বিধবার কামনায় ব্রাত্য ধন দৌলত, ঐশ্বর্য! লক্ষ্মীপুজোয় আজও একঘরে 'স্বামীহীনা'রা

Lakshmi Puja 2022: ধন-দৌলত, ঐশ্বর্যের দেবীভক্তিতে বিধবার প্রবেশ নিষেধ! সমকালে কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও তা নেহাতই এক্ষেত্রে যেন সংখ্যালঘুর মতো!

হরিষ বিষাদ এবে তুল্য চিরদিন;

বসন্ত শরত ঋতু সকলি মলিন!

দিবানিশি একই বেশ, বারমাস সেই ক্লেশ;

বিধবার প্রাণে হায় এতই কি সয় রে!

বিধবারমণী, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

 

বিধবা হলেই অন্ধকার! সুখগৃহে অনধিকার প্রবেশ নিষেধ! প্রতি মুহূর্তে স্মৃতি আর ভালো না থাকার সম্বলে চলতে হয় নিরন্তর! নাহ্, আমরা এই যুগের, একবিংশ শতাব্দীর অত্যাধুনিক সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষিত শ্রেণি এবং সর্বত্র বিরাজমান স্বাধীন সত্ত্বার আবহের কথা বলছি না। বলছি, এই বাংলায়, এই দেশের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে থাকা বিষাদলক্ষ্মীদের কথা! যাঁরা রূপে-গুণে লক্ষ্মী হলেও প্রতি মুহূর্তে, প্রতিটি ক্ষেত্রে বারবার ব্রাত্য। অধিকাংশেরই উৎসব মলিন, আলোকোজ্জ্বল আবহে অনেকেরই সবটা অন্ধকার। ধর্মীয় রীতিনীতি-আচার অথবা তথাকথিত সামাজিক শুভকাজে এই অংশের প্রায় প্রত্যেকেই ব্রাত্য। অনেকেই বলবেন, এই সময়ে দাঁড়িয়ে এইরকম হয় নাকি! বৃন্দাবনে বিধবাদের ভিক্ষা অথবা বাঘে খাওয়া স্বামীর জন্য সুন্দরবনের বিধবা পাড়া, বা আমাদের দৈনন্দিন যাপনে এমন অনেক চরিত্রই রয়েছে যা চোখে দেখেও চোখে পড়ে না অনেকসময়! এই প্রশ্ন নিয়েই আমরা খতিয়ে দেখতে ঘুরেছিলাম এই রাজ্যের তথাকথিত প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছত্রে ছত্রে।

ঠিক কীরকম? ধরা যাক, শুভ কাজ, পুজো অথবা লক্ষ্মীপুজো। ঘরের লক্ষ্মীরা পুজো করবেন, আলপনা দেবেন, তথাকথিত লক্ষ্মীমন্ত নারীর হাতেই পূজিত হবেন মা লক্ষ্মী। হিন্দুর ঘরে ঘরে শঙ্খ, উলুধ্বনির সঙ্গে আগমন ঘটবে তাঁর। হাতে দূর্বা, কপাল ভর্তি সিঁদুর আর বিবিধ ভোগের সমারোহে রাত জেগে ঘরে ঘরে পুজো পাবেন আরাধ্য দেবতা লক্ষ্মী। কোথাও কলাবউ, কোথাও মাটির সরা, নৌকা-ঘট-মূর্তি, ছবি, ধান; নানান রূপকে পুজো হবে দেবীর। আর তার সঙ্গেই সধবা নারী পাঠ করবেন, “দোল পূর্ণিমার নিশি পালন আকাশ...” দিয়ে শুরু হওয়া ব্রতকথা। এই লক্ষ্মীর ব্রতয় শুধুমাত্র অধিকার ফলবে সধবার। অর্থাৎ বিধবা হলে লক্ষ্মীর আরাধনায় থাকবে ঘোষিত নিষেধ। কারণ, ধন-দৌলত, ঐশ্বর্যের দেবীভক্তিতে বিধবার প্রবেশ নিষেধ! সমকালে কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও তা নেহাতই এক্ষেত্রে যেন সংখ্যালঘুর মতো!

