প্রকাশকের উচিত রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা থেকে দূরত্ব বজায় রাখা
Bloomsbury Publishing: হ্যারি পটার ছাড়া কি ব্লুমসবেরি অস্তিত্বহীন? কলকাতার পাঠকের পছন্দ কোন বই?
২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতে সফর শুরু করে ব্লুমসবেরি প্রকাশনা। ব্লুমসবেরিকে সাধারণ মানুষ চিনেছেন হ্যারি পটারের জন্যই হয়তো কিন্তু আন্তর্জাতিক এবং ভারতীয় দুই ধরনের লেখকের বইয়ের বিপুল সম্পদ রয়েছে এই বিখ্যাত প্রকাশনার ভাঁড়ারে। উইলিয়াম ডালরিম্পল, জেকে রাউলিং, খালেদ হোসেইনি, এলিজাবেথ গিলবার্ট, কামিলা শামসি, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নাদিন গর্ডিমার, প্যাট্রিক মোডিয়ানো; বুকার পুরস্কার বিজয়ী মার্গারেট অ্যাটউড; পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী এলিজাবেথ কলবার্ট থেকে শুরু করে মানিল সুরি, রাজ কমল ঝা, শিব খেরা, শ্রাবণী বসু, অনিল মেনন, অমৃতা শাহ, আনন্দ রঙ্গনাথনের মতো লেখকরা ব্লুমসবেরির তারকা। কলকাতা বইমেলায় অবশ্য খুব বেশিদিন পা রাখেনি ব্লুমসবেরি। সম্প্রতিই দেখা যাচ্ছে তাদের। কীভাবে শুরু এই সফর, হ্যারি পটার ছাড়া কি ব্লুমসবেরি অস্তিত্বহীন? কলকাতার পাঠকের পছন্দ কোন বই? আন্তর্জাতিক এই প্রকাশনার ভারতীয় বিভাগের ব্যবসায়িক বিভাগীয় প্রধান সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মুখোমুখি ইনস্ক্রিপ্ট।
মধুরিমা- ব্লুমসবেরির পথচলা শুরু কীভাবে?
সুদীপ্ত- ১৯৮৬ সালে লন্ডলে নাইজেল নিউটন এই প্রকাশনা শুরু করেন। তখন অবশ্য খুবই ছোট্ট একটা সংস্থা এটি। শুরু থেকেই কল্পধর্মী সাহিত্য প্রকাশনার ক্ষেত্রটিকে ব্লুমসবেরি প্রকাশনা গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। পাল্প ফিকশনের প্রতি কোনওকালেই আমাদের আগ্রহ ছিল না, আজও নেই। থ্রিলার জাতীয় কিছু বই আমরা কয়েক বছর ধরে প্রকাশ করছি ঠিকই কিন্তু সেটা বড় সংখ্যক মানুষের চাহিদা অনুযায়ী নয়। মাস মার্কেট ধরা আমাদের উদ্দেশ্য না। ব্লুমসবেরি প্রথম থেকেই প্রকাশনার মানের জন্যই পরিচিত, প্রখ্যাত। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায়, ব্লুমসবেরি প্রকাশনার পথ চলা বদলে যায় জেকে রাউলিংয়ের বইয়ের হাত ধরেই। সকলেই জানেন, আন্তর্জাতিক যত প্রকাশনা ছিল, তারা হ্যারি পটারকে বাতিল করে দিয়েছিল। জেকে রাউলিংয়ের ফিলোজফার্স স্টোন বইটি ছাপতেই চায়নি কেউ। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা নাইজেল নিউটন কিন্তু এই লেখাগুলির মধ্যে একটা সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি সেই রিস্ক নেন। বাকিটা তো ইতিহাস।
মধুরিমা- হ্যারি পটারের বই প্রথম ব্লুমসবেরি কবে প্রকাশ করে?
