সন্দেশখালি কি আজকের নন্দীগ্রাম?
Sandeshkhali : হেরোইন ব্যবসা থেকে শুরু করে গরুপাচার, কাঠপাচার এমনকী মানুষ পাচারের অভিযোগও ওঠে শাহজাহানের বিরুদ্ধে।
শাসকদলের হাত মাথায় আছে। ফলে এলাকা দখল করে যা খুশি তাই করার ছাড় রয়েছে 'স্থানীয় নেতা'দের। দীর্ঘদিনের এই অত্যাচারকে প্রতিহত করতে মানুষ জোট বাঁধলে কী হয় তার প্রমাণ সন্দেশখালি। তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের সাম্রাজ্য সন্দেশখালিতে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ সামান্য অবস্থান-বিক্ষোভ নয়। সন্দেশখালির মানুষের এই জোটবাঁধা মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০১১ সাল, মনে করিয়ে দিচ্ছে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম। শাসকদল সিপিএমের বিরুদ্ধে জোর করে জমি অধিগ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল। সাধারণ মানুষের বিক্ষোভকে রাজনৈতিকভাবে চালিত করে সিপিএমের আসন টলিয়ে দেয় তৃণমূল। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম এক বাঁক বদল করা আন্দোলন। লোকসভা নির্বাচনের মুখোমুখি এসে সন্দেশখালিতেও কি সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের ছায়াই দেখা যাচ্ছে?
গত বুধবার থেকে অশান্ত হয়ে উঠেছে উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি। শেখ শাহজাহান ও তাঁর সঙ্গীদের গ্রেফতারের দাবি ঘিরে হইচই পড়েছে। পথে নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন সাধারণ মানুষ, বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহিলারা। এই মহিলাদের অধিকাংশই অভিযোগ করেছেন বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তাঁদের, শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠছে তৃণমূলের এই নেতাদের বিরুদ্ধে। বাঁশ, দা, কাটারি নিয়ে তাই সরাসরি রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ, থানা ঘেরাও। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, জোর করে জমি দখল করে নেওয়া থেকে শুরু করে কাজ করিয়ে টাকা না দেওয়া, হকের টাকা চাইতে গেলে মারধর, মহিলাদের শারীরিক নিগ্রহ- বাদ নেই কিছুই।
কে এই শেখ শাহজাহান?
কোনও বড় হোমড়াচোমড়া নন, সামান্য উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের মৎস্য কর্মাধ্যক্ষ আর সন্দেশখালি ১-ব্লকের তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি। কিন্তু সেই ব্লক নেতারই বাড়ি দেখলে টের পাওয়া যায় কেন সন্দেশখালিকে তাঁর সাম্রাজ্য বলা হয়। রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, যিনি রেশন দুর্নীতি মামলায় জেলবন্দি, তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এই শাহজাহান। বাম জমানার একেবারে শেষ দিক থেকে এলাকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা শুরু করেন শাহজাহান। ধীরে ধীরে হেরোইন ব্যবসা থেকে শুরু করে গরুপাচার, কাঠপাচার এমনকী মানুষ পাচারের অভিযোগও ওঠে শাহজাহানের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন- ফের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেই আস্থা! কেন মমতাকে সবচেয়ে বেশি ভোট দেন মহিলারা?
২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে শাহজাহান সরাসরি ক্ষমতার কাছাকাছি রইতে তৃণমূলে যোগ দেন। 'সাংগঠনিক দক্ষতা' দেখেই নাকি তাঁকে দায়িত্ব আর ক্ষমতা দুইই দেওয়া হয়। ক্রমেই প্রতিপত্তি বাড়তে বাড়তে গোটা এলাকায় নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন শাহজাহান। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বসিরহাট আসন থেকে তৃণমূল প্রার্থী নুসরাত জাহানকে জেতাতেও বড় ভূমিকা ছিল শাহজাহানের। দলের অন্দরের খবর, নুসরাতকে জেতানোর পুরস্কার হিসেবেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাহজাহানকে টিকিট দেওয়া হয়, তাতে জিতেই জেলা পরিষদের মৎস্য কর্মাধ্যক্ষ হন তিনি। ধীরে ধীরে রেশন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে তার নাম। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক গ্রেফতার হতেই ইডির রাডারে আসেন শাহজাহান। শেখ শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি করতে গিয়ে মার খেয়ে, রক্তাক্ত হয়ে পালাতে হয়েছে ইডি আধিকারিকদের, শাহজাহানের অনুগামীদের তাড়ায় পিছু হঠেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী, সাংবাদিকরাও।
