শীতকাতর কলকাতায় সুস্বাদু চিনে খাবার খেতে কোথায় যাবেন? রইল সেরার সেরা ঠিকানা

Kolkata Chinese: মহানগরের আনাচ-কানাচে এমন অনেক রেস্তোরাঁ রয়েছে, যেখানে পেতে পারেন ১০০ ভাগ খাঁটি চিনে খাবারের স্বাদ।

ভাত-মাছ আর বিরিয়ানির বাইরে বাঙালির সবচেয়ে পছন্দের ডিশ হলো চাইনিজ। হবে নাই-ই বা কেন! সেই ১৮ শতক থেকে বাঙালি আর চিনারা একসঙ্গে ওঠা-বসা করছেন। তাই চিনা খাবারের প্রতি বাঙালির ঝোঁক থাকাটা তো স্বাভাবিক।

একদিকে কল্লোলিনী তিলোত্তমা ব্রিটিশ শাসনে হয়ে উঠছে এক মহানগর, অন্যদিকে চিনদেশ থেকে হাজারে হাজারে মানুষ মহাসমুদ্র পেরিয়ে এসে পৌঁছচ্ছে সেই মহানগরের তীরে। কালক্রমে কলকাতার বুকে গড়ে উঠছে এক নয়, দু'-দু’টি চিনাপাড়া। মধ্য কলকাতার টেরিটি বাজারের চিনে বসতি অপেক্ষাকৃত বেশি পুরনো হলেও, অচিরেই বাইপাসের ধারে অবস্থিত ট্যাংরাও নিজগুণে হয়ে উঠেছে কলকাতার অন্যতম চৈনিক অঞ্চল। স্বাভাবিকভাবেই সঙ্গে সঙ্গে হয়েছে চিনা খাবারের বিকাশ। সমীক্ষায় দেখা যায়, বিশ্বের ভোজনবিলাসীদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি মানুষের প্রথম পছন্দ চাইনিজ খাবারই। কলকাতায় বহু নামী-দামি চিনে খাবারের দোকানের কথাও আমরা জানি। কিন্তু এই মহানগরের আনাচ-কানাচে এমন অনেক কম-খ্যাত রেস্তোরাঁও রয়েছে, যেখানে আপনি পেতে পারেন ১০০ ভাগ খাঁটি চিনে খাবারের স্বাদ। যা কলকতাবাসীদের কাছে পরিচিত হলেও, দেশের বাকি প্রান্তের মানুষদের কাছে যথার্থই লুকোনো সম্পদ, হিডেন জেমস।

টুং নাম
টেরিটিবাজারের প্রাণকেন্দ্রে, চাইনিজ গির্জার পাশেই একচিলতে টুং নাম, বলা চলে কলকাতার চাইনিজের শ্রেষ্ঠ ঠিকানা। গোল গোল টেবিলে খাঁটি চিনা পন্থায় খাওয়াদাওয়া, এখন তাও চামচ মেলে, আগে ভরসা ছিল চপস্টিকই। সরু রাইস নুডলস থেকে হাক্কা, চিলি গার্লিক পিপার পর্ক থেকে কুং পাও চিকেন- খাঁটি চিনে স্বাদের জন‍্য আসতেই হবে এখানে।

আরও পড়ুন: চিনে খাবারের স্বর্গরাজ্য, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে কলকাতার এই এলাকা

ইউ চু
কলকাতা শহরের প্রাচীনতম চাইনিজ খাবারের দোকানগুলির মধ্যে একটি হলো ইউ চু। চতুর্থ প্রজন্মের মালিক জোয়েল হুয়াং এখন দেখাশোনা করেন এটি। তাঁর মা জোসেফাইন লি ইং হুয়াং বিখ্যাত জোসেফাইন নুডলস তৈরি করেছিলেন, যেটি এখনও খাদ্যরসিকদের প্রিয়। এই রেস্তোরাঁয় মুখরোচক প্যান-ফ্রায়েড নুডলসে চিকেন, চিংড়ি, মাশরুম এবং অন্যান্য শাকসবজি জিভে জল এনে দিতে বাধ্য। ইউ চু চিমনি স্যুপের জন্যও পরিচিত— সবজি, মাংস এবং ডিম-সহ ধোঁয়া ওঠা স্যুপ, যা শীতকালে আমাদের মন ভুলিয়ে দেবেই। গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের এই দোকানকে আপনি কলকাতার চিনে খাবারের অন্যতম পীঠস্থান বলে ধরে নিতেই পারেন।

