বিনয়ের অনুষঙ্গে
Binoy Majumdar: আমার ঘরে কোনো মহাপুরুষের ছবিও টাঙানো নেই। বইয়ের তাকের পাশে আছে একটিই ফোটোগ্রাফ, বাঁধানো। একজন বিনয় মজুমদার।
খেলা দেখতে ওই গ্যালারিতে আগেও বসেছি বটে, কিন্তু মাঠে পা রাখা সেই প্রথম। ইডেন গার্ডেন্স। সিএবি-র অনূর্ধ্ব তেরো টুর্নামেন্ট। আমাদের ছেলেবেলায় এর একটা বেশ গালভরা নামও চালু হয়েছিল— সামার ক্রিকেট। ১৯৯৩ সালের সেই প্যাচপ্যাচে গরমের এক সকালে, প্রথম বারের জন্য যখন ইডেনের সবুজ গালিচায় হালকা গা গরম করছি, এককথায় আত্মহারা হয়ে ছিলাম। মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, এই মখমলি ঘাসের উপর দিয়েই তো রানআপ নেন কপিল দেব নিখাঞ্জ! এইখানেই শিল্পতালুক গড়েন মহম্মদ আজহারউদ্দিন! এই পবিত্র মাটি আর ঘাস তাহলে ছুঁয়ে দিল আমার স্পাইকও!
আমরা যারা বেঁটে মানুষ, প্রকৃত প্রস্তাবে বিলো মিডিয়োকার, তাদের বেঁচে থাকার জন্য যোগ্য অনুষঙ্গের প্রয়োজন পড়ে। বার বার নিজেকে জুড়ে নিতে হয় অন্যের সঙ্গে। আজকের ভাষায়, ‘ট্যাগড’ হতে হয়। অন্যের আলোর ছিটে গায়ে মেখে ব্যক্তিগত অন্ধকার কাটিয়ে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় জীবনভর। যেরকম, আমার ক্রিকেটীয় অদক্ষতাকে সেই সকালে স্কোরবুক থেকে না পারুক, আমার ব্যক্তিমন থেকে সাময়িক মুছে দিতে পেরেছিল ইডেনের ওই ঘাস। কপিল-আজহারের অনুষঙ্গ, তাঁদের ছদ্ম-উপস্থিতি মনে মনে কলার তুলে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন: “আমি ভারতের প্রথম চাঁড়াল কবি!” জন্মদিনে আড়ালেই কবিতার মগ্ন সাধক বিনয় মজুমদার
আরও একটু বয়স হওয়ার পর ক্রিকেট বদলে যায় কবিতায়। আর ওই অনুষঙ্গের কেন্দ্রে উঠে আসেন বিনয় মজুমদার। আমি যে-ভাষায় কথা বলি, সেই ভাষায় একজন বিনয় মজুমদার বেঁচে রয়েছেন— এ নেহাত সামান্য ব্যাপার বলে মনে হয়নি সেদিন। আজও মনে হয় না। ইশকুল-জীবনের শেষ পর্বে একটি আরশোলা রঙের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ থেকে সেই ভাবনার সূত্রপাত। আর তলে তলে শুরু অনুষঙ্গের নির্মাণ প্রক্রিয়া। মজার ব্যাপার হল, পরে দেখেছি, এই প্রবণতার আভাস হয়তো বিনয়ের কবিতাতেও লুকিয়ে ছিল—
“আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
চিঠি লিখব না।
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।”
— এই যে ‘দুজনে মিলে’ জিতে যাওয়ার আকুতি, এখানেও কিছুটা ওই অনুষঙ্গ-ধারণার সমীকরণ খাটে না কি?
কবিতা তো ছিলই; কিন্তু কবিতার প্রত্যক্ষ পাঠের বাইরেই মূলত ছিল সেই অনুষঙ্গের বিবিধ বিন্যাস। বনগাঁ লোকাল, ঠাকুরনগর, বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস... নানা দিকে ছড়িয়ে পড়তে চাইত সেই প্রবণতার ধারা। মাত্র কিছুটা সময় ওই উচ্চতার একজন মানুষের সঙ্গও বাকি জীবনের ফিরতি রাস্তার জন্য তৈরি করে দিত এক বিচিত্র অভিঘাত। বছর কয়েকের সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ধারাবিবরণ এ-লেখার উদ্দেশ্য নয়। ২০০৬ সালে মারা যান বিনয় মজুমদার। অনুষঙ্গের প্রকৃতি, তার মাত্রাও বদলে যেতে থাকে। মাঝেমধ্যে কেবল তাঁকে ঘিরে স্মৃতির অতল থেকে মিডলাইফ ক্রাইসিসের মতো অস্থানে বেদনা ঝরে যায়।
তবু, জীবন বড়ো বিচিত্র আর সদাসম্ভাবনাময়। তার চলার গতিও সরলরৈখিক নয়, বরং চক্রাকার। তাই এতদিন পর আবার ফিরে আসতে পারেন বিনয় মজুমদার, ফিরে আসতে পারে তাঁর অনুষঙ্গ। বস্তুত, তাঁর হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপিকে নতুন কবিতার বইয়ের অবয়ব দিতে দিতেই এইসব মনে হচ্ছিল, মাস কয়েক আগে। ‘গোপনীয় ঘটনার বিবরণ’। টাইটেল-ভার্সোয় স্পষ্ট অক্ষরে ছাপা— ‘A Collection of Poems by Binoy Mojumdar’। তলায় প্রকাশকের নাম-ধাম। তাহলে সত্যিই, ‘আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়’!
