মোদির তৃতীয় দফায় কি বিকল্প মিডিয়ার মুখ বন্ধ করা হবে?

Independent Media: সারা বাংলা জুড়ে, কীভাবে এই বিকল্প সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে, বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির প্রচার করা হয়েছে, তা বহু মানুষের কল্পনার বাইরে।

এবারের নির্বাচনে শাসক বিরোধী লড়াইয়ে জনতার পক্ষ নিয়েছিল বিকল্প সংবাদমাধ্যম। আর সেখানেই বিপদ। বিজেপির 'কুখ্যাত' আইটি সেল নিজস্ব কায়দায় ইউটিউব এবং বিকল্প সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করলেও, বিরোধীদের কন্ঠ বন্ধ জন্য এবার অন্য কোনও নতুন উপায় বেছে নিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সংসদের অধিবেশন বসতে চলেছে। শোনা যাচ্ছে, প্রথম রাতেই বেড়াল মারতে চাইবে বিজেপি। বিকল্প গণমাধ্যমকে আক্রমণ করে বিল আনা হতে পারে। এএনআই সংবাদ সংস্থার অন্যতম মাথা, স্মিতা প্রকাশ একটি পডকাস্ট করেছেন, তাতে বেশ কিছু সাংবাদিকের নাম করে বলেছেন। তাঁর দাবি, এই ব্যক্তিরা ইউটিউবকে ব্যবহার করে, সরকার বিরোধী প্রচারকে একটা আন্দোলনের রূপ দিয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে, সামনের দিনে আরও ভয়ঙ্কর কিছু আসতে চলেছে। বেশ কিছু ইউটিউব চ্যানেল যে তাদের নজরে আছে, তা বুঝতে কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এই আক্রমণের আশঙ্কার একটি প্রেক্ষাপট আছে।

এবারের লোকসভা নির্বাচনকে যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, এই রায় শুধুমাত্র বিজেপির বিরুদ্ধে রায় নয়। এই রায় অনেকটাই শাসকদলের মদতপুষ্ট গণমাধ্যমের (যাকে চালু লব্জে গোদি মিডিয়া বলে) বিরুদ্ধেও। ২০১৪ সাল থেকে যেভাবে মানুষকে রোজ ঘৃণাভরা খবর, মিথ্যে খবর পরিবেশন করা হয়েছে, যেভাবে প্রতিটি সংবাদ সংস্থাকে করায়ত্ত করা হয়েছে, যেভাবে নিজেদের অনুকূলে খবর করানোর জন্য বাধ্য করা হয়েছে, তা অতুলনীয়। ইতিমধ্যে সামাজিক মাধ্যম জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে, মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন এসে যাওয়ায় সাংবাদিকতায় প্রবেশের সুযোগ বেড়েছে। যে সাংবাদিকরা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা বুঝেছেন এই সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করেই সাংবাদিকতা করা সময়ের দাবি। অন্য দিকে শাসক আরও আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছে প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়াকে। রাজ্যের ক্ষেত্রেই হোক বা দেশের ক্ষেত্রে, বেশিরভাগ মানুষ প্রথাগতভাবে বিরোধীদের কথা শুনতে চান। যে সাংবাদিকরা প্রচলিত গণমাধ্যম থেকে ইস্তফা দিলেন, তাঁরা কিন্তু বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তাঁরা দ্রুত নিজেদের স্ট্র‍্যাটেজি ঠিক করে নেন। লাগাতার প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করে গিয়েছেন তারা।

আরও পড়ুন: সাংবাদিকদের উপর রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলার বিকল্প সংবাদমাধ্যমের সমস্বর

এদিকে রাহুল গান্ধী যখন কন্যকুমারিকা থেকে কাশ্মীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ করেন, তিনিও সিদ্ধান্ত নেন, কোনও প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন না। বেছে নেন, ছোট ছোট ইউটিউব চ্যানেল এবং বিকল্প কিছু ছোট ছোট সংবাদসংস্থাকে। সেই যাত্রার ভিডিও এবং ছবি এমন মাত্রায় প্রচারিত হয়, যে প্রচলিত গণমাধ্যম বাধ্য হয় সেই খবর প্রকাশ করতে। পরবর্তীতে বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যে প্রতিদিন যে বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলোতে সান্ধ্য বিতর্কের নামে, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হয়, তা বন্ধ করার একমাত্র উপায়, এই বিতর্কগুলোতে অংশ না নেওয়া। এই প্রচলিত গণমাধ্যমের বিপরীতে বিকল্প গণমাধ্যমের যে বাস্তুতন্ত্র, এবারের নির্বাচনে তার উপস্থিতি অস্বীকার করা যাবে না কোনোমতেই।

আরো একটি বিষয়, এই বিকল্প গণমাধ্যম নিয়ে আলোচনায় আসা উচিত। শুধু কি বিরোধীরাই এই বিকল্প ব্যবস্থার সুবিধা নিয়েছেন? শাসক দল কি কোনও রকম সুবিধা নেয়নি? সামাজিক মাধ্যমের এই রবরবার মধ্যে সেটা কি সম্ভব?