কিন্তু এই ব্রতকথার ইতিহাস আবার বলে অন্য কথা। অনেক পুরাণবিদ বলবেন, সেটা বিতর্কিত, শাস্ত্রে যা বলা হচ্ছে বা হয়েছে তার ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে! কিন্তু লক্ষ্মীর আরাধনায় যে ব্রতকথা বা পাঁচালি পাঠ করা হয় তাতে দু’রকম উল্লেখই মেলে।

“এয়োতির চিহ্ন সিঁদুর শাঁখা না দেয়/ বাসি কাপড়ে যথা তথা বেড়ায়/ স্নান নিত্য নাহি করে যে মনুষ্যগণ/ ত্যাজিয়া তাহারে, করি অন্যত্র গমন।”

ওই পাঁচালির ছত্রে ছত্রে বিধবা-বর্জনের কথা বলা হলেও লক্ষ্মীপুজোর একাধিক ইতিহাসে নারী-বণিক-সওদাগর, মর্ত্যের মানুষের দুঃখমোচন, নারদের কথা সবকিছুর মাঝেই আবার উল্লেখ রয়েছে, এক বিধবার নারীর দুঃখমোচনেই লক্ষ্মীব্রতের উদ্ভব! এখানেই বলা হয়, পুরাণের অবন্তীনগরের কথা। যেখানে ব্যবসায়ী ধনেশ্বর রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর সংসারে অশান্তি শুরু হয়। মৃতের বিধবা স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে চলে যান। তখন তাঁকেই দেখা দেন দেবী। লক্ষ্মীর ব্রতের কথা বিস্তারিত জানান ছদ্মবেশী লক্ষ্মীদেবী।

“ধনেশ্বর-পত্নী ভীষণ শোকে/ বনে গমন করিল জীবন ত্যাজিতে/ সেই বনে বৃদ্ধা বসি করে হায় হায়/ এই বুঝি লেখা ছিল বিধাতার খাতায়/ এই দেখি হরিপ্রিয়া বৃদ্ধা রূপ ধরে/ ছদ্মবেশে দেখা দিলেন ধনেশ্বর ভার্যারে।”

লক্ষ্মীর সেই নির্দেশের পরেই তিনি বাড়ি ফেরেন এবং ছেলেদের বলে লক্ষ্মীর পুজো করান। কিন্তু আবার এই পাঁচালির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই একপ্রকার ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে বিধবাদের লক্ষ্মীপুজোয় না নিয়ে। অর্থাৎ সিঁথির সিঁদুর না থাকলে, স্বামীহীন হলে মা লক্ষ্মীর আরাধনায় তাঁদের প্রবেশ নৈব নৈব চ! এই ‘রীতি’ এখনও বিদ্যমান? লক্ষ্মীর আরাধনায় বহু গ্রামেগঞ্জে নেই বিধবাদের কোনও অংশগ্রহণ। শহরতলিও কম যায় কীসে! যেমন হৃদয়পুরের রিঙ্কু পোদ্দার (নাম পরিবর্তিত) আট মাসের গর্ভবতী অবস্থায় মেনিনজাইটিসে স্বামী হারান কয়েক বছর আগেই। পরে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন তিনি। বহুদিন অপয়া, অলক্ষ্মী বদনামে লক্ষ্মী তো দূর, দুর্গাপুজোর কোনও কাজেও তাঁর প্রবেশ ঘটেনি আর। এমনকি লাল রঙের সঙ্গ ত্যাগ করতে হয়েছে সেদিন থেকেই। তাঁর কথায়, “এই মাসখানেক হল আবার বিয়ে করেছি। তবে নতুন স্বামী জানলেও, তাঁর পরিবারকে পুরনো কথা বলিনি এখনও আমার স্বামীর পরামর্শে। বললেই তো সেই গঞ্জনা শুরু হবে, বাড়ির পুজো থেকে যা কিছু খারাপ, সব দোষ তো আমার হবে। তাই একটু মিথ্যা বলে যদি ভালো থাকা যায়!”

