অটোদাদাদের জুলুম থেকে ছুটি, নতুন মেট্রোরুটে অফিসযাত্রীদের পৌষমাস?

আগেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির হাত ধরে উদ্বোধন হয়েছে কলকাতা মেট্রোর নতুন স্টেশনের। সাধারণ যাত্রীদের নিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই শুরু হয়েছে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইফ পর্যন্ত মেট্রো পরিষেবা।

এককথায় দাদাগিরি! অফিস টাইমে 'ঝোঁপ বুঝে কোপ'। আকাশ মেঘ করে এলে 'ঝোঁপ বুঝে কোপ' (রাস্তা পিছলও হয়নি, বৃষ্টি তো দূর!)। যাত্রীর ভিড় বাড়লে `ঝোঁপ বুঝে কোপ’। এটাই ছিল কলকাতার অটো যাত্রীদের বরাতলিখন। অটো চালকরা সুযোগের 'সদ্ব্যবহার' করবেন, এ আর কী এমন আশ্চর্যের। এতদিন এই সিস্টেমের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিল কলকাতা। কারণ ছিল না কোনও বিকল্প। তাই অটো চালকদের `দাদাগিরি’ বরদাস্ত করে এসেছিলেন নিত্যযাত্রীরা। এবার শহর পেল এক আশ্চর্য উপহার। যার নাম হতেই পারে মুক্তি। কীভাবে।

আগেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির হাত ধরে উদ্বোধন হয়েছে কলকাতা মেট্রোর নতুন স্টেশনের। সাধারণ যাত্রীদের নিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই শুরু হয়েছে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইফ পর্যন্ত মেট্রো পরিষেবা। অন্যদিকে একইভাবে সল্টলেক থেকে শিয়ালদহের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মেট্রো। সকাল থেকে এই ঐতিহাসিক যাত্রার সাক্ষী হতে শিয়ালদহ মেট্রোতে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। শুধুমাত্র এটা ঐতিহাসিক বিলাসবহুল সফর নয়, কলকাতার নিত্যযাত্রীদের কাছে এ হল আর একবার অপরিহার্য প্রত্যহিকীর ছোঁয়া পাওয়া। কারণ বাধ্য হয়ে যাঁদের এতদিন বাসে ঝুলতে ঝুলতে যেতে হত, তাঁরা মুক্তি পেলেন। যাঁরা এতদিন মুখ বুজে অটো চালকদের দাদাগিরি বরদাস্ত করেছেন, এ তাঁদের কাছে মুক্তি। এখন আর অটো চালকদের অন্যায় ভাড়ার জুলুম বরদাস্ত করতে হবে না। আকাশ মেঘলা করলেই ভাড়ার তানাশাহি এ দিন এখন অতীত। ফলে কলকাতার নিত্যযাত্রীরা আনন্দে উদ্বাহু নৃত্য না করুন, স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারেন। মেট্রোর সৌজন্যে কলকাতাবাসীর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি ঘটল ঠিকই, কিন্তু এর ফলে চিন্তার ভাঁজ অটো চালকদের কপালে। আশ্চর্যরকমভাবে এদিন থেকে তাঁদের অটোতে যাত্রীর সংখ্যা কমেছে। ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না তাঁরা। কারণ তাঁরা মনে করছেন, এতে দুর্মূল্যের বাজারে তাঁদের পেটে লাথি মারল মেট্রো। এর থেকে বেরানোর উপায় খুঁজছেন তাঁরা। তবে একটা কথা বলাই যায়, অটোর ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীলতা কমেনি, কারণ মেট্রো থেকে নেমে কখনও কখনও গন্তব্যে পৌঁছানো জন্য আপনার ভরসা কিন্তু এই তিনচাকার বাহনটাই।

মেট্রো রুটে অটো

বৃহস্পতিবার শিয়ালদহ থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ মেট্রো পরিষেবা শুরু হওয়ায় অটো রুটের বেশিভাগ যাত্রীরা বেছে নিয়েছেন মেট্রো যাত্রা। এর ফলে ভিড় হচ্ছে না অটোতে। রুটিরুজিতে টান পড়ার আশঙ্কায় তাঁরা। শিয়ালদহ থেকে মূলত আটটি অটো রুট রয়েছে। এগুলো হল – শিয়ালদহ-ধাপা, শিয়ালদহ-বৈশালী, শিয়ালদহ-এন্টালি, শিয়ালদহ-পটারি, শিয়ালদহ-বেলেঘাটা বাইপাস(বিল্ডিং মোড়), শিয়ালদহ-তপসিয়া, শিয়ালদহ-বামনঘাটা, শিয়ালদহ-মেট্রোপলিটান। এই সব রুট মিলিয়ে মোট অটো রয়েছে ৩৬০ টি। প্রায় ২৫০ টি অটো প্রতিদিন রাস্তায় নামে যাত্রী বহন করতে। এক একটি অটো সারাদিন ১০ বার ট্রিপ খাটে। শিয়ালদহ ও সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে নতুন মেট্রো পরিষেবা চালু হওয়া মানে শহর থেকে এই বিপুল সংখ্যক অটো উবে যাওয়া নয়। বরং কলকাতাবাসী এদিন থেকে পেল এক বিকল্প সফরের স্বাদ।

