বিধ্বস্ত ওয়ানাড়ে 'ডার্ক ট্যুরিজম'-এর আশঙ্কা! কেন এই প্রবণতা বাড়ছে বিশ্বজুড়ে?

Wayanad Dark Tourism: ভয়ঙ্কর দৃশ্য এবং মৃত্যুর বিপর্যস্ত এলাকা দেখতে চাওয়াই নাকি 'অন্ধকার পর্যটন' বা ডার্ক ট্যুরিজমের মূলে।

কেরল মানেই অন্তহীন সবুজ পাহাড়, দিগন্তে এলিয়ে পড়ছে সবুজ গন্ধ। পাথুরে ভূমি পেরিয়ে চা বাগান, জলপ্রপাত। এই কেরল, যার ডাকনাম ঈশ্বরের নিজস্ব দেশ, প্রশান্তির খোঁজে যেখানে ছুটে যান পর্যটকরা, সেই কেরলে প্রায় তিনশো জনের প্রাণ গিয়েছে ভূমিধসে। প্রবল বর্ষণ আর তারই সঙ্গে ভূমিধসে বিপর্যস্ত ওয়ানাড়। এই বিপদের মধ্যে দাঁড়িয়েও, মানুষকে উদ্ধার করে প্রাণে বাঁচানোর পাশাপাশি কেরল প্রশাসন ও পুলিশকে এখন প্রচার করতে হচ্ছে কেরলে যাতে কোনওমতেই জাঁকিয়ে না বসে 'ডার্ক ট্যুরিজম'। কেরল নিঃসন্দেহে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটনকেন্দ্র। এখন সেই কেরলই পর্যটকদের দূরে থাকতে বলছে। কেরল পুলিশ পর্যটকদের সতর্ক করছে 'অন্ধকার পর্যটন' বা ডার্ক ট্যুরিজম থেকে বিরত থাকতে। একবার এই প্রবণতা শুরু হলে ওয়ানাড়ের মানুষকে বাঁচানো মুশকিল হবে বলেই আশঙ্কা প্রশাসনের।

কেরল পুলিশ সতর্ক করেছে, 'দর্শনীয় স্থান' দেখার জন্য বিপর্যস্ত স্থানগুলিতে যাবেন না। তাতে উদ্ধার অভিযান প্রভাবিত হবে। কিন্তু বিপর্যস্ত স্থান কীভাবেই বা 'দর্শনীয়' হতে পারে? কী এই ডার্ক ট্যুরিজম? সাম্প্রতিক সময়ে, দেখা যাচ্ছে, কেরলে মানুষ এমন বিপর্যয় বা অপরাধের স্থান নিজের চোখে দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন। বিপর্যয়ের সরাসরি অভিজ্ঞতা পাওয়ার 'অ্যাডভেঞ্চার'-ই নাকি 'ডার্ক ট্যুরিজম'-এর নেপথ্যে।

নতুন করে মেঘ বিস্ফোরণের ফলে ওয়ানাড়ে আরও কিছু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। আটকে পড়েছেন বহু মানুষ। প্রথম ভূমিধস হয় মেপ্পানি, মুন্ডক্কাই টাউন এবং চুরাল মালায়। মুন্ডক্কাইয়ের আট্টমালার কাছাকাছি একটি সেতুও ভেঙে পড়ে। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য এবং মৃত্যুর বিপর্যস্ত এলাকা দেখতে চাওয়াই নাকি 'অন্ধকার পর্যটন' বা ডার্ক ট্যুরিজমের মূলে। ডার্ক ট্যুরিজম বিষয়টি বিশ্বজুড়েই প্রচলিত।

আরও পড়ুন- মোদির দ্বারকায় সাবমেরিন-পর্যটন! ধর্মের নামে যেভাবে বলি হতে চলেছে পরিবেশের

পৃথিবীর কিছু কুখ্যাত জায়গা, ভুতুড়ে জায়গা বা ঐতিহাসিক কোনও স্থান যেখানে ভয়াবহ কোনও হত্যালীলা হয়েছে, হলোকাস্ট থেকে শুরু করে চেরনোবিল, গেটিসবার্গ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে হত্যার স্থান সমস্ত জায়গাগুলিই ডার্ক ট্যুরিজমের আওতায় পড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার রবেন দ্বীপ, যেখানে নেলসন ম্যান্ডেলা ১৮ বছরের জন্য বন্দি ছিলেন, সেটিও একটি ডার্ক ট্যুরিজম কেন্দ্র। কিন্তু কেরলের এই ঘটনাটি এসবের থেকে ঢের আলাদা।