চাউম্যান
কলকাতার চাইনিজ রেস্তোরাঁর মধ্যে নতুন সংস্করণ গল্ফগ্রিনের চাউম্যান। এই রেস্তোরায় পা দিলে বৌদ্ধিক শান্তি এবং চৈনিক সভ্যতা একসঙ্গে সুর তৈরি করবে। যাঁরা স্যুপ ভালবাসেন তাঁরা আস্থা রাখুন চাউম্যান-এর নিজের পছন্দে সাজিয়ে দেওয়া লেমন পিপার স্যুপ বা থিক মিক্সড মিট স্যুপে। আর কলকাতার নুডলসপ্রেমীদের জন্য চাউম্যান সাজিয়েছে থাই নুডলস। এছাড়া রয়েছে বেসিল ফ্রায়েড রাইসের এক অনবদ্য প্রিপারেশন। চিনা মশলা আর হালকা সবজির সঙ্গে তুলসীর গন্ধ আপনাকে এতটাই মুগ্ধ করবে যে, খেতে খেতে প্রিয়জনের মুখ মনে পড়বেই। রয়েছে ‘এক্সোটিক ভেজ ইন স্পাইসি হুনান সস’। বেবি কর্ন, স্পিনাজ, ব্রকোলি, গাজর ইত্যাদির সঙ্গে হুনান সসের ভাব যদি দেখতে চান, তবে এই ডিশ আপনার জন্য সেরা বিকল্প।

ফুং ফা
চায়না টাউনের প্রবেশদ্বারের কাছে অবস্থিত ফুং ফা ক্যান্টনিজ খাবারপ্রেমীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। আবছা আলোয় সাধারণ অন্দরসজ্জায় ছিমছাম এই রেস্তোরাঁয় অল্প ব্যয়েই খাঁটি চিনে খাবারের স্বাদ নিতে পারবেন আপনি। মাংসের নানা ডিশ, মধু-লঙ্কা দিয়ে মাছের পদ, মিক্সড রাইস নুডলস ইত্যাদি খেতে এখানে বহু দূর-দূরান্ত থেকে নিয়মিত অনেক মানুষ হানা দেন।

আহ লেউং
ট্যাংরার আহ লেউং এখানকার চাইনিজ প্রাতঃরাশের জন্য পরিচিত। অল্প ব্যয়েই মুখরোচক চিনে খাবার খেতে আপনি ঢুঁ মারতে পারেন পুরনো এই দোকানে। কলকাতার চায়না টাউনেই একটি চিনা পরিবার দ্বারা পরিচালিত এই খাবারের দোকানে প্রতি দিনই স্থানীয় মানুষজন ভিড় জমান। ‘সিঙ্গারা চাউ’— এখানকার বিখ্যাত একটি খাবার। তবে জিনিসটি কিন্তু চাউ-ভরা সিঙাড়া, বা সিঙাড়ার প্লেটে ঘিয়ে ভাজা সিঙাড়া নয়। আসলে জিনিসটি হলো নরম তুলতুলে স্টিমড ওয়ান্টনের সঙ্গে ঝোল ঝোল নুডলসের এক বাটিতে মাখামাখি সহাবস্থান। ফলে প্রতি কামড়ে মোটা মোটা নুডলস, স্যুপ আর চিকেনের টুকরোর সঙ্গে মুখে এসে পড়বে মোমোর জাতভাইয়ের টুকরোটাকরা। সবরকম চেখে দেখার জন্য সাতসকালে পৌঁছে যাওয়াই ভালো।