সুদীপ্ত- নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে। ১৯৯৭ সাল। ফিলোজফার্স স্টোন। ব্লুমসবেরি যখন হ্যারি পটার প্রকাশ করে তখন কিন্তু এই প্রকাশনা খুবই ক্ষুদ্র একটি সংস্থা, আগেই বলেছি। পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া তখন ব্লুমসবেরির ডিস্ট্রিবিউশনের দায়িত্বে ছিল। ভারতে ব্লুমসবেরির পথচলা শুরু ২০১২ সালে। তার আগে দীর্ঘ ২৫ বছর পেঙ্গুইনই ছিল ভারতে ব্লুমসবেরির প্রতিনিধি।
মধুরিমা- জেকে রাউলিং ছাড়া কোন কোন লেখকের বই ব্লুমসবেরির সম্পদ বলে মনে করেন?
সুদীপ্ত- এক্ষেত্রে নাম বহু! তবে কয়েকজনের কথা বলতেই হয় যেমন খালেদ হোসেইনি, ড্যানিয়েল উলম্যান, এলিজাবেথ গিলবার্ট, উইলিয়াম ডালরিম্পল, আব্দুল রজ্জাক গুর্না, কামিলা শামসি, জর্জ সন্ডার্স- লিটারারি ফিকশন বিভাগে যত দিকপাল আছেন সকলের বই-ই প্রায় বলতে গেলে ব্লুমসবেরি থেকে প্রকাশিত। হ্যারি পটার প্রকাশ করে ব্লুমসবেরির যা আয় হয়েছিল, সেই টাকা দিয়ে ধীরে ধীরে আকাদেমিক ক্ষেত্রের বইয়ের দিকে আমরা নজর দিতে শুরু করি। ফ্যাশন ডিজাইনিং, আর্কিটেকচার, অর্নিথোলজি, নটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং— এই দিকগুলিতে ব্লুমসবেরির বই কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজবিদ্যার দিকটিতেও আমাদের অসংখ্য ভালো বই রয়েছে। রিলিজিয়াস স্টাডির ক্ষেত্রে, ক্রিশ্চিয়ানিটির উপর বিশেষ করে, আমাদের বইগুলি খুবই উল্লেখযোগ্য। আইন এবং হিসাবশাস্ত্রের ক্ষেত্রেও ব্লুমসবেরির বইয়ের কদর ব্যাপক। বলা যেতে পারে, আকাদেমিক জগতে আমাদের প্রকাশনার ব্যাপ্তি বিশাল। এর পাশাপাশি তো সাধারণ মানুষের জন্য অন্যান্য বই আছেই।
আরও পড়ুন- পুরনো বই সমানভাবে ছেপে যাওয়াই মূল মন্ত্র
মধুরিমা- আপনি যেমন বললেন, হ্যারি পটার দিয়ে শুরু করে ব্লুমসবেরির দিশাই বদলে গেছিল। বহু যুগ পেরিয়ে গেছে। এখনও কি ব্লুমসবেরি থেকে হ্যারি পটার কেনার একই রকমের চাহিদা রয়েছে পাঠকদের?
