দুর্ঘটনার দুর্বিপাক! মহাকাশের লড়াইয়ে পৃথিবী হারিয়েছে কল্পনার মতো যে সব নভোশ্চরদের
Astronauts Lost In Space: ১৬ দিনের উড়ান শেষ করে পৃথিবীতে ফেরার সময় ঘটে দুর্ঘটনাটি। অবতরণের ঠিক ষোলো মিনিট আগে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ হারায় যানটি। সাতজন মহাকাশচারীর আর ফেরা হয়নি পৃথিবীর আলো-জল-বাতাসে।
মহাকাশ দখলের লড়াই আজকের কথা নয়। বারুদ-বোমা-বন্দুকের লড়াইয়ের এক বিস্তৃততর রূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক সময় এই মহাকাশের লড়াই। কে কত তাড়াতাড়ি মহাকাশের রহস্য ভেদ করতে পারে। এই মহাকাশের লড়াইয়ে প্রথম খাতা খুলেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। পিছিয়ে থাকেনি আমেরিকা, চিনেরাও। এমনকী বহরে ছোট হওয়া সত্ত্বেও মহাকাশযাত্রায় তড়তড় করে এগিয়ে গিয়েছিল ভারতও। প্রথমে মহাকাশযান হয়ে মহাকাশে মানুষ পাঠানোর লড়াইয়ে পিছিয়ে ছিল না কেউই। কিন্তু এই যে নিরন্তর মহাকাশচর্চা, তাতে বহু কিছু হারিয়েওছে দেশগুলি।
সম্প্রতি মহাকাশে বাণিজ্যিক ক্রু পাঠানোর মিশন নেয় মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা NASA। তার জন্য পরীক্ষামূলক ভাবে বোয়িং স্টারলাইনের মহাকাশযানে চাপিয়ে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে পাঠানো হয় ৯ জনের একটি নভোশ্চর দলকে। যার প্রধান মুখ ছিলেন সুনীতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোর। গত ৫ জুন বোয়িং স্টারলাইনের মহাকাশযানে চেপে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হন সুনীতারা। যথাসময়ে সেখানে পৌঁছেও যান। তবে বাধ সাধে তারপরেই। গত ২৬ জুন ফেরার কথা ছিল সুনীতাদের। কিন্তু দৈব দুর্বিপাকে মহাকাশেই আটকা পড়েন ৬ নভোশ্চর। আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের কাছেই রুশ কৃত্রিম উপগ্রহের বিস্ফোরণের ফলে তার টুকরোরা ছড়িয়ে যায় স্পেস স্টেশনের চারপাশে। তার উপর শুরু হয় মহাকাশযান থেকে হিলিয়াম গ্যাস লিক হওয়া। খারাপ হয়ে যায় মহাকাশযানের রিঅ্যাকশন কন্ট্রোল সিস্টেমের ২৮টি থ্রাস্টারও। যার জেরে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে সুনীতাদের ঘরে ফেরা। এই সব বাধাবিপত্তি কাটিয়ে কবে পৃথিবীর বুকে ফিরতে পারবেন ওই ১৬ জন নভোশ্চর, তা ঠিক করে বলতে পারছে না নাসাও। তবে বোয়িং স্টারলাইন মহাকাশযানের উপর থেকে ভরসা হারাচ্ছেন না সুনীতা-বুচরা, স্পেস স্টেশন থেকে বার্তা দিয়ে জানিয়েছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন: স্টারলাইন-দুর্বিপাকে মহাকাশেই আটকে সুনীতারা! আদৌ ফেরা হবে ৯ নভোশ্চরের?