অটো বনাম মেট্রো ভাড়া

বলাই বাহুল্য, ভাড়ার জুলুম বারদাস্ত করতে করতে তা সয়ে নিয়েছিলেন অটোযাত্রীরা। কারণ তাঁরা তো গন্তব্যে পৌঁছাতে বাধ্য। হাতের সামনে নেই কোনও বিকল্প। আর এই সুযোগটাকেই পুরোদস্তুর কাজে লাগিয়েছেন অটো চালকরা। কখনও আকাশ মেঘলা হলেই তাঁরা হাঁকিয়েছেন যথেচ্ছ ভাড়া। কিন্তু প্রকৃত ভাড়া যথচ্ছ নয়।

যে সব নিত্যযাত্রীরা এখন শিয়ালদহ থেকে ফুলবাগান অথবা বাইপাসের দিকে যেতে চান, তাঁরা ট্রেন থেকে নেমে কাইজার স্ট্রিটের অটো স্ট্যান্ড থেকে অটো ধরে পৌঁছে যান গন্তব্যে। শিয়ালদহ থেকে ফুলবাগান সাধারণ সময় ভাড়া লাগে প্রায় ১২ টাকা। বেঙ্গল কেমিক্যাল বা বাইপাসের ওপর মানি স্কয়ার যাওয়ার জন্য কুড়ি টাকা বা তার বেশি খরচ করতে হয় যাত্রীদের। এখন শিয়ালদহ স্টেশন থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেট্রোরেল করে ফুলবাগান অথবা বেঙ্গল কেমিক্যালস যেতে খরচ হবে মাত্র ১০টাকা। এছাড়াও সঙ্গে বাড়তি পাওনা স্বাচ্ছন্দ্য।

খুশি যাত্রীরা, মাথায় হাত অটো চালকদের

শিয়ালদহের সঙ্গে জুড়ে গেল সেক্টর ফাইভ। সোমবার উদ্বোধন হয়েছে বহু প্রতিক্ষিত মেট্রোর এই নতুন রুটের। এই খবরে খুশির জোয়ারে ভেসেছে কলকাতা থেকে মফসঃস্বলের যাত্রীরা। এবার থেকে অনেক কম খরচে, অনেক দ্রুত, অনেক আরামে শিয়ালদহ থেকে অফিস পৌঁছাতে পারবেন নিত্যযাত্রীরা। বৃহস্পতিবার শুরু হল এই সফরের। আগে শিয়ালদহ নর্থ ও মেইন শাখার যাত্রীদের সেক্টর ফাইভ যেতে হলে বিধাননগর স্টেশনে নেমে সেখান থেকে অটো ধরে সেক্টর ফাইভ বা করুণাময়ী যেতে হত। আর দক্ষিণের শাখার যাত্রীদের একাংশ পার্কসার্কাসে নেমে সেখান থেকে বাসে করে গন্তব্যে পৌঁছাতেন। অনেকে শিয়ালদহ থেকে বাস বা অটোয় করে যেতেন। এবার সেই সমস্যা থেকে মুক্তি। এই মুক্তির আনন্দের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এতে আশঙ্কার কালো মেঘ জমেছে অটো চালকদের কপালে। চিন্তার ভাঁজ শুধু শিয়ালদহ অঞ্চলের অটো চালকদের মধ্যে নেই, আশঙ্কিত বিধাননগর রোড থেকে সেক্টর ফাইভের দিকে চলা অটো চালকরাও। কলকাতার দক্ষিণ ও উত্তর শহরতলীর দৈনন্দিন প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ ওই রুটে যাতায়াত করতেন। মেট্রোর মতো সুবিধাজনক পরিষেবা চালু হওয়ায় যথেষ্ট সমস্যার মুখে পড়বেন অটো চালকরা।

সমাধানের খোঁজ

একটা সময় শহরে সামগ্রিক ট্র্যাফিক চাপ কমাতে ভূগর্ভস্থ ট্রেন চালানোর কথা ভাবেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। এরপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কলকাতা পায় তাঁর স্বপ্নের পাতাল পেল। ফলে তখন থেকে পাল্টে যায় শহরের পরিবহণের চিত্রটা। এতে কি শহরে থেকে উঠে গেছে বাস, ট্যাক্সি, অটো? তাহলে এখনও উবে যাবে না একটা নির্দিষ্ট রুটের অটো। বরং শহরের ট্র্যাফিকের চাপ কমবে। যাত্রী চাপ কমবে অটোর ওপর, এটা ঠিক। এটাও ঠিক যে এতে তাঁদের আশঙ্কার কারণ আছে। তাঁদের রোজগারে যাতে টান না পড়ে তার জন্য তো বিকল্প প্যাকেজের ব্যবস্থাও হতে পারে। এই নিয়ে সরকারের ভাববার অবকাশের কথা মাথায় রেখেই বলা যায়, শহরবাসী কেন পাবে না একটা সুন্দর সফরের স্বাদ? এই সময় তো এতদিনে এল। এরসঙ্গে বলে দরকার, যে অটোচালকদের দাদাগিরি, তানাশাহি এতদিন বরদাস্ত করেছেন নিত্যযাত্রীরা, আজ মেট্রোর সৌজন্যে সেই দিনগুলো থেকে মুক্তি। কলকাতাকে একটা `ভব্য’ সফর উপহার দেওয়ার ভাবনা কি আদৌ ভাববেন না `অটোদাদারা’?

More Articles