স্টেশন মাস্টার থেকে শৌচাগারের রক্ষণাবেক্ষণ, রাজ্যের প্রথম মহিলা পরিচালিত স্টেশনের খোঁজ
২০২২ সাল থেকে এই স্টেশনের ভার সম্পূর্ণ মহিলাদের হাতে ছাড়া হল। সেই সুবাদে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেল তো বটেই, এমনকি গোটা পশ্চিমবঙ্গে প্রথম পূর্ণাঙ্গ মহিলা পরিচালিত স্টেশন।
দার্জিলিং জেলার নিউ জলপাইগুড়ি জাংশান থেকে উত্তর-পূর্ব সীমান্তের রেলপথটি দু'টি দিকে ভাগ হয়ে যায়। একটি জলপাইগুড়ি, কোচবিহার পার করে চলে যায় গুয়াহাটির দিকটিতে। অপরটি খানিক এগিয়ে শিলিগুড়ি জাংশান থেকে আবার দুটি ভাগে ছড়িয়ে পড়ে। শুকনা হয়ে টয়ট্রেনের ন্যারো গেজের লাইন, যাচ্ছে দার্জিলিং শহর অবধি। আরেকটি সেভক, ওদলাবাড়ি, মালবাজার, চালসা হয়ে আলিপুরদুয়ারের দিকে চলে গিয়েছে। এই শিলিগুড়ি জাংশান ও নিউজলপাইগুড়ি জাংশানের মাঝে রয়েছে একটি বহু পুরনো রেল স্টেশন। শিলিগুড়ি টাউন। এর উপর দিয়ে গিয়েছে মহাবীরস্থান উড়ালপুল। মূলত এই স্টেশনটিকে কেন্দ্র করেই শিলিগুড়ি শহরের গড়ে ওঠা। ১৮৭৮ সালে যখন স্টেশনটি তৈরি হচ্ছে তখন শিলিগুড়িতে তেমন জনপদ ছিল না। ব্রিটিশদের দার্জিলিং ভ্রমণের উদ্দেশ্যে টয় ট্রেন চালুর জন্য তখন এটি তৈরি করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এখন এর একপাশে শিলিগুড়ির ২৮ নম্বর ওয়ার্ড টিকিয়া পাড়া, অন্যপাশে ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাগরোকাট সহ একাধিক বস্তি।
এর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন বাঘা যতীন, রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্ব। এই স্টেশনেই বাঘা যতীন দুই ব্রিটিশ পুলিশকে উচিত শিক্ষা দেন। সে ঘটনার স্মরণে প্ল্যাটফর্মে রয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভও। মংপু কিম্বা কালিম্পং ভ্রমণের সময় এই স্টেশনেই নামতেন রবীন্দ্রনাথ। তারপরে শুরু হত সরু লাইনের টয় ট্রেনে যাত্রা। গেইলখোলা হয়ে কালিম্পঙে যেতেও এখানেই নাবতে হত। এনজেপি বলে কিছু ছিল না তখনও। আরও অনেক দশক পরে ১৯৬১ নাগাদ নিউ জলপাইগুড়ি জাংশান তৈরি হবে। এই স্টেশনে নেমে দার্জিলিং গিয়েছেন গান্ধীজি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। এই ধরনের নানা বিখ্যাত মানুষের স্মৃতি বয়ে ফিরছে এই প্রাচীন স্টেশনটি।
আরও পড়ুন- রাত নামলে পা রাখে না মানুষ! হাড় হিম করা এই রেলস্টেশনগুলি রয়েছে ভারতেই
তবে বর্তমানে এর গুরুত্ব অন্য। ২০২২ সাল থেকে এই স্টেশনের ভার সম্পূর্ণ মহিলাদের হাতে ছাড়া হল। সেই সুবাদে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেল তো বটেই, এমনকি গোটা পশ্চিমবঙ্গে প্রথম পূর্ণাঙ্গ মহিলা পরিচালিত স্টেশন। গোটা দেশে এমন স্টেশন রয়েছে মাত্র তিনটি। রাজ্যেও এমন স্টেশন আর নেই যেখানে ট্রেনের আসা-যাওয়া থেকে সিগনাল, লগ, অপারেশন, যাবতীয় কাজ মহিলারাই করে থাকেন। ফলত গোটা রাজ্যের মধ্যেই ব্যতিক্রমী হিসেবে নজর টেনেছে স্টেশনটি। এখানকার স্টেশন ম্যানেজার মহিলা। তিনজন পয়েন্টস্ম্যান মহিলা। দুজন পোর্টার। তারাও মহিলা। চারজন জুনিয়র কমার্সিয়াল ক্লার্ক, এগারোজন মাল্টিস্কিল্ড স্টাফ, শৌচাগার রক্ষক– সবাই মহিলা। চারজন গেটকিপারের মধ্যেও দুইজন মহিলা। এই ধরনের পদে এক দুজন পুরুষ রয়ে গিয়েছেন এখনও। তবে স্টেশনটি মূলত পরিচালনা করেন মহিলারাই নিজস্ব দক্ষতায়। এই ঐতিহ্যবাহী স্টেশন মহিলাকর্মীদের হাতে একটু করে একটু করে আবার তার হৃতসর্বস্ব মর্যাদা ফিরে পাচ্ছে। এই স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন ৪টি যাত্রীবাহী ত্রেন ছাড়াও ৩০ টি ট্রেন যাতায়াত করে।