যাঁরা এই দশ বছরে, শাসক দলের ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানোর নকশাটা খেয়াল করেছেন, তাঁরা জানেন, ব্লু প্রিন্টটা ঠিক কী। বড় গণমাধ্যমগুলো সচেতনভাবে যে অনুষ্ঠানগুলো করেছে, তার ইউটিউব ভিডিও তাঁরা সামাজিক মাধ্যমে ছাড়ে। বিজেপির যাঁরা প্রচার করেন, তাঁরা সেই সমস্ত ইউটিউব ভিডিও থেকে, পছন্দমতো জায়গা ডাউনলোড করে হোয়াটসঅ্যাপ মারফৎ ছড়িয়েছে। পুরো উত্তরভারত জুড়ে, বহু ইউটিউব ভিডিও তৈরি হয়েছে, যার বেশির ভাগ খুব জনপ্রিয় হয়েছে। এই গানগুলো ডিজে বক্সে উচ্চস্বরে বাজিয়েই রামনবমীর মিছিলে মসজিদ কিংবা মাজারের সামনে উগ্র হিন্দুত্ববাদী মানুষজন শক্তি প্রদর্শন করেছে।

 

অনেকে হয়তো ভাবতেই পারেন, এইটা উত্তর ভারতের সংস্কৃতি। এর সঙ্গে বাংলার কোনও যোগাযোগ নেই, তাঁদের অবগতির জন্য জানানো উচিৎ, গত ২০২৩ সালের দুর্গাপুজোর সময়ে কলকাতার সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে যে রামমন্দিরের আদলে মণ্ডপ নির্মাণ করা হয়েছিল, সেই জায়গাতেও ঐ উত্তরভারতের জনপ্রিয় কিছু কিছু গান বাজানো হয়েছিল। এবার অনেকে বলতে পারেন, এই গান সাধারণ মানুষের মনের খুব ভিতরে প্রবেশ করতে পারেনি, যেখানে অযোধ্যাতেই শাসক দলের প্রার্থী পরাজিত হয়েছে, সেখানে এই ধরনের গান নিয়ে খুব বেশি আলোচনা না করলেও চলবে, তাঁদের জন্য কিছু তথ্য দেওয়া প্রয়োজন।

সারা বাংলা জুড়ে, কীভাবে এই বিকল্প সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে, বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির প্রচার করা হয়েছে, তা বহু মানুষের কল্পনার বাইরে। গ্রামে এবং মফস্বলে বহু কীর্তনিয়া পাড়ায় পাড়ায় কীর্তনের মাধ্যমে এই কাজটা করেছেন, সেগুলোর ইউটিউব ভিডিও করা হয়েছে এবং সেগুলো যে ভাবে জনপ্রিয় হয়েছে, তা দেখলে অবাক হতে হয়। বিভিন্ন স্থানীয় টিভি চ্যানেলেও এই কীর্তন চলে এবং গৃহস্থ বাড়ির মহিলারা আপ্লুত হয়ে তা দেখেন, তা দেখলে মনে হবে, দেশের সব সমস্যার সমাধান এই কীর্তনীয়াদের কাছে আছে। ঠিক যে পদ্ধতিতে রানাঘাটের বিজেপির বিধায়ক কবিগান করে প্রচার করেন, সেই পদ্ধতিতেই মানুষের মাথার কোষে কোষে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, সংখ্যালঘুর প্রতি ঘৃণা। এই লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালিকে এক রকম করে মগজ ধোলাই করা হয়েছে। আর গরিব মানুষের জন্য অন্য প্রক্রিয়া নেওয়া হয়েছে।

এমনিতে কীর্তনের মধ্যে দিয়ে রাধা কৃষ্ণের প্রেম, চৈতন্যদেবের ভালবাসার প্রচার করার কথা, কিন্তু বিজেপি এই বহুল প্রচারিত কীর্তন এবং কবিগানের আঙ্গিক ব্যবহার করে নিজেদের কাজ করে গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ব্যতিক্রমী অবশ্যই দীনকৃষ্ণ ঠাকুর, যিনি এই নির্বাচনের আগে খবরের শিরোনামে এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কীর্তন আঙ্গিক নিয়ে যা করা হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে, তা ভুল। কীর্তনীয়ারা যে কোনও ভাবে এই বিজেপির রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সমাজে ভুল বার্তা দিচ্ছেন।