সুদীপ্ত- একদম! আমরা প্রতিবছর হ্যারি পটারের নতুন কোনও না কোনও প্রোডাক্ট নিয়ে এসে ব্র্যান্ডটিকে নতুন করে প্রাসঙ্গিক করে তুলি। সেই জন্য আমাদের বিনিয়োগ আর লাভ একই সঙ্গে চলতে থাকে। প্রতিবছরই কিন্তু নতুন প্রজন্মের একটা বড় সংখ্যক পাঠক হ্যারি পটারের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। অগাস্টে হ্যারি পটারের নতুন সিরিজ তৈরি করা হচ্ছে। সেটা মূলত হ্যারি পটারের যে দু'-তিনজন বন্ধু ছিল, সেই এক একটি চরিত্রকে নিয়ে, হ্যারি পটার সমেত — সেই নিয়ে একটি সিরিজ হচ্ছে চারটি বইয়ের। প্রতিবছরই আমরা নতুন কিছু আনার চেষ্টায় থাকি। যেমন ৩ বছর আগে আমরা হ্যারি পটারের হাউজ এডিশন এনেছিলাম। অর্থাৎ হ্যারি পটারের যে ম্যাজিক স্কুল, তাতে চারটি হাউজ ছিল। হাফলপাফ, স্লিথারিন, র্যাভেন ক্ল, গ্রিফিনডর— সেই চারটি হাউজের উপর সাতটি করে বই তৈরি হয়। মিনালিমা স্টুডিও কয়েক বছর আগেই ফিলোজফার্স স্টোনের একটি ইলাস্ট্রেটেড এডিশন তৈরি করে। সেটি খুবই জনপ্রিয় হয়। প্রকাশক হিসেবে আমরা চেষ্টা করি, কীভাবে নতুন করে সেই চরিত্রটাকে বা বইগুলিকে আরও মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়, নতুন বেশে নিয়ে যাওয়া যায়। প্রতিবছর নতুন করে একটি প্রজন্মকে যদি ধরতে হয়, তাহলে নিজেদের আরও আকর্ষণীয় করতে হবে, আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
মধুরিমা- শুধু হ্যারি পটারের ক্ষেত্রেই এই পরিশ্রমটা করে ব্লুমসবেরি না কি বাকি বইগুলির ক্ষেত্রেও...
সুদীপ্ত- হ্যাঁ! তবে যেগুলি এমন বিখ্যাত ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে, সেগুলির ক্ষেত্রেই এমন পরীক্ষার বেশি দরকার পড়ে। একটা উদাহরণ দিই। একসময় ফ্রেডরিক ফ্রোসেথ বা উইলবার স্মিথ ছিলেন বিখ্যাত। উইলবার স্মিথ যেমন আমাদের সময়ে বেস্টসেলার ছিলেন ভারতে। কিন্তু সে সব ২৫ বছর আগের কথা। আজ তো তাঁর বই বিক্রিই হয় না। জন লুথার, সিডনি শেলডনের বই এখন আর বিক্রিই হয় না। প্রকাশকের কাজ কিন্তু এটাই— নতুন প্রজন্মকে জানানো যে কেন উইলবার স্মিথ পড়া উচিত। যদি ডোরেমন বা ভারতের নিজস্ব ছোটা ভীমের মতো চরিত্রগুলোর দিকে তাকাই, দেখবেন আর বিক্রিই হচ্ছে না সেগুলো। কারণ প্রথম পাঁচ বছর খুব বিক্রি হয়েছে। প্রকাশকরা ভেবেছেন, এই চাহিদাটাই হয়তো আজীবন থেকে যাবে। কিন্তু বিষয়টা এত সোজা না। যতক্ষণ নতুন কিছু না আসছে, মানুষের কেনই বা আগ্রহ জন্মাবে?
ওয়ার্ল্ড বুক ফেয়ার শুরু হচ্ছে। সেখানে আমাদের একটি কর্নার আছে। সেখানে হ্যারি পটারের বইগুলির যে তাক থাকে, সেই জায়গাটা হ্যারি পটার কর্নার হয়ে যায়। সেখানে ছবি তোলার ধুম পড়ে যায়। এখনও এমন অনেক মানুষ দেখি যে তারা হ্যারি পটার দেখে এতই আবেগপ্রবণ হয়ে যান যে কিছু একটা ঠিক কিনেই নেন। তার হয়তো দরকারই নেই বইটা, হয়তো আগে পড়া— তাও কেনেন, সেলফি তোলেন। এই চাহিদাটা এখনও আছে।
মধুরিমা- পাঠকরা কেমন ধরনের বই পড়তে চাইছেন? আরেকটু ভেঙে বললে, গত কয়েক বছরে, দশকে পাঠকের পছন্দে কি বিশেষ কোনও পরিবর্তন এসেছে?