চাং ওয়া
পুরানো কলকাতার কেবিন-স্টাইলে সাজানো এই রেস্তোরাঁটি তার সুস্বাদু খাবারের জন্য বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে পর্কের পদগুলি এখানে বিশেষ লোভনীয় এবং আরও একটি জিভে জল আনা বিকল্প হল প্রন চাউমিন। আশপাশের অফিসযাত্রী মানুষ এই রেস্তোরাঁটিকে ভীষণ পছন্দ করেন এখানকার চাইনিজ খাবারের জন্যই। চাং ওয়া থেকে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে আপনি ঘরে বসেও এখানকার সুখাদ্য চেখে দেখতে পারেন। চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনের পাশে এই রেস্তোরাঁ বিভিন্ন খ্যাতনামা ফুড ব্লগারদেরও বিশেষ পছন্দ।

তাই সেন চাইনিজ ইটিং হাউস
এই ছোট্ট ভোজনশালার মালিক এডউইন লিয়াও এখানকার প্রধান শেফও বটে। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের এই দোকানে আপনি পাবেন যথার্থ চিনে খাবার। বয়স বেশি না হলেও এই রেস্তোরায় মাংসের পদ, স্যুপ কিংবা নুডলস খেতে খেতে মনে হতেই পারে কলকাতায় নয়, আপনি রয়েছেন চিন দেশের কোনও ভোজনালয়ে। সুস্বাদু চাইনিজ খেতে হলে হাতে কিছুটা সময় নিয়ে ঘুরে আসুন তাই সেন চাইনিজ ইটিং হাউসে।

কিমলিং
কিমলিং-এর পথ চলার শুরু হল হাল আমলে, বাকিদের তুলনায় বয়সে নেহাতই শিশু। কিন্তু তাই বলে স্বাদের দিক থেকে কোনও অংশে সে কম নয়। বাঘা বাঘা ওস্তাদদের মাত দিতে কিমলিং সিদ্ধহস্ত। তবে এই কিমলিং-কে গোলপার্কের কাছের কিমলিং-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না। চায়না টাউন ট্যাংরার কিমলিং একটি আদ্যোপান্ত পর্ক স্পেশালিটি রেস্টুরেন্ট, মেনুতে শুয়োরের মাংসের হরেক সম্ভার। এখানকার খাবার যতটা সুস্বাদু, দাম কিন্তু ততটা নয়। তাই পকেট বাঁচিয়ে খাঁটি চাইনিজ খাবারের স্বাদ নিতে চাইলে, কিম লিং-ই সেরা ঠিকানা। মাস্ট ট্রাই : চিকেন হানি, নয়তো লেমন চিকেন চেখে দেখতে ভুলবেন না। আর মেন কোর্সে অবশ্যই অর্ডার করবেন নুডলস। আর যদি স‍্যুপ খেতে ইচ্ছা করে, তাহলে থাই স‍্যুপ অর্ডার করতে পারেন।

গোল্ডেন জয়
ট্যাংরার চায়না টাউনের বিগ থ্রি-র মধ্যে গোল্ডেন জয় অন্যতম। আছে আলাদা ফ্যামিলি এবং জেন্টস সেকশন। আছে আস্ত গোটা বোতল পানীয় অর্ডার দেওয়ার সুযোগ। মেনুতে আছে বহু পুরনো রেসিপি, যা পুরোনো কলকাতার স্বর্ণযুগকে মনে করিয়ে দেয়। বন্ধু বান্ধব বা সপরিবারে যাওয়ার মতো আদর্শ জমজমাট জায়গা গোল্ডেন জয়। এদের প্রতি ডিশে খাবারের পরিমাণ থাকে প্রচুর, তাই অর্ডার করার সময় একটু বুঝেশুনে আনতে বলাই ভাল। এখানে এসে নুডলস না খেলে ভুল করবেন। সঙ্গে গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রন, প্রন চিপস, নয়তো চিকেন হানির মতো ডিশও অর্ডার করতে পারেন।

কাফুলক
বয়সের দিক থেকে আরেক নবীন সদস্য, তবে অল্প দিনেই শহরের ভোজনরসিকদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে কাফুলক। ছিমছাম ডেকরেশন, মানানসই সার্ভিস আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ইন্টিরিয়র ছাড়াও যেটা মনে দাগ রেখে যায়, সেটা এখানকার খাবার। আড়ম্বর নেই, হয়তো প্লেটিং নিয়ে মাথাব্যথা নেই, কিন্তু স্বাদের দিক থেকে নেই কোনও নালিশের জায়গা। বিগত বেশ কিছু বছরে কাফুলকে নানা ধরনের ভোজনরসিক ক্লাবের ভোজ-আড্ডা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং কাউকেই নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়নি। আগামিদিনে চায়না টাউনের স্টার রেস্টুরেন্ট হওয়ার দাবি রাখে আজকের কাফুলক। ট্রাই করতে পারেন - চিকেন ড্রামস্টিক, প্ৰন কাটলেট, গার্লিক স্টিম ফিশ ফিলে, চিকেন সেজওয়ান চাউ।

