ছোট টাউনের আশ্চর্য সেই হাওয়া

Football Match and The Memory of Barbil: আমি মুগ্ধের মতো প্রায় অপলক দেখে চলেছি, ‘শত্রু’-কে এত অপরূপ দেখতে লাগে? দৌড়ে যাচ্ছে ওরা, ধুলো উড়িয়ে, সে ধুলো আমার নাকে আজও বাসা বেঁধে থাকে। আর মনে থেকে যায় একটা দৃষ্টি বিনিময়, এক...

আমাদের বসার যে ঘরটা ছিল, যার একটা দেওয়ালে ল্যামিনেট করা দু'টো সাদা ফুটফুটে বেড়ালের ছবি ছিল, সেখানে একটা মোটা ভারী লাল রঙের কার্পেটও ছিল। তাতে বসে, বাবা রেডিয়োয় 'কলকাতা ক' ধরত। স্থানীয় সংবাদ পড়ছি… আমার শুধু মনে আছে, মুড়ি-চানাচুর খাওয়া থামিয়ে বাবা প্রায়ই হতাশা নিয়ে উঠে যেত পেছনের বারান্দায়। গিয়ে চুপ করে ওই দূর ঠাকুরানি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আসলে সংবাদ যিনি সেদিন পড়ছিলেন, তিনি সদ্য জানিয়েছেন যে মোহনবাগান হয় সালকিয়া ফ্রেন্ডস-এর সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করেছে বা সালগাওকরের বিরুদ্ধে ৭০ মিনিট অবধি বাবু মানির করা গোলে এগিয়ে থেকেও, শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে গেছে। বাবার এই হা-হুতাশ আমিও ক্রমে ইনহেরিট করলাম এবং তখন হঠাৎ খেয়াল হল যে ঈশ্বর এ বার থেকে 'দোগুনা লগান' নেবেন বলে ডিসাইড করেছেন। তা কী করতেন তিনি? না, দুম করে কারেন্ট অফ করে দিতেন! কিন্তু তাতে রেডিয়োর কী? ফলে গাঁক গাঁক করে সেই স্থানীয় সংবাদ মারফৎ খবর আসত, যে চিমা কুমারটুলিকে একা ধ্বংস করে দিয়েছে বা জেসিটি অনেকক্ষণ নিজ দূর্গ সামলে রেখেও শেষ মুহূর্তে কৃশানুর চুলচেরা পাসে কিস্তিমাত খেয়েছে।

মানে ওকে, ঠিক আছে, আমরা সালকিয়া ফ্রেন্ডসের কাছে আটকে গেছি, তা বলে ইস্টবেঙ্গলকে ঈশ্বর ওভাবে পার করিয়ে দেবেন, প্রতিবার! সরাসর না-ইনসাফি, আই স্টিল বিলিভ। ফলে যে সন্ধেগুলোয় মোহনবাগানের বৈতরণী পার হত না, শুধু সেগুলোই নয়, আরও অনেক সন্ধে, বাবার আর মুড়ি-চানাচুর বা ঘুগনি— মা যা বানাত সেদিন আর কী, ঠিক করে খাওয়া হত না। আমাদের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট কোনার্ক শাটারওলা টিভিতে যেসব খেলা দেখাত, ফেডারেশ কাপ বা রোভার্স-ডুরান্ডের সেমিফাইনাল আর ফাইনাল, সেগুলোয় আমি যাকে বলে বাণ মারার জন্যে বসে থাকতাম। কোথায় ওই চিমা বলে লোকটা, আর কৃশানু আর বিকাশ পাঁজি? শুনতাম লাল-হলুদ জার্সি ওদের, কিন্তু সাদা-কালোর কী-ই বা লাল আর কী-ই বা হলুদ! তাই আমারও আর ঠিক করে বাণ মারা হত না। অবশ্য বাণ মারা কী, তখন
তা-ও কি জানতাম? জানলেও, মারতে পারতাম না। ওরকম শেখায়নি যে। বাবা, মা, আশি শেষের সে আবহ, বরবিলের।