সুদীপ্ত- বদল খানিক এসেওছে, আবার আসেওনি বলা যায়। কোভিডের সময় আমাদের পাঠকের সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। কোভিডের সময় দোকান বন্ধ থাকলেও, আমাজনে আমাদের যা বিক্রি হয়েছে তাতে একমাসে আমরা প্রায় ২৫-৩০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছি! কেবল আমাজনেই ১৮-১৯ কোটি টাকার ব্যবসা হয়।
মধুরিমা- সেটা কি ২০২০ সাল?
সুদীপ্ত- ২০-২১ এর মাঝে, ২০২০ সালের নভেম্বরের দিকে হবে। এত ব্যবসা আমাদের কোনওকালেই হয়নি!
আরও পড়ুন- জামার তলায় চুরি করা রুশদি! বইমেলায় ক্রমেই ফিকে হচ্ছে বইপাগলরা
মধুরিমা- এটা কীভাবে সম্ভব? কোভিডের সময় আরও নানা ক্ষেত্রের মতোই প্রকাশনা শিল্প ধুঁকেছে। বাংলা প্রকাশনার অবস্থা তথৈবচ ছিল! ব্লুমসবেরি ক্ষেত্রে অন্যথা হলো কীভাবে?
সুদীপ্ত- হ্যাঁ, সার্বিকভাবে খারাপ ছিল একথা ঠিক। তবে কিছু কিছু প্রকাশনা, সারা ভারত জুড়েই, তারা কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য সর্বোচ্চ উপায়গুলি খুঁজে বের করেছিল। বইয়ের দোকানগুলি হোম ডেলিভারি শুরু করে। যারা সেই বিকল্পের সন্ধান করেনি, তারাই একমাত্র শেষ হয়ে গেছে। আর যারা সেই দুঃসময়ে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছে তারা কিন্তু শক্তি বাড়িয়েই ফিরে এসেছে। কারণ ওইরকম খারাপ সময় আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল, ব্যবসায় দুঃসময় ঠিক কতটা খারাপ হতে পারে। কলকাতাতেও কয়েকটি প্রকাশনা কিন্তু নিজেদের ঠিকই টিকিয়ে রেখেছে। তারা নিজেদের নানাভাবে পরিবর্তিত করেছে। যেমন ধরুন, কলকাতায় স্টোরিটেলার বুকশপ বলে একটি জায়গা আছে পিকনিক গার্ডেনে। ওরা মূলত বাচ্চাদের বই নিয়েই কাজ করে। তারা সেই সময় কিছু ওয়ার্কশপের আয়োজন করে। আমাদের একজন লেখক আছেন অ্যান্ড্রিউ ব্রডি। তিনি যুক্তরাজ্যে স্কুলশিক্ষক ছিলেন। বাচ্চাদের বই লেখেন, বানানের, ব্যাকরণের। তাঁকে নিয়ে আমাদের মাধ্যমে বাচ্চাদের কিছু ওয়ার্কশপ করানো হলো সেই সময়ে। যারা 'স্মার্ট' তারাই টিকে গেছে।
মধুরিমা- এই বছরে কী কী নতুন বই প্রকাশ হচ্ছে ব্লুমসবেরি থেকে?
