এক সন্ধেয় বুঝেছি কন্যার বাবা হওয়া কী
কন্যার বাবা হওয়ার মানে কী সেই সন্ধ্যা আমাকে তা ঘাড় ধরে বুঝিয়ে দিয়েছিল
নবারুনদা (ভট্টাচার্য) লিখেছিলেন আমরা এমন একটা ইতরের দেশে বাস করি যেখানে কবিরা গরু হয়ে যায় আবার উল্টোটা হওয়াও অসম্ভব নয়। তার সঙ্গে আমার সংযোজন, আমরা এমন একটা ইতরের দেশে বাস করি যেখানে কোনটা সংখ্যায় বেশি ঘটে, কন্যা-ভ্রুণ হত্যা না ধর্ষণ, বলা সহজ নয়।এদেশে প্রত্যহ গড়ে নব্বইজন নারী ধর্ষিতা হন, আমরা তার মধ্যে কতজনের খবর রাখি? ক'টি ঘটনা হেডলাইন হয়?
হয়, যদি কোনও বড় মেট্রোপলিসে অথবা বড় জনপদে এমন পৈশাচিক ঘটনা ঘটে। যেমন দিল্লিতে নির্ভয়া অথবা কলকাতায় অভয়া বা তিলোত্তমা। তার মানে শ্রেণী বৈষম্যের আলো-আঁধারি খেলা এখানেও সদর্পে বিদ্যমান, প্রান্তবাসী ধর্ষিতা হয়েও অন্তরালের অন্ধকারে অনাদৃতা। ঠিক বিপরীত ছবি শহরে যেখানে মধ্যবিত্ত বোধ আর বিবেক ধর্ষিতাকে প্রায় শহিদের মর্যাদা দেয়, তার স্মৃতি সহসা ফিকে হতে পারে না। ধর্ষণের দীর্ঘ সারণিতে মাইলফলকগুলি রচিত হয় বড় শহরে, গ্রাম কেবল সর্বজনীন। অবহেলায় নীরবে, নিভৃতে কাঁদে। ইতরের দেশে ইহাই তো দস্তুর। মানবিক বিবেক তবু সম-বন্টিত নয়।
তবু নির্ভয়া অথবা আর জি করের মতো ঘটনা ঘটলে প্রথম চোটে আমি কেমন যেন স্বার্থপর হয়ে যাই। নির্যাতিতার জন্য শোক অথবা ক্রোধ হয় কিছুক্ষণ পরে। তার বদলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার একমাত্র কন্যাটির মুখ, তার জন্য উৎকন্ঠায় বুকের পাঁজরগুলি মড়মড় করে আওয়াজ করে ওঠে। বিদেশ-বিভুঁইয়ে একা একা থাকে, বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো সেই দুশ্চিন্তা কপালের দু’পাশের রগে এসে ঠাস ঠাস করে আঘাত করে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে এমন গর্হিত স্বার্থপরতা কী সব মেয়ের বাপের চরিত্র লক্ষণ নাকি আমি নরাধমই একমাত্র ব্যতিক্রম? কিংবা একেই কী মেয়ের বাবা হওয়া বলে?
কন্যার চেয়ে বছর আষ্টেক ছোট আমার একটি পুত্রও আছে। দু’জনেই আমার একই রকম আদরের, কাকে বেশি ভালোবাসি তা মাপার মতো অর্বাচীন ভাবনাও কখনও মনে আসে না। তবু পাঁচজনে যখন বলে কন্যা আমার ফটো কপি, ছেলে মায়ের, তখন আনন্দে মনের ভিতরটা আকুলি-বিকুলি করে ওঠে, প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করে না। আমার গুরু সন্তোষ কুমার ঘোষ মাঝেমাঝে রসিকতা করে বলতেন, জীবনে বিয়েটা যে কত অপ্রয়োজনীয় তা বিয়ে না করলে বোঝা যায় না। অর্থটি উল্টে দিয়ে আমার বলতে ইচ্ছে করে, মেয়ের বাবা হওয়াটা কতটা প্রয়োজনীয় মেয়ের বাবা না হলে তা বোঝানো যাবে না। ফলে যে সব দম্পতির কেবল পুত্রলাভের সৌভাগ্য হয়েছে আমার কেন জানি না তাদের জন্য ভীষণ মায়া হয়। যে বাড়িতে কন্যা নেই তাদের দেখলে মনে হয় যেন ক্ষুধিত পাষাণ, আলো, হাওয়া সবই আছে, সুখ সম্ভোগও আছে পুরোদস্তুর তবু স্নিগ্ধতার কোমল স্পর্শ নেই, বহিরঙ্গে ঝলমলে চাকচিক্য অন্তরটা অব্যক্ত বেদনা-বিধুর।
