বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থা ঠিক কী? কেন এর বিরোধিতায় প্রাণ হারালেন পড়ুয়ারা?

Bangladesh Quota System: পড়ুয়ারা কিন্তু সবরকমের কোটা তুলে দেওয়ার পক্ষে নন। জাতিগত সংখ্যালঘু এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য চাকরি সংরক্ষণে সমর্থন রয়েছে তাঁদের।

৬ জনের প্রাণ গিয়েছে। হিংসা থামেনি তবুও। বাংলাদেশে টানা দুই সপ্তাহ ধরে চলছে কোটা বিরোধী বিক্ষোভ। দুই সপ্তাহ পেরিয়ে তা হিংসাত্মক আকার নিয়েছে। ক্ষমতাসীন শাসকদলের সঙ্গে যুক্ত দলগুলি রাজধানী ঢাকা সহ বাংলাদেশের জেলায় জেলায় আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের উপর যে হামলা চালিয়েছে তাতে উত্তাল বাংলাদেশ জুড়ে একাধিক মৃত্যু ঘটেছে। চার শতাধিক আহত মানুষের গোঙানি মিশে আছে বাংলাদেশের পথেঘাটে। ছাত্রছাত্রীরা সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংশোধন চেয়ে আন্দোলন করছিলেন। কী এই কোটা ব্যবস্থা?

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব। এরই মধ্যে সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পথে নামেন ছাত্রছাত্রীরা। ঘটনার সূত্রপাত এই বছরের ১ জুলাই। সেদেশের হাইকোর্ট জানায়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য সিভিল সার্ভিসের এক-তৃতীয়াংশ পদ সংরক্ষিত থাকবে। এই কোটা আগেও ছিল, হাইকোর্ট তা পুনর্বহাল করে। আগেই যদি ছিল তাহলে এখন নতুন করে বিক্ষোভের কারণ কী? কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করা হচ্ছে কেন?

সারা বাংলাদেশেজুড়ে মূলত সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা প্রচলিত চাকরির কোটা পদ্ধতির সংস্কার দাবি করছে। এই কোটা ব্যবস্থার অধীনে অর্ধেকেরও বেশি সরকারি চাকরি সংরক্ষিত রয়েছে। বিক্ষোভকারীরা বলেছেন, কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক নেই। তারা নিজেদের হকের দাবিতে পথে নেমেছেন। সংরক্ষণ নয়, চাকরিতে যোগ্যতা-ভিত্তিক ব্যবস্থা চান তারা যা সবার জন্য প্রযোজ্য হবে। বিক্ষোভকারী পড়ুয়ারা একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে প্রথম বিক্ষোভের আয়োজন করেছিল। কোনও রাজনৈতিক সংগঠনের সমর্থন ছিল না সেখানে।

আরও পড়ুন- গুলি, রক্ত, মৃত্যু! কোটা আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশে শহিদ ৬ জন কারা?

এই বিক্ষোভের শুরুটা কোথায়?

২০১৮ সালে কোটাব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশে। সেই বিষয়টিকে অবৈধ বলে দেয় হাইকোর্ট। গত ৫ জুন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। এর আগে তুমুল আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিলেন।

বাংলাদেশের এই কোটা পদ্ধতি ঠিক কী?

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান একটি কোটা ব্যবস্থা চালু করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার যুদ্ধে যারা লড়াই করেছিলেন, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের জন্য সরকারি চাকরির একটি নির্দিষ্ট শতাংশ সংরক্ষণ করে কোটা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন মুজিবুর।

এই সংরক্ষণ ব্যবস্থায়, প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির ৪৪% সরকারি চাকরি মেধা ভিত্তিক। অবশিষ্ট ৫৬ শতাংশই নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত:

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ
মহিলাদের জন্য ১০ শতাংশ
অনগ্রসর জেলার জন্য ১০ শতাংশ 'জেলা কোটা'
জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য ৫ শতাংশ
শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ

কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের দাবি কী?

মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য এই ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের দাবিতে পথে নেমেছেন ছাত্রছাত্রীরা। এই পড়ুয়ারা কিন্তু সবরকমের কোটা তুলে দেওয়ার পক্ষে নন। জাতিগত সংখ্যালঘু এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য চাকরি সংরক্ষণে সমর্থন রয়েছে তাঁদের। তারা কোটা বাতিলের পক্ষে লড়ছেন না, চাইছেন সংরক্ষণ পদ্ধতির সংস্কার। সংরক্ষিত চাকরির শতাংশ কমাতে চান তারা।

শুরুর চার বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে প্রথমবার কোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়। এসময় মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো হয় এবং শুধু মহিলাদের জন্য আলাদা করে কোটার ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ মোট কোটার ৪০ শতাংশ মেধা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী এবং বাকি ১০ শতাংশ কেবলই জেলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়।