সুদীপ্ত- গতবছর বেস্টসেলার ছিল দ্য গোল্ডেন রোড, উইলিয়াম ডালরিম্পলের। ইতিমধ্যেই তা ৭০-৮০ হাজার কপি বিক্রি হয়ে গেছে। এবছর থাকবে শিব খেরার লিভ হোয়াইল ইউ আর অ্যালাইভ। বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে মানসিক চাপের ক্রমবৃদ্ধি নিয়ে লেখা এই বইটি। এলিজাবেথ গিলবার্টের নতুন বই আসছে। ভারতীয় লেখকদের মধ্যে জে সাইদীপকের নতুন বই প্রকাশের মুখে, আব্দুল রজ্জাক গুর্নার নতুন বই আসছে। সামান্থা শ্যাননের বই প্রকাশ হবে।
মধুরিমা- ব্লুমসবেরি কি প্রকাশনার দিকে খুব একটা ঝুঁকি নিতে চায় না? বিতর্কিত কোনও লেখকের লেখা বা বিতর্কিত বিষয়ের বই প্রকাশনার ঝুঁকি কি ব্লুমসবেরি নেয়?
সুদীপ্ত- আমরা সব রকমের বই প্রকাশ করি। হ্যাঁ, রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাই। যে কোনও প্রকাশনারই কাজ পাঠকের কাছে বিষয়টা পৌঁছে দেওয়া, নিজে 'জাজমেন্টাল' না হয়ে। তবে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার ক্ষেত্রে নিজেকে দূরে রাখা যে কোনও প্রকাশকের ক্ষেত্রেই জরুরি। ব্লুমসবেরি মনে করে, সব রকমের বই-ই প্রকাশ করা উচিত। আমরা করেওছি।
মধুরিমা- যেমন?
সুদীপ্ত- গতবছর আমাদের একটা বই প্রকাশ হয়, বাংলায় বিজেপির উত্থান নিয়ে। বিজেপি কীভাবে বাংলা দখলের চেষ্টা করছে এই নিয়েই পুরোটা। কিন্তু বইটা খুব একটা বিক্রি হয়নি। সম্ভবত গত নির্বাচনের আশেপাশে প্রকাশ হয়।
আরও পড়ুন- পুজোয় তো শাড়িও বেস্ট সেলিং হয়…
মধুরিমা- বিক্রিই যদি না হয় তাহলে তো প্রকাশক সেই ঝুঁকি নিতেও চাইবেন না!
সুদীপ্ত- রিস্ক তো আছেই। বইটা এমনিও সঠিক সময়ে প্রকাশ না হওয়াতে গুরুত্ব হারিয়েছিল। তবে আমরা বিশ্বাস করি, বই প্রকাশ একটা বিনিয়োগ। তারপর যদি সেই বিনিয়োগে কোনও 'রিটার্ন' না আসে তাহলে লাভ নেই। অনেকসময় হয়, মনে হয় এই বইটা বোধহয় প্রাইজ পাবে। কিন্তু দেখা যায় পুরস্কার পেলেও তার বিক্রি নেই। একসময় মৃণাল সেনের বই তো আন্তর্জাতিক মহলে সমাদৃত হয়েছে, অথচ কোনও ব্যবসাই করেনি। কিন্তু টাকা না এলেও তো ব্যবসা চলবে না। তবু, যাই হোক, ঝুঁকি তো নিতেই হবে। অত নিরাপদে গা বাঁচিয়ে চলতে গেলে ব্যবসা হয় না। আব্দুল রজ্জাক গুর্না যখন নোবেল পান, যুক্তরাজ্যে তাঁর বই তেমন বিক্রিই হতো না। ২০১৮ সালে বুকার পুরস্কার জেতেন জর্জ সন্ডার্স, লিঙ্কন ইন দ্য বার্ডো বলে একটা বইয়ের জন্য। বইটা বুকার পাওয়ার পরে লাখে লাখে বিক্রি হওয়ার কথা, অথচ তা হয়নি। কারণ বিষয়টা কঠিন খুবই। প্রথম ৩০ পাতা পড়েও হজম করা কঠিন। যারা একমাত্র এই বিষয়ে সিরিয়াস চর্চা করেন তাঁদের কাছে বইটা সমাদর পাবে। আমরা অত বই বিক্রিই করতে পারিনি। আগে আমি যখন অন্যত্র চাকরি করতাম, দেখি অরবিন্দ আডিগার দ্য হোয়াইট টাইগার বইটি বুকার পায়। প্রতি ঘণ্টায় ২৫ হাজার কপির অর্ডার এসেছে, আমরা সামলাতে পারিনি। তবে ব্লুমসবেরি বইয়ের মান মাথায় রাখে সবার আগে। তাই ব্যবসা যেভাবে এগোচ্ছে তাতে আমরা বেশ খুশিই।
মধুরিমা- সমস্ত রাজ্যেই বইমেলায় ব্লুমসবেরি উপস্থিত থাকে। কলকাতা বইমেলা থেকে যতটা ব্যবসা প্রত্যাশা করেন ততটাই কি পান?
