ভ্রমণ বিলাসীদের আকর্ষণীয় স্থান পাকিস্তানের বালুচপ্রদেশ
পাকিস্তানে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠলেই অনেক ভারতীয় দ্বিধাগ্রস্থ হন| ভারত ও পাকিস্তান এই দুই দেশের মধ্যে সবসময়ই একটা দূরত্ব থেকে গেছে| যুদ্ধ থেকে মনোমালিন্য হামেশাই লেগে থাকে | এই পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও বহু পাকিস্তানি আসেন ভারতবর্ষে বেড়াতে, অন্যদিকে ভারতবাসীরাও যান পাকিস্তানে ঘুরতে, তবে সেটা খুবই কম ধরা যায়| বিশেষ করে যারা ভ্রমণ প্রিয় মানুষ হন তারা পৃথিবীর ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেতে পছন্দ করেন| সেই মতো অনেকেই পাকিস্তানের বালুচপ্রদেশ অর্থাৎ বালুচিস্থানে ঘুরতে যান| এই শহরটিতে বেশি কিছু আকর্ষণীয় স্থান আছে যা সকলেরই বেড়াতে গেলে ভাল লাগবে, আজ সেই সমস্ত জায়গাগুলির কথা এই প্রতিবেদনে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে| এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই স্থানটি এই বালুচিস্থানে আছে সেটি হলো হিন্দু দেবী 'মা হিংলাজ'-এর মন্দির|
হিঙ্গলাজ দেবীর মন্দির: সতীর ৫১ পীঠের অন্যতম হল পাকিস্তানের হিঙ্গলাজ দেবীর মন্দির | হিংলাজ পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের মাকরান মরুভূমিতে অবস্থিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান | করাচি থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার উত্তরে বেলুচিস্তান প্রদেশে অবস্থিত এই মন্দির | ৫১ টি পীঠের মধ্যে ৪২ টি ভারতে এবং বাকী ১ টি তিব্বত, ১ টি শ্রীলঙ্কা, ২ টি নেপাল, ৪ বাংলাদেশ এবং একটি পাকিস্তানে | পুরাণ অনুসারে জানা যায়, বালুচিস্তানের লাসবেলায় মাকরান উপকূলের কাছে গিরিখাতে থাকা হিংলাজে সতীর সিঁদুর বা হিংগুল মাখা মাথা পড়েছিল | তাই হিন্দুদের কাছে হিংলাজ পীঠ খুবই পবিত্র |পাকিস্তানের এই হিন্দু দেবীর মন্দিরে নিয়মিত পুজো করে আসছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরাও | হিংলাজ দেবীকে অনেকে হিঙ্গুলা দেবীও বলেও থাকেন | নানি মন্দির হিসেবেও পরিচিত হিংলাজ দেবীর এই মন্দির | হিংলাজের মন্দিরটি একটি গুহার মধ্যে অবস্থিত৷ এটি আসলে একটি প্রাকৃতিক গ্যাসের অগ্নিকুণ্ড৷ অগ্নিজ্যোতিকেই হিংলাজদেবীর রূপ বলে মানা হয়৷ বর্তমানে এখানে খুব কম পর্যটক আসেন৷ এখানে হিঙ্গোল ন্যাশনাল পার্ক বলে একটি অভয়ারণ্য রয়েছে৷ সেখানে কুমীর সংরক্ষণ করা হয়। মহাভারতেও হিঙ্গলাজ মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। সিন্ধ প্রদেশের রাজা জয়দ্রথ হিঙ্গলাজ মন্দিরের আশেপাশে অনেক মন্দির স্থাপন করেছিলেন। এই মন্দিরে প্রতি বছর এপ্রিল মাসে চার দিনের জন্য যে তীর্থযাত্রা হয়, তাতে অংশ নেন মুসলিমরাও। একে তাঁরা বলেন 'নানি কি হজ'।