ওয়াটারলু যুদ্ধের সময়ও এই ডার্ক ট্যুরিজম ছিল। সেখানে মানুষজন নিজেদের গাড়ির মধ্যে থেকে বসেই যুদ্ধটি দেখেছিলেন। ডার্ক ট্যুরিজম শব্দটি তৈরি করেন জে জন লেনন, পর্যটন বিষয়ের একজন অধ্যাপক তিনি। তিনিই জানিয়েছেন, এমনকী ফ্রান্সে জনসমক্ষে ফাঁসি দেখতেও ভিড় করেছিল জনগণ। বিশ্বজুড়েই অন্ধকার পর্যটন নিয়ে কৌতূহল বাড়ছে। মর্মান্তিক স্থানগুলিতে, বিপর্যস্ত এলাকাগুলিতে পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সে সময়ের রাজনৈতিক অবস্থা, যুদ্ধের কঠোর বাস্তবকে বোঝার জন্য পর্যটকরা এই ঐতিহাসিক জায়গাগুলিতে যেতে চান। আমেরিকার একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ৮২% মানুষ জীবনে অন্তত একটি ডার্ক ট্যুরিজম কেন্দ্রে গেছেন। এমনকী অনেকে এও বলেছেন, এই মুহূর্তে যুদ্ধ চলছে এমন জায়গাতেও যেতে চান তারা, ওই অভিজ্ঞতা সরাসরি পেতে। অনেকেই বলেছেন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউক্রেন সফর করতে ইচ্ছুক তারা, চান গাজা যেতে।

ভারতেও, পোর্ট ব্লেয়ারের সেলুলার জেল, উত্তরাখণ্ডের রূপকুণ্ড লেক বা জয়সলমীরের কুলধারার মতো স্থানগুলি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। সেলুলার জেলকে একসময় বলা হতো কালা পানি। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রাচীন এই কারাগার এখন একটি জাতীয় জাদুঘর। ব্রিটিশদের ভয়াবহ অত্যাচার এই জেলেই সহ্য করতে হয়েছে ভারতীয় বন্দিদের।

উত্তরাখণ্ডের রূপকুণ্ড হ্রদে বহু মানুষের কঙ্কালের অবশেষ রয়েছে। এই কঙ্কাল কোত্থেকে এল, কীভাবে এল তা আজও রহস্য। রাজস্থানের জয়সলমীরের কুলধারা গ্রামটি ঐতিহাসিক স্থান। কথিত আছে, এক রাতেই এই গ্রামের সব মানুষ উধাও হয়ে যায়। এই জায়গাগুলির সঙ্গে মর্মান্তিক ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে ঠিকই, তবে এগুলি ঐতিহাসিক স্থানও। কিন্তু যুদ্ধ বা প্রকৃতির রোষে বিপর্যস্ত স্থান দেখতে আগ্রহ বাড়ছে কেন?

আরও পড়ুন- ওয়ানাড় ধ্বংস হবে, ১৪ বছর আগেই জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা! কেন সতর্ক হয়নি সরকার?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ ইতিহাসের অন্ধকার দিক দেখতে ভালোইবাসে। মানুষ যখন এই জায়গাগুলিতে যায়, তখন তারা নিজেদের ওই পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। সেই মানুষটি ওই দুর্যোগের মুহূর্তে থাকলে কী করতেন, কীভাবে বাঁচতেন এই ভাবনাগুলি শিউরে তোলে যেমন, তেমন অদ্ভুত রোমাঞ্চও জাগায়। এই মানুষদের অধিকাংশই শুধু পর্যটক নন। তারা এই জায়গাগুলি সম্পর্কে নানা তথ্যও সংগ্রহ করতে চান। শুধুই ঘুরতে চাওয়া এর উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু অন্ধকার পর্যটনের আবার অন্ধকার দিকও আছে। মানুষের মননে এর কুপ্রভাব পড়তে পারে বলেও সাবধান করেছেন বিশেষজ্ঞেরা।

২০১৫ সালে, ওহাইওর একজন বছর ২১ এর পড়ুয়া অটো ওয়ার্মবিয়ার, ইয়াং পাইওনিয়ার ট্যুরের সঙ্গে ঘুরতে বেরোন। এই সংস্থা সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া, চিন এবং ইরাকের সামরিক শাসন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলি ভ্রমণে সাহায্য করে৷ ওই ছাত্রের বিরুদ্ধে হোটেলের দেয়াল থেকে পোস্টার চুরির অভিযোগ আনা হয়। ১৭ মাস আটক ছিলেন ওই পড়ুয়া। অবশেষে যখন মুক্তি পান, তখন তিনি কোমায়! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার ছয় দিন পরেই তিনি মারা যান। পরিবারের অভিযোগ, তাঁকে নির্যাতন করেই মেরে ফেলা হয়েছে।

More Articles