এই প্রথম নয় এমন বিপত্তি। এর আগেও মহাকাশ গবেষণার নেশায় বহু নভোশ্চরকে হারিয়েছে পৃথিবী। মানুষেরও আগে মহাকাশে পা রেখেছিল একটি কুকুর। সোভিয়েত ইউনিয়ন মস্কোর রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো একটি কুকুরকে ধরে এনে তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তার নাম রাখা হয় লাইকা। ১৯৫৭ সালের ৩ নভেম্বর মহাশূন্যে পাঠানো হয়েছিল লাইকাকে। এর আগেও অবশ্য এমন পরীক্ষা করেছিল রাশিয়া। মাছি থেকে শুরু করে বানর, ইঁদুর, তার পরে সাইগান ও ডেজিক নামের দুটি কুকুরকেও মহাকাশে পাঠিয়েছিল তারা। পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘স্পুটনিক-১’-এর সাফল্যের পরে তৎকালীন সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ সিদ্ধান্ত নেন মহাকাশে জীবন্ত প্রাণী পাঠানোর। তার পরেই মহাকাশে পাঠানো হল লাইকাকে। লাইকাই প্রথম, যাকে নিয়ে রুশ মহাকাশযানটি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে ঘুরতে শুরু করেছিল। ১৯৫৭-র ৩১ অক্টোবর মহাকাশযান স্পুটনিক-২-এ রাখা হয় লাইকা-কে। ৩ নভেম্বর পৃথিবী সাক্ষী থাকে স্পুটনিক-২-এর লঞ্চের। একই সঙ্গে শেষ বিদায় জানানো হয় লাইকা-কে। শেষ মুহূর্তে তার হৃদস্পন্দন পৌঁছে গিয়েছিল ২৪০/মিনিটে। মহাকাশযাত্রার আগে তার হৃদস্পন্দন ছিল ১০৩/মিনিট। শ্বাসপ্রশ্বাসের হারও বেড়ে গিয়েছিল অস্বাভাবিক হারে। প্রথমে রাশিয়ার তরফে জানানো হয়, স্পুটনিক-২ তার গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার পরে কয়েক দিন জীবিত ছিল লাইকা। তবে পরে স্বীকার করে নেওয়া হয়, স্পুটনিক-২ লঞ্চ হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই মারা গিয়েছিল সে। কার্যত আতঙ্কেই।
এ তো গেল প্রাণীর কথা। মহাকাশে মানুষ পাঠানোর প্রস্তুতি নিতেও খুব বেশি সময় লাগায়নি দেশগুলি। ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল সোভিয়েত মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিন প্রথম মানুষ হিসেবে যাত্রা করলেন মহাকাশে। তবে তার কপাল লাইকার মতো ছিল না। সফল ভাবে পৃথিবী প্রদক্ষিণের পর গ্যাগারিনকে নিয়েই ফিরে এসেছিল মহাকাশযানটি। আর সেই সাফল্যের পরেই মহাকাশে মানুষ পাঠানোর চেষ্টা বেড়ে গেল। মহাকাশ গবেষণায় এগিয়ে থাকা প্রায় প্রত্যেকটি দেশই চাইল, তাঁদের প্রতিনিধিরা জয় করে আসুক ওই সুবিশাল। আর এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার মাশুলও দিতে হয়েছে দেশগুলিকে বহু। তবে ব্যর্থতাকেই সিঁড়ি করে আরও এগোতে চেয়েছে তারা। এখনও পর্যন্ত কম করে হলেও ৬০০ জনের কাছাকাছি মহাকাশচারী পা দিয়েছেন মহাকাশে।
গত পঞ্চাশ বছরে কম করে হলেও জনা তিরিশেক মহাকাশচারীর মৃত্যু হয়েছে মহাকাশ ছুঁতে গিয়ে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু সেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে স্থলভাগে বা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে। মহাকাশে পাড়ি জমানো ৫৫০ জনের মধ্যে সেখানেই মৃত্যু হয়েছে মাত্র তিন জনের। ১৯৬১ সালে সোভিয়েত মহাকাশচারী ভ্যালেন্টিন বোন্ডারেঙ্কো মারা যান অসাবধানতায়। তখনও অবশ্য তিনি পৃথিবীতেই। তার ১৯দিন পরেই তাঁর কথা ছিল মহাকাশে যাওয়ার। ভয়ঙ্কর এক অগ্নিকাণ্ডে মারা যান বোন্ডারেঙ্কো। মহাকাশে পৌঁছনোর আগেই রাশিয়া হারায় তাদের এক গুরুত্বপূর্ণ মহাকাশচারীকে। ১৯৬৭ সালে আমেরিকার পাঠানো অ্যাপলো ওয়ান মহাকাশযানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয়েছিল ভার্জিল গিসম, এডওয়ার্ড হোয়াইট ও রজার চ্যাফি নামে তিন মহাকাশচারীর। তবে সেই ব্যর্থতার ভূমিতে পা রেখেই অন্তত সাতটি মিশন সম্পূর্ণ করেছেন অ্যাপলো মহাকাশচারীরা। ওই বছরই সোভিয়েত সয়ুজ-1 মহাকাশযানের প্রথম মিশনে মহাকাশে হারিয়ে যান ভ্লাদিমির কোমারভ নামে এক নভোশ্চর। তিনিই প্রথম মহাকাশচারী, যিনি মহাকাশেই মারা যান। ওই অভিযানেই যাওয়ার কথা ছিল বিশ্বের প্রথম মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিনের। কিন্তু সেই অভিযানে শেষ পর্যন্ত পাঠানো হয়নি ইউরিকে।