হিঙ্গল ন্যাশনাল পার্ক: হিঙ্গল ন্যাশনাল পার্কটি হল মাকরান উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত পাকিস্তানের বৃহত্তম জাতীয় পার্ক | এই পার্কটি প্রায় ৬১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত | পার্কটি করাচি থেকে ১৯০ কিলোমিটার দূরে বালুচিস্তানের তিনটি জেলা গোয়াদার, লাসবেলা এবং আওয়ারানে অবস্থিত| হিঙ্গল ন্যাশনাল পার্কটিকে ১৯৮৮ সালে একটি জাতীয় পার্ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল| সেটি বস্তুত বিপন্ন বন্যপ্রাণীদের জন্য একটি অভয়ারণ্য| এই অভয়ারণ্যে স্থান পেয়েছে ২৫৭ প্রজাতির তরুলতা, ২৮৯ প্রজাতির জন্তু | যাদের মধ্যে রয়েছে ৩৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীব, জলজ প্রাণী, সরীসৃপ ও পরিযায়ী পাখি | অভয়ারণ্য ও তার নিকটবর্তী স্থানে ৬০টি বিভিন্ন প্রকারের কুমির আছে | আরবসাগর থেকে উদ্ভুত হিঙ্গল নদীর নাম এই অভয়ারণ্যটির নামকরণ করা হয়েছে | এই অভয়ারণ্যটির সম্মন্ধে এই কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য যে যতখানি এলাকা জুড়ে তার বিস্তার, সেই এলাকার মধ্যেই ৬টি ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ু - অঞ্চল, মরুভুমি অঞ্চল এবং শ্যামল ও স্বাভাবিক সমতলভূমি আছে |
ওরমারা টার্টেল বিচ: বালুচিস্তানে অবস্থিত উপকূলবর্তী এলাকায় 'ওরমারা' নামে আন্তর্জাতিক ভাবে বিখ্যাত একটি বিস্তীর্ণ জলাভূমি আছে যেটি বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ সংরক্ষণের জন্য বিখ্যাত | ২৪০০ হেক্টর পরিমিত ভূমি জুড়ে এর বিস্তার | ইউনেস্কোর (UNESCO ) তত্ত্বাবধানে ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত 'রামসার কনভেনশান' -এর বিধিবিধান অনুযায়ী এই জলাভূমিতে জীব সংরক্ষণের কাজ হয় |
কুন্দ মালির: কুন্দ মালির নামে বালুচিস্তানে একটি সমুদ্র সৈকত আছে, যেটি হিঙ্গল ন্যাশনাল পার্কার মধ্যে অবস্থিত | সৈকতটি মাকরান কোস্টাল হাইওয়ে (Makran Coastal Highway এ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত | পাকিস্তানের বৃহত্তম শহর করাচির ২৩৬.৮ কিলোমিটার পশ্চিমে এই সৈকতটি অবস্থিত | কুন্দ মালির থেকে ওরমারা সমুদ্র সৈকতের সড়ক পথের দু ধারে ছড়িয়ে থাকা নিসর্গ দৃশ্য যেকোনও ভ্রমণ পিপাসুকে মুগ্ধ করবেই | কুন্দ মালির -কে পৃথিবীর অন্যতম সেরা সৌন্দর্যপূর্ণ সৈকত রূপে গণ্য করা হয় | বিভিন্ন দেশের পর্যটনকারীদের সংখ্যা দিনে দিনে প্রভূত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে, তাদের সুবিধার্থে সেখানে 'ইউফোন' (Ufone ) মোবাইল পরিষেবা চালু করা হয়েছে | এই অঞ্চলটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি দেশ-বিদেশের পরিভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য বহু পর্যটন ব্যাবসায়ী সংস্থা তাদের পরিষেবা প্রদানের কাজে এগিয়ে এসেছে | জায়গাটির অন্যতম বৈশিষ্ট হল যে সেখানে একইস্থানে পর্বত, সমুদ্র এবং মরুভূমির সমাবেশ এমন প্রাকৃতিক শোভার সৃষ্টি করেছে যা অকল্পনীয় |
পীর গাইব: পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের অন্তর্গত বোলানে পীর গাইব নামে একটি ঝর্ণা আছে | স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস অনুযায়ী এক অদৃশ্য (গাইব) পীর বাবার কৃপায় এই ঝর্ণাটির সৃষ্টি হয়েছে | কথিত আছে, এক দুষ্ট রাজার অনুচরেরা পীর বাবাকে আক্রমণ করেছিল | কিন্তু সর্বশক্তিমান ঈশ্বর পীর বাবাকে রক্ষা করেছিলেন | ঘটনাক্রমে পীরবাবা একটি পর্বতের গায়ে একটি লাঠি দিয়ে আঘাত করেছিলেন | যেখানে আঘাত করেছিলেন সেখান দিয়ে বিরামহীন ভাবে জলের ধারা বয়ে চলেছে, আজও | বিশ্বাস করুন, আর না করুন।