আরও পড়ুন- ম্রিয়মান পটুয়া গান! লোকসংস্কৃতির অন্তর্জলিযাত্রায় লক্ষ্মীর পট, পাঁচালির গান

প্রায় একই অবস্থা ঠাকুরনগরের অঞ্জনা দাসের। তাঁর কথায়, “আগে ধুমধাম করে লক্ষ্মীপুজো হত আমাদের বাড়িতে। কলাবউ এনে পুজো হয় আমাদের। একটাই ছেলে, এখন আর এসব করতে পারি না, আমার ছেলে বললেও পাড়ার লোকে বলবে সধবার পুজো বিধবা করছে, এসব ভাবতে ভাবতে আর এগোতে ইচ্ছা করে না!” পুজো বন্ধ হয়েছে হাসনাবাদের খুকুর ঘরেও। লক্ষ্মীর আরাধনায় বাধ সেধেছে বৈধব্য। যেখানে শাস্ত্র, নীতি, আদর্শ আর আচারের প্রকাশ্য বা ঘোষিত আঁচড় আর এখন নেই, শুধুই রয়েছে মানসিকতার তীব্র দাবদাহ। যা কিছুজনের কাছে অত্যন্ত সহজ হলেও সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দুর্ভাগ্যজনক! যদিও বেদের যুগে, শাস্ত্রে কিন্তু বলা হয় অন্য কথা। সমানাধিকারের বেড়াজালে পুজোর যেটুকু আচার সেই সময়ে বর্তমান ছিল তাতে বিধবা নারীর প্রাধান্য কিন্তু বলছে সে যুগের ভিন্ন অবস্থানের কাহিনি।

দুর্গাপুজোর দশমীতে সিঁদুর খেলার ক্ষেত্রে কয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া বিধবাদের অংশ নিতে কতজনই বা দেখেছেন? অথচ সিঁদুরের সঙ্গে সধবা অর্থাৎ স্বামীর মঙ্গলের সম্পর্ক নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। সিঁথির সিঁদুর আর শাঁখা-পলা ঠিক কতটা যুক্তির, কতটা প্রামাণ্য প্রতীক, তাই নিয়ে প্রশ্ন ওঠার মধ্যেই সিঁদুর খেলায়, দুর্গাকে সিঁদুর পরানোর ক্ষেত্রে কতটা বিধিনিষেধ আরোপ করা যেতে পারে, কেন যেতে পারে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে নিরন্তর। মহাভারতের অর্জুনের সঙ্গেও জড়িয়ে ছিল এক বিধবার নাম! তবুও কেন এমন আচরণ?

শুধু পুজোয় নয়, গ্রামে গঞ্জের বিবাহ রীতিতে এখনও অঘোষিত প্রবেশ নিষিদ্ধ বিধবাদের। অর্থাৎ স্বামীর প্রতীক শাঁখা, সিঁদুর নেই বলে বিয়ের কাজে অংশ নিতে পারবেন না তিনি! এমনকী, নববধূর বরণ অথবা বিবাহের জন্য যাত্রায় উদ্যত বর, কোনও ক্ষেত্রেই বিধবার আগমন অযাচিত। অথচ এই বিধবাদেরই অবাধ যাতায়াত থাকে কোনও মৃত মানুষের বাড়িতে। যিনি মারা গিয়েছেন তিনি যদি হিন্দু পুরুষ হন, তাহলে তাঁর সধবা স্ত্রীর শাঁখা ভাঙতে, সিঁদুর মুছে দিতে ডাক পড়বে বিধবাদের। শুভ কাজ নয়, তথাকথিত দুঃখ-বেদনার অশুভের ইঙ্গিতে আপ্যায়িত হবেন বিধবারা। শাস্ত্রে কী বলছে? বেদে বিধবাদের নিয়ে বলা হচ্ছে,

“নষ্ট মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ, পচ স্বাপতসু নারীরাং পতিরণ্য বিধয়তে।।”

(পরাশর স্মৃতি, সংহিতা ৪/২৭)

অর্থাৎ নারীর স্বামী মারা গেলে, বিধর্মী হলে, সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হলে নারী আবার বিবাহ করতে পারে।

আবার ঋগ্বেদে (১০/১৮/৭-৮) বলা হয়েছে, “মৃত পতির স্ত্রী তোমার ভার্যা, সে পতিগৃহে সুখের কামনা করে মৃত পতির পরে তোমাকে প্রাপ্ত করেছে।”

