আছে আরএসএস-বিজেপির এবং ক্ষমতা ধরেন প্রযোজকরাও। সাম্প্রদায়িকতা এক নিষ্ঠুর ব্যবসা। একবার ব্যবসার সাফল্যের সমীকরণ ধরে ফেলতে পারলে ঘোলা জলে তিমিও ধরা শক্ত নয়। কাশ্মীর ফাইলসই ছিল তার যোগ্যতম প্রমাণ, উত্তরসূরি হয়ে এসেছে দ্য কেরল স্টোরি। সিনেমা নিষিদ্ধ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসলে 'অশান্তি' ঠেকাতে চেয়েছেন কিনা সেই উত্তর মনে মনে শুভবুদ্ধিসম্পন্নরা জানেন। 

More Articles