আরও পড়ুন: ঈশ্বরের বরপুত্র মারাদোনা ও সেই সাদাকালো জাদুবাক্সটা…

বাবা লিগ ক্রিকেট খেলত শ্যামবাজারের হয়ে। পাঁচে ব্যাট করত আর স্টেডি অফ-স্পিন। শুনেছি, বাংলার হয়ে রঞ্জি খেলা লেগ স্পিনার সৌমেন (অপু) কুণ্ডু আর বাবা, চমৎকার পার্টনারশিপ ছিল। ফলে, আমি ছোট্ট থেকেই কাউন্টি ক্রিকেটের একটু-আধটু খবর জানি, হ্যাম্পশায়ারের বিরুদ্ধে গাওয়ারের দুরন্ত একটা ইনিংস (যে হ্যাম্পশায়ারেই তিনি ’৯০ সালে দল বদলে চলে যাবেন) বা সারে-র বিরুদ্ধে ভিভ রিচার্ড্সের ফালাফালা করে দেওয়া একটা ইনিংস, এমন সব আর কী। বা আমায় বাবা ধরিয়েছে অলরেডি, বেরি সর্বাধিকারীর লেখা 'বিদেশ সফরের ডায়রি'। অর্থাৎ ক্রিকেট সাহিত্য বা প্রকৃত অর্থে রিপোর্টিং কাকে বলে, আমি সেই তখন থেকেই একটু একটু বুঝছি। যদিও, এখানে বলতেই হয়, মা আমায় শিখিয়েছে ভেঙ্গ্সরকারের স্ট্রেট ড্রাইভ বা হ্যাডলি’র আউটসুইঙ্গার। বা সইয়দ মোদীকে যখন হত্যা করা হল, রাতে সানমাইকা করা টেবিলে বসে মা আর বাবা চুপ করে খেয়েছিল। অগত্যা সে শোক আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। বাবা বরবিলে কাজে লেগে পড়ায় খেলা ছেড়ে দিতে হয় বলাই বাহুল্য, কিন্তু খেলা কী করেই বা বাবাকে ছেড়ে যায়! তাই, বাবা পরীক্ষায় বসল আম্পায়ারিংয়ের। এবং সেখানেও এমন খেল দেখাল যে রঞ্জি খেলিয়ে একেবারে পৌঁছে গেল ইন্টারন্যাশানালের দোরগোড়ায়। মাঝ-আশির কথা বলছি। শোনা গেল, গুয়াহাটির নেহরু স্টেডিয়ামে ভারত-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ খেলানোর ভার পড়তে পারে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সে ম্যাচ আমি টিভিতে দেখেছিলাম। রয় ডায়াস, দলীপ মেন্ডিস, রবি রত্ননায়াকে, রঞ্জন মদগুল্লে ওদের…আর এ দিকে শ্রীকান্ত, গাভাস্কারের পর তিনে রমন লাম্বা, চারে ভেঙ্গ্সরকার, তার পর আজহার, শাস্ত্রী, চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত…

A journey to the down memory lane from a football match of East Bengal in Noamundi to death of a neighbour of a small town name Barbil by Anirban Bhattacharya Choto Town Proper Noun Robibarer Royak