বেজিং
ট্যাংরার আরেক পাওয়ারহাউজ পারফর্মার এই বেজিং রেস্টুরেন্ট। সন্ধেবেলার দিকে গেলে দেখবেন বেশ পরিপাটি স্নিগ্ধ রূপ, কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে বেজিং। কলকাতা ট্যাংরা-চাইনিজ ঘরানার অন্যতম আদি পীঠস্থান বেজিং রেস্টুরেন্ট। ডেকরেশন বা অ্যামবিয়েন্স বিচারে খুব হাইফাই বা ফ্যান্সি না হলেও, খাবার গুণে বেজিং এখনও চায়নাটাউনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ খাবার জায়গা। খেতে পারেন ব্ল্যাক পেপার ল্যাম্ব, সাংহাই চিকেন, চিলি গার্লিক পেপার ফিশ, ড্রাই চিলি ক্র্যাব ক্ল, মিক্সড ক্যান্টোনিজ নুডলস। বিশেষত, এদের সি ফুডের স্বাদ তো না ভোলার মতো। তাই খাঁটি চিনা খাবারের স্বাদ যদি নিতে হয়, তা হলে কোনও এক ছুটির দিনে বেজিং-এ এসে লাঞ্চ সারতে ভুলবেন না যেন !

বিগ বস
অনেকের মতে বিগ বস সত্যি এই এলাকার ‘বিগ বস’। ঠিক মানতে পারছেন না? বিগ বসে গুছিয়ে বসে চর্ব্য-চস্য-লেহ্য-পেয় সাবাড় করে তুল্যমূল্য বিচার করুন। একসঙ্গে বসে এটা-ওটা খেতে খেতে আড্ডা দেওয়ার মতো জায়গা বিগ বস। ক্লাসিক চায়না টাউনের রেস্টুরেন্টের মতো এখানেও অল্প দামে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, সব ক’টি ফুল ডিশ একসাথে ৩ বা ৪ জন মিলে খেতে পারবেন। উপরি পাওনা এদের নিজস্ব পার্কিং স্পেস আর উঁচু দরের সার্ভিস। খেতে পারেন- লুৎ মি চিকেন, ড্রামস অফ হেভেন, চিলি মটন, মিক্সড ফ্রায়েড মি ফুন, কুং পাও চিকেন, হুনান ফিশ।

জিমি’স কিচেন
জিমি’স কিচেন হলো কলকাতার অন্যতম সেরা চাইনিজ রেস্তোরাঁ। অনেক তারাখচিত রেস্তোরাঁকেও হার মানায় এদের চিলি পর্ক, চিলি ক্র্যাব, ক্রিসপি চিকেন এবং চাইনিজ মিক্সড স্যুপ। থিয়েটার রোড, ত্রিমূর্তি পেট্রোল পাম্পের কাছে এই রেস্তোরাঁটি চেনেন না এমন খাদ্যরসিক কমই আছে। দু'-জনের জন্য খরচ ৭০০ টাকা।

হাটারি
দক্ষিণ কলকাতায় বাসন্তী দেবী কলেজের কাছে, ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের বিপরীতে ‘হাটারি’ রেস্তোরাঁটি মধ্যবিত্তের চাইনিজ খাওয়ার জন্য আদর্শ। অতুলনীয় রান্না এবং প্রচুর মেনু তো বটেই, তার থেকেও বড় হলো পোর্শন। হাটারির স্টার্টার থেকে সাইড ডিশের পোরশন এতটাই বেশি যে দু'-জন তো বটেই, তিন-চারজন অনায়াসে খেতে পারবেন পেটভরে। দু'-জনের জন্য খরচ পড়বে ১০০০ টাকার আশপাশে।

More Articles