১৯৭১ সালের ৩০শে জুন সয়ুজ ১১ মিশনের সময় মহাকাশে মারা যান ভ্লাদ ভলকভ, জর্জি ডোব্রোভলস্কি এবং ভিক্টর পাটসেভ নামে আরও তিন রুশ নভোশ্চর। ওই বছরই চাঁদে পা দেয় মার্কিন মহাকাশযান অ্যাপলো ১৫। মহাকাশে হারিয়ে যাওয়া নভোশ্চরদের নাম-সহ একটি ফলক রেখে আসা হয় চাঁদের মাটিতে। ততদিনে মহাকাশের লড়াইয়ে পোক্ত খিলারি হয়ে উঠেছে আমেরিকা। পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট-প্লেন ব্যবহার করে মহাকাশ প্রযুক্তিতে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে তারা। আর সেটাই হয়ে উঠেছিল বিপর্য়ের কারণ। ১৯৮৬ সালের ২৮ জানুয়ারি উৎক্ষেপণের ৭৩ সেকেন্ডের মাথায় ভেঙে পড়ে চ্যালেঞ্জর শাটল। যে দুর্ঘটনায় ক্রিস্টা ম্যাকঅলিফ-সহ মোট সাত নভোশ্চরের মৃত্যু হয়।
২০০৩ সালে দ্বিতীয় স্পেস শাটল দুর্ঘটনা। তবে এবার কলম্বিয়া। ১৬ দিনের উড়ান শেষ করে পৃথিবীতে ফেরার সময় ঘটে দুর্ঘটনাটি। অবতরণের ঠিক ষোলো মিনিট আগে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ হারায় যানটি। সাতজন মহাকাশচারীর আর ফেরা হয়নি পৃথিবীর আলো-জল-বাতাসে। মহাকাশেই হারিয়ে যান তাঁরা। সেই অভিযানেরই অংশ ছিলেন ভারতীয় নভোশ্চর কল্পনা চাওলা। কল্পনা ছাড়াও মহাকাশযানে ছিলেন পাইলট উইলিয়াম ম্যাককুল, পে লোড কম্যান্ডার মিশেল অ্যান্ডারসন, আয়ান রামান, লরেল ক্লার্ক ও ডেভিড ব্রাউন। সমস্ত আশঙ্কা সত্যি করে সেদিন মহাকাশেই হারিয়ে গিয়েছিলেন কল্পনারা। তার পরেই কার্যত ধাক্কা খেয়েছিল শাটল প্রোগ্রাম।
আরও পড়ুন:স্টারলাইনে আস্থা হারাচ্ছেন না! স্পেস স্টেশন থেকে যে বার্তা দিলেন সুনীতা উইলিয়ামস
তবে মহাকাশে হারিয়ে যাওয়ার গল্পটা শেষ হয়নি। ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর ভার্জিন গ্যালাক্টিকের সাবঅর্বিটাল মহাকাশযান স্পেসশিপটু নিয়ে মহাকাশ অভিযানের সময় মারা যান পাইলট মাইকেল এলসবারি। কোনওমতে প্রাণে বাঁচেন সহ-পাইলট পিটার সেবোল্ড। তবে গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনি। কল্পনাদের মতোই কি এবার হারাতে হবে সুনীতা-বুচদেরও। কীভাবে তাঁদের ফিরিয়ে আনা যায়, কোন পথে উদ্ধার, সে বিষয়ে এখনও নির্দিষ্ট করে কিছুই জানায়নি নাসা। এদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে, ততই দুশ্চিন্তা বাড়ছে ওই ৯ নভোশ্চরদের জন্য। যদিও সুনীতারা ভরসা রেখেছেন বোয়িং স্টারলাইন মহাকাশযানটির উপরেই। রিঅ্যাকশন কন্ট্রোল সিস্টেমের ২৮টি থ্রাস্টার খারাপ হয়ে গেলেও ওই মহাকাশযানে আরও শক্তিশালী সব থ্রাস্টার রয়েছে, যা ডি-অরবিট বার্ন করে সুনীতাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে পারবে বলেই দাবি করেছে নাসা। তবে সেগুলো আদৌ অক্ষত রয়েছে কিনা, সংশয় রয়েছে তা নিয়েও। কবে সুনীতাদের ফেরানোর চেষ্টা করা হবে, তা নিয়েও নিশ্চিত করে কিছু বলা হয়নি। মহাকাশে অভিযানে গিয়ে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া নামগুলির মধ্যে নাম লেখাবেন না তো আরও এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত নভোশ্চর সুনীতা উইলিয়াম। তার সঙ্গেই চিরতরে হারিয়ে যাবেন না তো আরও ৮ মহাকাশচারী? ভয় বাড়ছে গোটা বিশ্বের।