সুদীপ্ত- কলকাতা বইমেলায় আমরা অংশগ্রহণ করছি সবে ৩ বছর। তার আগে করতাম না কারণ তেমন যোগ্য অংশীদার পাইনি। আমাদের একটিই মাত্র অফিস দিল্লিতে, সব কর্মচারীও সেখানেই। ফলে বইমেলার জন্য দিল্লি থেকে কর্মচারীদের নিয়ে আসা কষ্টসাপেক্ষ হয়ে যায়। ওই সময়েই আবার ওয়ার্ল্ড বুক ফেয়ার শুরু হয়ে যায়। সম্প্রতি আমরা কলকাতায় আমাদের ভরসাযোগ্য অংশীদার পেয়েছি। এখন তাঁরাই অনেকটা সামলে নেন। আমরা যেমন বইপত্র নিয়ে যাই তার বিক্রি নিয়ে আমরা বেশ সন্তুষ্ট। আমরা খুব বেছেই, বই বিক্রির চাহিদা দেখেই বই কলকাতায় পাঠাই।
মধুরিমা- সবচেয়ে বেশি বই কোথায় বিক্রি হয় ব্লুমসবেরির?
সুদীপ্ত- বিক্রির দিক থেকে এগিয়ে উত্তর ভারত। মজার বিষয় হচ্ছে, লোকে বলে অবাঙালিরা বই কম পড়ে। কিন্তু ব্যবসা আমাদের সবচেয়ে বেশিই। ওখান থেকেই সাপ্লাই হয় সারা দেশে। কলকাতায় ১০% ছাড় পেলেই মানুষ খুশি। অন্যত্র রীতিমতো দরকষাকষি চলে কিন্তু! বইমেলায় এত বিক্রি বেশি হয়, অন্য সময় হয় না তার একটা কারণ হচ্ছে এখানের মানুষ টাকা জমান বইমেলায় একসঙ্গে বই কিনবেন বলে। একটা ঘটনা বলি। সাল ১৯৯৭! এককালে বিদেশ থেকে ফটোগ্রাফার বলে ম্যাগাজিন আনাতাম আমরা। এখন মনে হয় সেসব আর পাওয়া যায় না। তো একজন ভদ্রলোক, বেশ বয়স্ক, তিনি এসে ওই পত্রিকার কিছু সংখ্যা চান। আমি জানাই, সেগুলো আর পাওয়া যাবে না। তিনি খুব জোরাজুরি করেন। আমি ভাবছিলাম, তিনি হয়তো পেশাগতভাবে ফটোগ্রাফার। নাহলে এমন বিষয়ে পত্রিকার জন্য এত মরিয়া কেন? অবাক হই জেনে যে তাঁর সঙ্গে ক্যামেরার কোনও সম্পর্কই নেই। জীবনে কখনও ফটো তোলেননি তিনি। কিন্তু ফটোগ্রাফি বিষয়ে তিনি পড়তে ভালোবাসেন! এ জিনিস কলকাতা ছাড়া কল্পনা করা যায় না! বইমেলায় এই উন্মাদনা থাকে, বইয়ের দোকানগুলিতে বইয়ের ব্যবসা কিন্তু হয় না। এটাই কলকাতা বইমেলার প্রাণ।