দীর্ঘদিন ধরে এই স্টেশন সম্বন্ধে স্থানীয় লোকেদের নানা অভিযোগ ছিল। বিশেষত এনজেপি তৈরি হওয়ার পর থেকে স্বাভাবিক কারণেই এই স্টেশনের গুরুত্ব কমে গিয়েছিল। তাই নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই। কিন্তু গুরুত্ব কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর রক্ষণাবেক্ষণের প্রতিও উদাসীন হয়ে পড়েছিল সরকার। এই নিয়ে বহুদিন বহু অসন্তোষ দেখা গিয়েছে। প্রচুর লেখালেখি করেছেন গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য। অ্যাক্টের প্রধান রাজ বসুও এই নিয়ে সরব হয়েছিলেন। এই চত্বরে পালিত হয়েছিল বিশ্বপর্যটন দিবসও। ক্রমশই দেখভালের অভাবে মাদকাসক্ত, মাতাল, চোর, ছ্যাঁচোড়ের আড্ডা হয়ে উঠছিল স্টেশন চত্বরটি। কাজেই মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত স্টেশনের পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানালেও, পরিকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকেই। এমনকী তৎকালীন কর্মরতা মহিলা কর্মচারীরাও বারবার অভিযোগ জানিয়ে আসছিলেন স্টেশনে কাজ করার পরিবেশ নেই। চত্বরে কোনও বেড়া দেওয়া নেই। যে কেউ ঢুকে আসতে পারে। স্টেশনের ভেতরেই হাট বসে, প্রচুর বাইরের লোক অবাধে যাতায়াত করে— ইত্যাদি নানা ধরনের অভিযোগ ছিল।
আরও পড়ুন- দেশের সব মেট্রো স্টেশনকে বলে বলে গোল দেবে শিয়ালদহ মেট্রো, কী কী ব্যবস্থা অন্দরে
কিন্তু বর্তমানে হাওয়া ঘুরে গিয়েছে। মহিলাদের হাতে এই স্টেশনের অবস্থা ফিরে আসছে দিনের পর দিন। এ বিষয়ে স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার প্রতিমা দে বলেন, “আমাদের স্টেশনে যাঁরা নতুন আসেন তাঁরা সবাই মহিলা বলে অনেকে চমকে যান। ভাল করে খুঁটিয়ে দেখেন। প্রথম প্রথম অস্বস্তি হত, এখন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে।” দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টার ডিউটি মহিলাদের। বাড়ানো হয়েছে স্টেশনের নিরাপত্তা। প্ল্যাটফর্মে ঢোকা ও বেরনোর মুখে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগান হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজারের বয়ান অনুযায়ী, প্রথম প্রথম যখন তিনি বদলি হয়ে এখানে আসেন তখন সত্যিই রাতের দিকে গা ছমছম করত। জুয়ার ঠেকের পাশাপাশি ছিল মাতালদের উপদ্রব। একটা ভয় ভয় মাখা প্রচার থাকায় আসলে আরও ভয় জাঁকিয়ে বসত। কিন্তু তেমন বড় কোনও সমস্যা হয়নি। ধীরে ধীরে ভয় কেটেছে। ছোটখাট ঝুট ঝামেলা সব জায়গাতেই লেগে থাকে। সেগুলো আরপিএফ সামলে নেয়। আর এখন স্টেশনটিকে আলো, ক্যামেরা–ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “প্রত্যেক মহিলাকর্মী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। এখনকার মেয়েরা সীমান্তেও লড়ছে। কোথাও পিছিয়ে নেই। আমিও কাজ করছি। সত্যি বলতে অবশ্যই সহযোগিতারও প্রয়োজন হয়। আর এখানে তা পেয়েছি। এখনও পর্যন্ত কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আমরা মহিলারাই সকাল থেকে রাত এই স্টেশনে কাজ করি। চিন্তার কিছু নেই। আমরাও কাধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারি। স্টেশনটি পরিচালনার সমস্ত কাজই এখন পুরোদমে চালাচ্ছেন মহিলারা।”