বাবা খেলাটা একেবারে শেষে এসে দেখেছিল, আমার পাশে বসে। বাবার সে ম্যাচ খেলানো হয়নি, কারণ তার কিছুদিন আগেই যখন সব কিছু চূড়ান্ত হচ্ছিল, বাবার পক্স হল। কিন্তু সেসবের মধ্যেও বাবা আমায় শেখাল, অতর্কিতে ডিফেন্স-ভাঙা মুহূর্তও কী করে শেষমেশ সামলে নিতে হয়। নিজের মধ্যে একরকম 'স্টোইক' সত্তা জাগিয়ে তুলে। বাবা আবার ফিরে গেল—  আয়রন ওর, অ্যালুনিমিয়াম ওর, কোনটার কোয়ালিটি কেমন, কোনটাই বা এক্সপোর্ট কোয়ালিটি ইত্যাদিতে আর তার মধ্যেই এক দিন বাবার ডাক পড়ল কলকাতার বেন্টিঙ্ক্ স্ট্রিট অফিসে। বাবা কলকাতা যায় কাজে। আমার অবশ্য পোয়া বারো, কারণ ফিরবে তো জ্যেঠু-বম্মার দেওয়া অনেক কিছু ভালো-মন্দ নিয়ে। কিন্তু সেবার যেই না বাবা কলকাতা গেল, শোনা গেল, ওই ইস্টবেঙ্গল আসছে নোয়ামুন্ডিতে। তখন সদ্য তৈরি হচ্ছে টিএফএ, টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমি। তো ওদের সঙ্গেই একটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলবে। বাবার অফিস থেকে ঠিক করল, অনেকেই আগেভাগে কাজ সেরে যাবে খেলা দেখতে। ওরকম বাঘা টিম আর সামনে থেকে কে-ই বা ওই চত্বরে দেখতে পায়! আমি সেসব কথা শুনছি কিন্তু বাবা তো কলকাতায়, তাই আমি তো বাড়িতেই থাকব নির্ঘাৎ। তবুও নিশ্চিত ভাবেই আমার মুখ কাঁচুমাচু হয়েছিল। নইলে পাণ্ডা কাকু, দীপক কাকু, শ্যামল কাকুরা মা-কে এসে বলত না, বৌদি, মন্টা আমাদের সঙ্গে যাবে, মানা করবেন না যেন… এ বার কেস হল, আনন্দে যে আমি নাচিনি তা না কিন্তু ওই দেখুন আবার ঈশ্বরের কী দুরন্ত মস্করা, জীবনে প্রথম মাঠে বসে বড় একটা দলের খেলা দেখব, কার? না ই-স্ট-বে-ঙ্গ-ল! চুটিয়ে খেলা দেখব না মনেপ্রাণে ওদের হার ...? উফ!

এ সব বুঝতে বুঝতেই তো বেরিয়ে পড়লাম নোয়ামুন্ডি। দুপুরে খেয়েই। বাঁধভাঙা ভিড় হবে তাই আগেভাগে না পৌঁছলেই নয়। গিয়ে দেখি প্রায় মেলা বসে গেছে। টিএফএ অলরেডি মাঠে নেমে প্র্যাক্টিস করছে, ইস্টবেঙ্গল তখনও ঢোকেনি। আচ্ছা ওখানে স্ট্যান্ড বা গ্যালারি যাকে বলে, সেসব ছিল না। স্ট্রেট মাঠে বসে বা দাঁড়িয়ে দেখো। আমায় বসানো হল ফ্রেশ চুনলেপা সাইডলাইনের পাশে। পাশে মানে, আমিই অলমোস্ট কিছুটা সাইডলাইন। একটা চাপা গুঞ্জন হাওয়ায় চরকা কাটছে। রোদ্দুরেরও যেন আজ বাল্যকাল। হঠাৎ, কে একটা কী বলল... আর প্রায় প্রত্যেকেই তাকাল মাঠের বাঁ দিকে। একটা বড় বাস এসে থেমেছে। নামছে ইস্টবেঙ্গল। মনোরঞ্জন, তরুণ দে, বিকাশ পাঁজি, সুদীপ চ্যাটার্জি, প্রশান্ত, মনে হয় ভিক্টর অমলরাজ-ও ছিলেন, তারপর ভাস্কর, সেই মহারাজ — কৃশানু দে, পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় আর ওই যে মাথা দোলাতে দোলাতে স্থানীয় সংবাদ থেকে উঠে আসা, চিমা। অনেক পরে যখন রিডলি স্কট-এর ‘গ্লেডিয়েটর’ দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল, ওই তো ঠিক ওভাবেই তো নেমেছিল ইস্টবেঙ্গল। গোটা মাঠ সে দৃশ্য দেখে প্রথমেই উল্লাসে ফেটে পড়েনি কিন্তু। সবার কেমন এ অভূতপূর্ব দৃশ্যে ধাতস্থ হতে খানিক লেগেছিল। তারপর ফেটে পড়ল সেই সমবেত জয়ধ্বনি।

A journey to the down memory lane from a football match of East Bengal in Noamundi to death of a neighbour of a small town name Barbil by Anirban Bhattacharya Choto Town Proper Noun Robibarer Royak