অর্থাৎ বেদ-বেদান্তের যুগে বিধবাদের প্রাধান্য এবং তাঁদের বিবাহের কথা বলা হলেও মনু সংহিতার সমসাময়িক সময়ে পরিস্থিতির বদল ঘটে। বিধবা মানেই কালো অন্ধকার, বিধবা মানেই অশুভ অবস্থান- এই বিষয়টি ক্রমশ বাড়তে থাকে। যা একটা সময়ে গিয়ে আমিষ খাওয়ায় নিষেধ, সাদা বস্ত্র পরিধান, সাজের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা, যে কোনও ভালো ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ, স্বামীর মৃত্যুর পর সন্ন্যাসপ্রায় জীবনযাপনের ক্ষেত্র বাড়িয়ে তোলে আরও। বিধবার একাদশী পালন থেকে অম্বুবাচীতে মাটিস্পর্শ নিষেধ, পুরুষতন্ত্রের কঠোর অবস্থান এবং ব্রাহ্মণবাদের চাপিয়ে দেওয়া অবস্থানে আরও একঘরে হয়েছেন বিধবারা। অথচ এই পরিস্থিতি থেকে উঠে আসার চেষ্টা করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগররা। ১৮৫৬ সালে ইংরেজ শাসনে বিধবা বিবাহ আইন চালু হলেও এর কয়েকবছর আগে থেকেই মূলত মহারাষ্ট্র এবং বাংলায় বিধবাদের সঠিক অধিকার পাইয়ে দেওয়ার ভাবনা শুরু হয়। বিধবা বিবাহ আন্দোলন নিয়ে একটা বিরাট অংশের মানুষের বিদ্রোহের মধ্যেও ঢাকার রাজা রাজবল্লভ, কোটার রাজা, কলকাতার শ্যামচরণ দাসের মতো অনেকেই বিধবাদের অধিকার নিয়ে লড়াই করেছিলেন। কিন্তু প্রবল আপত্তিতে সফল হননি কেউ।

শুধু এই দেশেই নয়, পৃথিবীর বহু দেশে বিধবার আমিষ খাওয়ায় নিষেধের কুরীতির মতোই রয়েছে ভয়ংকর সব নিয়ম। বিবিসির একটি প্রতিবেদন বলছে, ঘানার উত্তরে বহু জনজাতির মধ্যে এখনও মৃত স্বামীকে স্নান করানোর পর সেই জল পান করানো হয় সদ্য বিধবাকে। যা এই দেশের সতীদাহের সঙ্গে অতুলনীয় হলেও এখনও কুসংস্কার আর তীব্র অন্ধকারের দাবদাহে পুজো, শুভ কাজে প্রবেশে বাধার পাথর বজায় রেখেছে। তথাকথিত শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত সমাজে বিষয়টি খুব একটা প্রাসঙ্গিক না হলেও, পর্দার আড়ালে তা দগদগে ঘায়ের মতোই সত্য। হিজাব পরতে বাধ্য করা বা পড়াশোনা করতে চেয়ে খুন হতে হওয়া, বা জীবনের সব আলো কেড়ে নিয়ে মানসিকভাবে খুন করা- মহিলাদের বঞ্চনার ইতিহাস নতুন করে বলার নয়।

কলকাতা স্টেশনে এসেছিলেন বৃন্দাবন থেকে আসা এক বৃদ্ধা। গত ১০ বছর ধরে বৃন্দাবনে এক জনপ্রিয় মন্দিরে ভিক্ষা করেন তিনি। কলকাতা আসেন অসুস্থ মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর সঙ্গে অনেক চেষ্টায় কথা বলে যা জানা গেল, সেই তথ্যও বলে দেয় অনেককিছুই। মালতী রায় (নাম পরিবর্তিত) বললেন, “আমি ওখানে (বৃন্দাবন) ভিক্ষা করি একথা আমার অনেক আত্মীয় জানে না। এরাই একদিন আমাকে চরিত্রহীন বলে তাড়িয়েছিল। আমার স্বামী মারা যাওয়ার পরে আমার মেয়ের অসুস্থতা বাড়ে। ওর চিকিৎসার জন্য ট্রেনে ট্রেনে ভিক্ষা শুরু করি। কিন্তু আত্মীয়রা তাতে অপমানিত হল। আমিও পিছিয়ে আসলাম। মেয়েকে একটি আশ্রমে রাখলাম। ট্রেনেই এক হকারের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম সম্পর্কে। ভাবলাম ভালোবাসবে। পারল না। আমাকে ব্যবহার করল। ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে সঙ্গে নিল, তারপর ছেড়ে দিল মথুরায়। চিনি না তখন কিছুই। কত খারাপ অভিজ্ঞতা হচ্ছিল রোজ। তারপর আমার মতো কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয়। সেখান থেকেই ভিক্ষা শুরু করি। এইভাবেই ভালো আছি। যদিও বিধবাদের আবার ভালো হয় নাকি।”