কুমোর যেভাবে মূর্তি গড়ে ঠিক ততটা যত্ন আর আন্তরিকতা দিয়ে আমি মেয়েকে মানুষ করেছি। যতদিন সে স্কুলের চৌকাঠ পার করে পরবাসী হয়নি তাকে ঢেকে রেখেছি নিজের ছায়ায়। রোজ সকালে ইস্কুলে পৌঁছে দেওয়া, পরীক্ষার সময় গেটের বাইরে মায়েদের প্রমীলাপুরীতে কার্তিক ঠাকুরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা, পেরেন্টস-টিচার মিটিংগুলোয় মেয়ের অঙ্কে নিয়মিত ফেল করা নিয়ে দিদিমনিদের মৃদু ভর্ৎসনা হজম করা, বাৎসরিক স্পোর্টসের দিন মেয়ের দৌড় দেখব বলে দর্শকদের প্রথম সারিতে বসে থাকা, বাড়িতে সময় পেলে যতটা সম্ভব লেখাপড়ার তত্ত্বাবধান করা, মায় তার অজস্র অন্যায় আবদার গিন্নির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে গোপনে মেনে নেওয়া, সবশেষে তার দস্যিপনার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে হাঁফিয়ে ওঠা, সবেতেই আমার হাতে মেয়ের হাত। বাপ কা বেটি বলে অঙ্ক আর বিজ্ঞানে কন্যার ঘোর অরুচি দেখে যখন চিন্তিত হয়েছি, স্কুলের দিদিমনি কলেজে আমার জুনিয়র ডাকসাইটে সুন্দরী বেহুলা আমাকে বারেবারে বরাভয় দিয়ে বলেছে, ‘তুমি এক্কেবারে চিন্তা কোরো না। শি উইল ব্লজম ওয়ান্স শি এন্টারস ক্লাস ইলেভেন। তখন নিজের পছন্দের বিষয় পড়তে পারবে আর চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট করবে।’
বেহুলা এখন কী করছে, কোথায় আছে কিছুই জানি না। শুধু এটুকু মনে আছে এক্কেবারে ক্ষণার বচনের মতো ফলে গিয়েছে তার ভবিষ্যদ্বাণী। সেই কন্যে আমার সেন্ট স্টিফেন্স, সোয়াস, অস্টিন, মিশিগান হয়ে ডাবলিনে ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করে। খুব শিগগির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে তার প্রথম গবেষণা গ্রন্থটি প্রকাশ পাবে। বখাটে সাহেব মেমসাহেবের বাচ্চারা পরীক্ষায় ভালো লিখতে না পারলে কড়া মাস্টারনি সোজা ফেল করিয়ে দেয়। আমি দেখি, শুনি আর ভাবি একেই বোধহয় বলা যায় মধুর প্রতিশোধ। অঙ্কে ডাব্বা পেতাম একদিন এখন গায়ের ঝাল মেটাই।
ইস্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে সে যখন দিল্লিতে পড়তে গেল, আমি অনিবার্য সঙ্গী ছিলাম। সেন্ট স্টিফেন্সের হোস্টেলে জায়গা পাওয়া গেল না, ওরা কয়েকজন মেয়ে বন্ধু মিলে কলেজের কাছেই একটা মেস বাড়ি জোগাড় করে ফেলল। সেখানে মেয়েকে তার বাক্স- প্যাঁটরা সমেত পৌঁছে দিতে গিয়ে ওদের ঘরে ঢুকেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হওয়ার জোগাড়। ছোট্ট একটা প্রায়ান্ধকার ঘর, মেঝেতে সার দিয়ে গোটা ছয়েক চৌকি পাতা, দুটো চৌকির মধ্যে দু-বিঘৎ ব্যবধান, প্রতিটির চৌকির মাথার দিকে দেওয়ালের গায়ে ছোট্ট ডেস্ক। আমার রাজকন্যা শেষ পর্যন্ত এই ঘরে থাকবে?
মেয়েকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠলাম, দিল্লি বিমানবন্দর থেকে কলকাতা ফেরার প্লেন ধরব। মেয়ের জন্য কষ্টে আর যাতনায় বুক ফেটে যাচ্ছে, প্লেনে পাশের সিটে এক পরমা সুন্দরী, তার দিকে আড় চোখে তাকাতেও ইচ্ছে করল না। থমথমে মুখে ফ্ল্যাটে ঢুকে প্রথমেই চোখ পড়ল মেয়ের ঘরে। টেবিলে সাজানো বই, বিছানা পরিপাটি, দেওয়ালে ঝুলছে শোয়েব আখতার আর ঋত্বিক রোশনের মস্ত বড় পোস্টার, আমার কন্যার কিশোরী বেলার দুই হার্ট-থ্রব। আর নিজেকে সংযত রাখা গেল না, হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললাম। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল মেয়েকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য।
কন্যার বাবা হওয়ার মানে কী সেই সন্ধে আমাকে তা ঘাড় ধরে বুঝিয়ে দিয়েছিল। এই বুঝতে পারাতেই আমার অনির্বচনীয় আনন্দ।