আমি মুগ্ধের মতো প্রায় অপলক দেখে চলেছি, ‘শত্রু’-কে এত অপরূপ দেখতে লাগে? ঘোর কাটতে না কাটতেই শুরু হয়ে গেল নোয়ামুন্ডির মাঠে দেখা আমার একমাত্র সিম্ফনি। দৌড়ে যাচ্ছে ওরা, ধুলো উড়িয়ে, সে ধুলো আমার নাকে আজও বাসা বেঁধে থাকে। আর মনে থেকে যায় একটা দৃষ্টি বিনিময়, একটা আলতো হাসি। প্রশান্তের একটা পাস ধরার মুহূর্তে টিএফএ-র অলোক দাস বোধ হয় ট্যাকল করে সুদীপ চ্যাটার্জির কাছ থেকে বলটা সাইডলাইনের বাইরে পাঠিয়েছিলেন। বল লাফাতে লাফাতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল আমার কোলে। আর আমি দেখেছিলাম, সুদীপ চ্যাটার্জি আমার দিকে খানিক ঝুঁকে এগিয়ে আসছেন, ইশারা করছেন বলটা হাতে ধরিয়ে দিতে। আমার কানে তো কিছুই ঢুকছে না, সুদীপ আরও কাছে চলে আসছেন আমার, আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছি, হাতে ধরে ধুলো-ধূসরিত সে গোলকধাম। ইস্টবেঙ্গল তখন ৫-১ জিতছে, তারপর আরও ২ গোল দেবে, চিমা একাই বোধ হয় ৪, আর মনে আছে, টিএফএ-র গোলরক্ষক, অন্তত মুখ দিয়ে চারটে গোল বাঁচিয়েছিলেন, মানে মুখে শট লেগে গোল হয়নি আর কী।

আরও পড়ুন: বরবিলের সেই রাত আর ‘অমিতাক্ষর’ ছন্দ

বাড়ি ফিরছি যখন, জঙ্গুলে রাস্তা কেটে, আশপাশ ধীর লয়ে সান্ধ্য আহ্নিকে বসতে চলেছে, আর এমন ক্ষণে কেমন একটা আশ্চর্য রকম ফাঁকা লাগে দেখবেন। অন্তত আমার তো লাগেই। এই আজও। একটা অদ্ভুত শান্তি ওই আলোয় বিরাজমান, তবুও কী যেন একটার অভাব। একটা অল্প অস্থিরতা, কীসের আজও নাগাল পাইনি। আমার জীবনের প্রথম বড় ম্যাচ দেখে ফিরছি, ওই বলের গরমটা এই এখনও আমি টের পাই। কত চেয়েছি ইস্টবেঙ্গলের পতন, কিন্তু সেদিন ফিরতে ফিরতে আমিও মনে মনে রিপ্লে করে নিচ্ছি কৃশানুর ওই ভিনগ্রহী সেন্টার, প্রশান্ত ব্যানার্জির অভাবনীয় থ্রু পাস, চিমার শোল্ডার পুশ এবং নিট প্লেসমেন্ট জালে, বিকাশ পাঁজির গোললাইন থেকে অত্যাশ্চর্য গোল মিস আর সুদীপ চ্যাটার্জির আমার দিকে অল্প ঝুঁকে বল চাওয়া। মন বোধহয় ওই একবারই ক্ষণিকের জন্যে লাল-হলুদ।

বাবা সে রাতেই কলকাতা থেকে ফিরবে (তখনও জানি না, আমার জন্যে গিটার কিনে)। ভাবছি বাবাকে সবটা বলতে হবে, বাবা নিশ্চয়ই ‘শত্রু’-কে মনে মনে সম্মান করেছি বলে পিঠ চাপড়েই দেবে। হঠাৎ দেখি, বরবিল ঢোকার একটু আগে, রাস্তার ধারে একটা জটলা। বড়দের কথা থেকে বুঝলাম, এক জন বিষ খেয়ে মারা গেছে। আমি চিনতাম তাঁকে। একটা কালো ইয়া ভাল্লুক নিয়ে খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন। কেন এ সব হল তা তো জানি না কিন্তু তার দিন কয়েক বাদে শুনেছিলাম, ওই ভাল্লুকটাও না খেয়ে খেয়ে মারা গিয়েছিল।

বন্ধুর শোকে?

জানি না।

সে উত্তর শিয়রে নিয়ে আজও ঘুমোয় বোধহয়, আমার সে ছোট টাউনের হাওয়া...

More Articles