২০১৯ সালে সন্দেশখালি ১ ব্লক অফিসে ঢুকে বিডিওকে ব্যাপক মারধরে নাম জড়ায় শাহজাহানের। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বিধ্বস্ত এলাকায় মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী ত্রাণ নিয়ে গেলে সেই ত্রাণ লুঠ করে নেয় শেখ শাহজাহানের অনুগামীরা। তৃণমূলের মধ্যেই শাহজাহানের অবস্থান একদিকে খুবই শক্তপোক্ত অন্যদিকে আবার তেমনই অনেকের কাছেই চক্ষুশূল তিনি। এলাকায় যথেচ্চ অত্যাচার চালানো এই তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতারের দাবি উঠেছে তাই, দাবি উঠেছে লোক ঠকিয়ে হাতিয়ে নেওয়া জমি ফেরতের। জমি রক্ষা কমিটি এবং আদিবাসীদের সংগঠন এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছে। সন্দেশখালি থানা এলাকায় ১৪৪ ধরা জারি হয়েছে, নেই ইন্টারনেট যোগাযোগ।
বিজেপির বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী আগেও বলেছেন, মাছের বহু ভেড়ি ও মাছ প্রক্রিয়াকরণ প্লান্ট, ইট ভাটা এবং একটি শপিং কমপ্লেক্সের মালিক তিনি। পার্কসার্কাসে কয়েক কোটি টাকার বাড়ি রয়েছে শাহজাহানের। সন্দেশখালির মানুষের একাংশ বলছেন এই বিক্ষোভ সুসংবদ্ধ করার নেপথ্যে হাত রয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও বিজেপির। বিজেপির অভিযোগ, শাহজাহান বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এসে ক্যাম্প করে রাখেন সন্দেশখালিতে। বিজেপির ৩ নেতাকে খুনের অভিযোগ রয়েছে শাহজাহানের বিরুদ্ধে। একজনের দেহ মেলেনি এখনও। শোনা যায়, এরপর থেকেই এলাকায় ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি শুরু করে বিজেপি।
আরও পড়ুন- বরাদ্দ কোটি কোটি টাকা! ভোটের আগে যেভাবে তাক লাগাল মমতার ‘কল্পতরু’ বাজেট
ইডির অভিযানের পরেই সংবাদমাধ্যমের যাতায়াত বাড়ে সন্দেশখালিতে। জনগণের বিক্ষোভ সরাসরি ধরা পড়ে ক্যামেরায়। তৃণমূল নেতা শিবু হাজরার পোলট্রি ফার্মে আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। তাঁর বাড়ি এবং বাগানবাড়িতেও আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। একদিকে সন্দেশখালির নন্দীগ্রাম হওয়া আটকাতে মরিয়া শাসক তৃণমূল। জমি ঘিরে এই আন্দোলন থামাতে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি অভিযান চলছে, তৃণমূল নেতা উত্তম সর্দারকে গ্রেফতার করা হয়েছে, প্রশাসনিক পদও গিয়েছে তাঁর। শিবপ্রসাদ হাজরার ক্ষেত্রেও তৃণমূল একই ব্যবস্থা নিতে পারে বলে জানা যাচ্ছে। তা হলে জমি আন্দোলন কিছুটা দুর্বল হবেই। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারী ঘটনাটিকে নন্দীগ্রামের আন্দোলনের দিকেই যে নিয়ে যাচ্ছেন তা বোঝা যাচ্ছে তাঁর ক্ষিপ্রতা দেখেই। রাজ্যপাল তাঁর কথা শুনেই সোমবার হাজির হয়েছেন সন্দেশখালিতে। সন্দেশখালিতে বাম নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়েরও যাওয়ার কথা। সন্দেশখালির প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক নিরাপদ সর্দারকে গ্রেফতার করা হয়েছে শিবু হাজরার অভিযোগের প্রেক্ষিতে। নিরাপদ সর্দারের বিরুদ্ধে হিংসায় প্ররোচনা দেওয়া, উস্কানিমূলক কথাবার্তা, আদিবাসীদের ক্ষেপিয়ে তুলে আন্দোলনকে সংগঠিত করার অভিযোগ তুলছে তৃণমূল।
সন্দেশখালি কি সত্যিই আগামীর নন্দীগ্রাম হয়ে উঠতে চলেছে? জমির লড়াই আর শাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষের এই জোটবাঁধা তৃণমূলের কাছে কতখানি বিপদের? সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনে সরাসরি মাঠে নেমে লড়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নেতৃত্বেই তৃণমূল ব্যাপকভাবে শাসক সিপিএমের বিরুদ্ধে মানুষের আন্দোলনকে চালিত করে। সন্দেশখালির এই আন্দোলনকে কি নেতৃত্ব দেওয়া মতো মুখ রয়েছে বিরোধীদের? রয়েছে সেই সাংগঠনিক ক্ষমতা? যদি এই আন্দোলন জোট বাঁধেও, তাতে কি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতোই বুদ্ধিজীবীদের অংশ নিতে দেখা যাবে? এখনও অবধি ভাঙড় হোক বা সন্দেশখালি 'সুশীল সমাজের' ভূমিকা চোখে পড়েনি কোথাওই যেমনটা ছিল ২০১১ সালে। লোকসভা নির্বাচনের আগে কতখানি বাঁক বদল করা ঘটনা হয়ে উঠতে চলেছে সন্দেশখালি?