এর শুরু অবশ্য আট-ন বছর আগে, খানিক কাকতালীয় ভাবেই। ‘বোধশব্দ’ পত্রিকার ‘ভেটকি’ সংখ্যার প্রস্তুতি সেসময় তুঙ্গে। কলেজ স্ট্রিটের এই কবিতা-পাগল মিথমানব 'ভেটকি' আকা সিদ্ধার্থ দাসের নানা কিছু নিয়ে তখন ছানবিন চালাচ্ছি সর্বসময়। অকস্মাৎ ফেসবুকে মেসেজ, তারপর ফোন। ‘গ্রাফিত্তি’ পত্রিকার শুভঙ্কর দাশ। বাংলা লিটল ম্যাগাজিনকে যে কত বড়ো মনের সব মানুষজন আজও ধরে রেখেছেন, এই ফোনটি ছিল তার অন্যতম নিদর্শন। শুভঙ্করদার কাছে থাকা বিনয় মজুমদারের একটি অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি আমাদের হাতে তুলে দিতে চান। কেন? কারণ, ১৯৮৮ নাগাদ এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভেটকি। ‘সমবেত আর্তনাদ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তার বিজ্ঞাপনও। কিন্তু সে-বই আর প্রকাশ পায়নি। সেই পাণ্ডুলিপি ছিল শিল্পী পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের জিম্মায়। সম্ভবত প্রচ্ছদ করার কথা ছিল তাঁরই। এরপর দিল্লির এক পানশালায় শুভঙ্করদার বন্ধু তমিস্রাজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে আসে পাণ্ডুলিপিটি। তিনি তুলে দেন শুভঙ্করদার হাতে। এর পরেও বহু দিন কেটে যায়— ফের হাতবদল সেই পাণ্ডুলিপির। দীর্ঘ সাতাশ বছর পর ছাপাখানার মুখ দেখে কবিতাগুলি। প্রাথমিকভাবে ছাপা হয় ‘বোধশব্দ’-র ওই ভেটকি সংখ্যাতেই।
স্বতন্ত্র বই হয়ে বেরোতে তখনও ছিল দেরি। মনে পড়ে, এরপর প্রতি বছর বইমেলায় প্রসূন ভৌমিক এসে স্নেহপূর্ণ তাগাদা দিয়ে যেতেন বইটি প্রকাশের দাবি জানিয়ে। সময় নিয়ে হলেও প্রকাশের কাজটি অবশেষে সম্পন্ন করা গিয়েছে, যতটা পারি যত্ন সহকারে— বইটিকে যথাসম্ভব গুরুত্ব দিয়েই। শুধু কবিতা নয়, পাণ্ডুলিপির পাতাগুলির ছবিও প্রায় অবিকল রাখা হয়েছে এই বইয়ে। মুখবন্ধ লিখেছেন মৃদুল দাশগুপ্ত। ছবি এঁকেছেন সম্বরণ দাস। আর, প্রচ্ছদের ছবি— নান আদার দ্যান সন্দীপ কুমার! ব্লার্বে লেখা—‘চিরজাগরূক বিনয় মজুমদারের নবতম কাব্যগ্রন্থ এবং পাণ্ডুলিপি’। ১৩৬ পৃষ্ঠা। হার্ড বাউন্ড।
আরও পড়ুন: স্টল নয় টেবিল, লিটল ম্যাগাজিনের স্পর্ধা আজও আকাশছোঁয়া
পাণ্ডুলিপি থেকে বই। ১৯৮৮ থেকে ২০২৩। মাঝে তিনটি গোটা দশক ভ্যানিশ। গোটা পৃথিবীটাই বদলে গিয়েছে এই সময়কালে। বিনয় মজুমদারকেও কম অবহেলা আর প্রবঞ্চনার শিকার হতে হয়নি। কখনও তাঁকে পুরস্কার দেওয়া নিয়ে আপত্তির পাঁচিল খাড়া হয়েছে। কখনও বড়ো কাগজে তাঁর জন্মদিন উদ্যাপনের ছবি বিবমিষার উদ্রেক করেছে। তাঁর অসুস্থতাকে পুঁজি করে, শুনতে পাই, আরও কত কীই-না হয়েছে। কিন্তু বাংলা কবিতার পাঠক তাঁকে মাথায় করে রেখেছেন। আজও তরুণ প্রজন্ম তাঁকে খুঁজে পড়ে। কোনো প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষণার তোয়াক্কা না করে মৃত্যুর পরেও ভীষণরকম টিকে যাওয়া— একজন কবির কাছে এই অমরতার থেকে বড়ো আর কী হতে পারে! আমি মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করি না। আমার ঘরে কোনো মহাপুরুষের ছবিও টাঙানো নেই। বইয়ের তাকের পাশে আছে একটিই ফোটোগ্রাফ, বাঁধানো। একজন বিনয় মজুমদার। সময়ের ধুলো পড়ছে ঠিকই, কিন্তু আমার কাছেই-বা এর চেয়ে বড়ো আর কী হতে পারে!