সম্প্রতি এক বিধবা মহিলার সঙ্গে এক যুবকের বিবাহের ঘটনায় শোরগোল পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করা হয় ভিডিও। আবার বহু বছর আগে উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ অঞ্চল থেকে নিজের গ্রাম ছেড়ে বারাসতে চলে আসতে হয় এক বিধবা মহিলাকে। সুমতি মণ্ডলের (নাম পরিবর্তিত) অপরাধ ছিল, দুই সন্তান রেখে স্বামীর অকাল মৃত্যুর পরেও তিনি কেন আবার বিয়ে করলেন! তিনি বিধবা হয়েও এই কাজ কেন করলেন! সুমতি জানালেন, “ছেলেদের বয়স তখন অনেক কম। এক জনের ৫ বছর, আর একজনের ৯। আমি ঘরের কাজ করতাম। ওদের বাবা মারা গেল হঠাৎ। গ্রামে থাকি। বছরখানেক লোকের বাড়ি কাজ করে কাটিয়ে দিলাম। তারপর একজনের সঙ্গে আলাপ হল। সে রাজি হল আমার ছেলেদের সঙ্গে নিয়েই আমাকে বিয়ে করবে বলে। পালিয়ে বিয়ে করলাম। আর পাড়ায় ঢুকতে পারিনি। আজ ছেলেরা বড় হয়েছে। সেও আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। এখনও লোকের বাড়িতে কাজ করি।”

আরও পড়ুন- কীভাবে মা লক্ষ্মীর বাহন হল নিশাচর পেঁচা? জানুন লক্ষ্মীপেঁচার নেপথ্যের কাহিনি

কলকাতার একটি মাছের বাজারে মাছ কাটেন দেবলা সিং। তিন সন্তান রেখে লিভারের ক্যান্সারে স্বামী মারা যান। তারপর থেকে বাচ্চাদের মানুষ করতে হিমশিম খেতে হয়েছে রোজ! এখনও অশক্ত শরীরে কাজ করেন। বিয়ে করেননি আর। গঞ্জনা নিয়েই বাঁচেন রোজ! তাঁর কথায়, “আমার স্বামী চলে যাওয়ার পরেই সব যেন শেষ হয়ে গেল। পড়াশুনা জানি না, তাই তেমন কিছুই করতে পারিনি জীবনে। লোকজন ভাবত আমি অপয়া, আমার জন্যই নাকি মারা গিয়েছে আমার স্বামী।”

প্রায় একই অবস্থা পরিচারিকার কাজ করা ডুলি দাসের। এক ছেলের মা তিনি। বাচ্চার যখন ৫ মাস বয়স, তখন দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারান। তারপর বেঁচে থাকতে হাত ধরেছিলেন আর একজনের। তিনিও মারা গিয়েছেন কয়েকবছর আগেই। তাই আজও ডুলি অপয়া। শুভ কাজ তো দূর, লোকের বাড়ির শৌচাগার পরিষ্কারের কাজ করতে হয় তাঁকে। ডুলি বলেন, “কী আর বলব, এসব এখন গায়ে সয়ে নিয়েছি। আমার লক্ষ্য আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখা। সকলে অপয়া বললেও আমার ছেলের তো আমি মা!”

শহর ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে আজও ভয়ানক পরিস্থিতি। প্রকাশ্যে এই বিধিনিষেধ চোখে না পড়লেও ঘরে ঘরে এখনও প্রচলিত সেই ব্রাত্য কথা। এখনও বিধবাদের জন্য নেই সমানাধিকার। সর্বত্রই বিধবা মানেই ‘অশুভ’ ভেবে নেওয়ার বদ্ধমূল ধারণার কুঅভ্যাস ঢুকে গিয়েছে শিরায় শিরায়। যেখানে পুজো নেই, নেই উৎসব, শুধুই হতাশা আর অন্ধকারের গ্লানি। ব্যতিক্রম আছে অবশ্যই। ক্ষমতায়ন ঘটছে নারীর, স্বাভাবিক অবস্থানে উঠে আসছেন বিধবারাও। কিন্তু অলিখিত নিষেধাজ্ঞা, অলিখিত নিয়ম আজও লিখিত বিধানের চেয়েও তীব্র।

More Articles