মনে রাখব, এই ২০২৪ সালেই সারা বিশ্বের নিরিখে, ভারত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে নীচে নামতে নামতে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫৯ নম্বরে এসে ঠেকেছে। ২০১৪ সালে ভারত ছিল ১৪০ নম্বরে। কথায় কথায় যারা বলে থাকেন, ভারতে যদি না থাকতে ইচ্ছে হয়, তাহলে পাকিস্তান চলে যেতে, সেই প্রতিবেশী পাকিস্তানও নিজেদের মান উন্নতি করেছে। ২০১৪ সালে তাদের স্থান ছিল ১৫৮, আজ দশ বছর পরে তারা ১৫২ তে নিয়ে গেছে নিজেদের। তৃতীয়বারে নরেন্দ্র মোদীর যিনি জোটসঙ্গী, সেই চন্দ্রবাবু নাইডু, কিন্তু ইতিমধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের হিসেবেই চলবেন আপাতত। অন্ধ্র প্রদেশে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার পরে, তিনি কিন্তু তাঁর অপছন্দের চারটি তেলেগু চ্যানেলকে বন্ধ করে দিয়েছেন। রাজ্যের বহু জায়গায় তা আর দর্শকেরা দেখতে পাচ্ছেন না। অভিযোগ উঠেছে, সরকার পক্ষের চাপে, কেবল অপারেটরা, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় এই চ্যানেলগুলোর প্রদর্শন বন্ধ করেছেন। বিরোধী ওয়াই এস জগন্মোহন রেড্ডী এবং কংগ্রেস বলেছে, এই পদক্ষেপ বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। যদিও কেবল অপারেটরা স্বীকার করেননি, তবুও বোঝাই যাচ্ছে, কোন অদৃশ্য চাপে তারা এই কাজটা করেছেন।

আরও পড়ুন: মোদিকে কতটা ‘ভালোবাসে’ বিদেশের সংবাদমাধ্যম? বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ্যে

গত নির্বাচনে বিকল্প গণমাধ্যম কিছুটা সাফল্য পেয়েছে, তা আমরা অনেকেই জানি। শুধু পুরো দেশেই নয়, এই বাংলাতেও অনেক সরকার বিরোধী কথা আমরা শুনতে পেয়েছি এবং এখনও পাচ্ছি। আরো বহু মানুষ এগিয়ে আসছেন, নতুন নতুন ইউটিউব চ্যানেল নিয়ে, নতুন নতুন খবরও পাওয়া যাচ্ছে। তবে আশঙ্কা, এই নির্বাচন থেকে 'শিক্ষা' নিয়ে আগামীদিনে কিন্তু এই বিকল্প স্বর বন্ধ করার জন্য নানা পদ্ধতি সরকার নেবে। সরকারের সমর্থক একাংশ অনবরত এই চ্যানেলগুলো সম্পর্কে অভিযোগ করবে। সোজাসুজি ইউটিউবকে চাপ দেওয় হবে। কর্পোরেট সংস্থারাও এই দেশে ব্যবসা করার জন্য, সরকারের কথাই তারা শেষপর্যন্ত মেনে নেবে তা বলাই বাহুল্য। যদিও মনে রাখতে হবে, হোয়াটসঅ্যাপ বলেছিল, যদি এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন খুলে দিতে হয়, তবে এদেশে ব্যবসা রাখবেন না তারা।

যাঁরা গোদি মিডিয়ার বিকল্প হিসেবে এই ধরনের ইউটিউব চ্যানেল থেকে খবর সংগ্রহ করবেন, তাঁরা যেন মনে রাখেন, এই ধরনের সামাজিক মাধ্যম একমাত্র বিকল্প নয়। যে কোনও স্বৈরাচারী শাসককে পরাজিত করতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাস্তায় নামা ছাড়া কোনও পথ নেই। একদিন আশা করা যায়, নির্ভীক সাংবাদিকতা আবার ফিরে আসবে, একদিন আবার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভারত তাঁর ‘সংবিধান’কে আবার পুর্ণপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে। সেই ইঙ্গিত আজকে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই পাওয়া গেছে। বিরোধীরা প্রত্যেকে ‘সংবিধান’ এর একটি ছোট সংস্করণ নিয়ে সংসদে প্রবেশ করেছে। বোঝাই যাচ্ছে, সামনে জোরদার লড়াই অপেক্ষা করছে। সংবিধান বাঁচানোর লড়াই, দেশ বাঁচানোর লড়াই, দেশকে দ্বেষমুক্ত করার লড়াই।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

 

More Articles