সংখ্যালঘুদের কোটায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে ১৯৮৫ সালে কোটা পদ্ধতির সংশোধন আনে তৎকালীন সংস্থাপন (বর্তমান জনপ্রশাসন) মন্ত্রক। বলা হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির পদের জন্য মেধাভিত্তিক কোটা থাকবে ৪৫ শতাংশ এবং জেলাভিত্তিক কোটা হবে ৫৫ শতাংশ। এই জেলাভিত্তিক কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ, মহিলাদের ১০ শতাংশ এবং উপ-জাতীয়দের জন্য ৫ শতাংশ পদ সংরক্ষিত থাকবে।

১৯৯০ সালে নন-গেজেটেড পদগুলোর নিয়োগে কোটা পদ্ধতিতে আংশিক পরিবর্তন আনা হলেও প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে তা অপরিবর্তিত থাকে। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ১৯৯৭ সালে। ১৯৮৫ সালের কোটা ব্যবস্থা অপরিবর্তিত রেখে কেবল ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় “উপযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী পাওয়া না গেলে মুক্তিযোদ্ধা/শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের পুত্র-কন্যার জন্য" তা বরাদ্দের আদেশ জারি করা হয়।

২০০২ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারটি দলের জোট সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ কোটার বিষয়ে আগের জারি করা নিয়ম বাতিল করে। এতে বলা হয়, “মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত ৩০% কোটা অন্য প্রার্থী দ্বারা পূরণ না করে সংরক্ষণ করার যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তা সংশোধনক্রমে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, ২১তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত ৩০% কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে উক্ত কোটার শূন্যপদগুলো (ক্যাডার ও নন-ক্যাডার) মেধাভিত্তিক তালিকায় শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদেরকে দিয়ে পূরণ করা যেতে পারে।” অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৩০ শতাংশে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা তালিকার প্রার্থী থেকে নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন- একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তোলপাড়! কেন রাস্তায় নামল বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ ছাত্রযুব?

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করলে এই নির্দেশ বাতিল করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য নির্ধারিত কোটা পূরণ করা সম্ভব না হলে পদ খালি রাখার নির্দেশ আসে। কোটায় পরবর্তী পরিবর্তন আসে ২০১১ সালে। এই সময় মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদেরও ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সবশেষে ২০১২ সালে এক শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা যুক্ত করে সরকার।

কোটা আন্দোলন প্রথম বড় আকার নেয় ২০১৮ সালে। ওই বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল এবং এর পুর্নমূল্যায়ন চেয়ে হাইকোর্টে পিটিশন দায়ের করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ও দুই সাংবাদিক কিন্তু মার্চ মাসে এসে ওই লিখিত আবেদন খারিজ করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত। ফেব্রুয়ারি মাসে ফেসবুকে ‘কোটা সংস্কার চাই’ নামে একটি পেজ খোলা হয় এবং শাহবাগকে কেন্দ্র করে পেজটি থেকে মানবন্ধনসহ নানা কর্মসূচির ঘোষণা শুরু হয়। এর মাধ্যমেই মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এই সময় কোটা সংস্কারের উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মও গঠন করা হয়।

ওই পিটিশন খারিজ হওয়ার পর কোটা পদ্ধতিতে কোনও পরিবর্তন করা হবে না, এই মর্মে আদেশ জারি করা হয়। তবে কোটা কার্যকর করার ক্ষেত্রে কিছুটা শৈথিল্য আনে সরকার। আদেশে জারি করে বলা হয়, সব ধরনের সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা তালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদের দিয়ে সেসব পদ পূরণ করা হবে। অর্থাৎ আগে যেখানে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ না হলে কোটা খালি রাখার কথা বলা হয়েছিল, সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার এবং মেধা তালিকা থেকে নিয়োগের কথা জানায়। তবে দাবি আদায়ে অনড় থাকে পড়ুয়ারা। সকলের জন্য ন্যায্য চাকরির সুযোগ চেয়ে রাস্তায় নামেন তারা।

টানা আন্দোলনের জেরে সেই বছরের ১১ এপ্রিল সংসদে দাঁড়িয়ে সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনা। এসময় নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বাতিল করে বিজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ১৪ তম থেকে ২০তম অর্থাৎ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদগুলোতে কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকেই নিয়োগের কথাও জানানো হয়।

কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে পিটিশন দায়ের করেন। চলতি বছরের গত ৫ জুন তাদের পক্ষে রায় আসে, অর্থাৎ আগের মতোই কোটা বহাল হবে বলে জানায় আদালত। এর প্রতিবাদে নতুন করে ১ জুলাই থেকে কোটা বাতিলের আন্দোলনে পথে নামেন শিক্ষার্থীরা।

More Articles