নস্টালজিয়া নয়, নিত্যযাত্রীর সহায় হয়ে বাঁচুক ট্রাম: গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও

Kolkata Tram: ট্রাম কোম্পানির শেষ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কর্মী গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে কলকাতার ট্রামযাত্রার সঙ্গী। সেই সব স্মৃতির ঝাঁপিই খুলে দিলেন ইনস্ক্রিপ্টের সঙ্গে একান্ত আড্ডায়।

প্রায় দেড়শো বছরের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের গায়ে লেগে কত রক্ত-জল-ঘাম। তারপর শহর পাল্টে যায় ক্রমশ। দ্রুত এক বদলে যাওয়ার হাওয়া এসে তার গা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় সব প্রাচীন গন্ধ। কলকাতার হলুদ ট্যাক্সি, দোতলা বাস কিংবা হাতে টানা রিকশার মতোই ট্রামও মুছে যাওয়ার পথে। সেই ট্রাম, যে গণপরিবহণের গায়ে লেগে থাকত 'কলকাতা কলকাতা' মনকেমনগুলো। দু-এক দশক আগের বাসিন্দা যাঁরা, তাঁদেরও স্কুল-কলেজ ফিরতি স্মৃতির গায়ে লেগে ছিল সেই ট্রামের টুংটাং। অথচ সেই সব স্মৃতির প্যানডোরার বাক্সকে জাদুঘরে ঠেলে ক্রমশ কলকাতায় ক্ষয়িষ্ণু ট্রামের ঐতিহ্য। মহানগর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় পঞ্চান্নটা ট্রামের রুট কমতে কমতে ঠেকেছে দু'টোয়। কলকাতা আর গিয়ে দাঁড়ায় না ট্রামের পাদানিতে, উঠে বসে না জানলা-ঘেঁষা ট্রাম-কেদারায়। জানলা ঘিরে ফুটে ওঠা দৃশ্যকাব্য ছুঁয়ে ছুঁয়ে শ্লথগতিতে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার মতো বাড়তি সময় নেই আর তার হাতে। ফলে সরকার তার বিদায়-পরোয়ানা ঘোষণা করে দেয়।

সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে হঠাৎই গণপরিবহণ হিসেবে কলকাতা শহর থেকে ট্রাম তুলে দেওয়ার কথা জানিয়েছিল রাজ্য সরকার। ভারতের একমাত্র শহর কলকাতা, যেখানে ট্রাম চলে। ১৮৭৩ সালে কলকাতায় শুরু হয়েছিল ট্রামযাত্রা। তখন ঘোড়ায় টানা ট্রাম। তবে সেই ট্রামের সফর খুব বেশি দীর্ঘ হয়নি। ৯ মাসের মধ্যেই উঠে যায় তা। ১৮৮০ সালের দিকে ফের নয়া উদ্যমে কলকাতায় গণপরিবহণ হিসেবে শুরু হল ট্রাম।  সে সময় ট্রাম চালানোর জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে নিয়ে আসা হত ওয়েলার ঘোড়া। ট্রামের ডিপোর পাশাপাশি কলকাতার শ্যামপুকুর, চিৎপুর, শিয়ালদহ, ধর্মতলা, ভবানীপুর ও খিদিরপুরে তৈরি হয়েছিল ঘোড়ার আস্তাবলও। তবে সেই ঘোড়া দিয়ে ট্রাম টানানোও ক্রমে দুষ্কর হয়ে দাঁড়াল। ১৮৮২ সাল নাগাদ কর্পোরেশন ট্রাম কোম্পানিকে পরীক্ষামূলক ভাবে বাষ্পীয় ইঞ্জিন ব্যবহার করে ট্রাম চালানোর অনুমতি দেয়। চৌরঙ্গী লাইনে এই ট্রাম চলেছিল ১৮৮২ সালের মে মাস থেকে ১৮৮৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত। এর মধ্যেই রাস্তায় ট্রামের জন্য পর পর পথদুর্ঘটনার খবর মিলতে বন্ধ হল তা-ও। অবশেষে নানা পথ ঘুরে ১৯০২ সালের ২৭ মার্চ কলকাতা শহরে শুরু হল বিদ্যুৎচালিত ট্রাম। মানে আজ যে ধরনের ট্রাম আমরা কলকাতা শহরে দেখতে পাই, সেই ট্রাম প্রথম চলেছিল খিদিরপুর রুটে । কোম্পানির বাকি রুটগুলিতে অবশ্য তখনও ঘোড়াদের চাকরি যায়নি। 

১৯০২ সালের ১৯ নভেম্বর থেকে শেষমেশ পাকাপাকিভাবে কলকাতা শহরের রাস্তায় বৈদ্যুতিক ট্রামের আনাগোনা শুরু হল । আর সেই বিদ্যুৎচালিত ট্রামেই প্রায় চল্লিশ বছর চাকরি করেছেন গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও। ঢুকেছিলেন সেই ১৯৮৪ সালে। অর্থাৎ কলকাতা শহরে ট্রাম পত্তন হওয়ার প্রায় একশো বছর পর। চলতি মাসের ১ তারিখে অবসর নিলেন ট্রামকোম্পানি থেকে। তিনিই ছিলেন ট্রাম কোম্পানির শেষ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কর্মী। যদিও কলকাতাতেই তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা। থাকেন পিকনিক গার্ডেনে। ট্রামের সঙ্গে প্রায় চারদশকের দীর্ঘ সহবাস। নানা ভালো-মন্দ মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। কেমন ছিল তাঁর এত বছরের ট্রাম-সফর? ইনস্ক্রিপ্টের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এল সেসব স্মৃতিগল্পমালা।


সোহিনী: ইনস্ক্রিপ্টের আড্ডায় আপনাকে স্বাগত জানাই। প্রথমেই জিজ্ঞেস করব, ট্রামের সঙ্গে আপনার চল্লিশ বছরের কর্মজীবন। কী কাজ ছিল আপনার?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: আমি ছিলাম ট্রামের কনডাক্টর। সেই ১৯৮৪ সালে ঢুকি ট্রাম কোম্পানিতে।

সোহিনী: কোন কোন রুটে ডিউটি করেছেন?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: এই এত বছরের কাজের জীবনে বহু রুটে ডিউটি করেছি। গড়িয়াহাট থেকে এসপ্ল্যানেড ২৫ নম্বর রুট, শ্যামবাজার থেকে ধর্মতলা ৫ নম্বর, জোকা থেকে এসপ্ল্যানেড ৩৭ নম্বর রুট, বিধাননগর, বেহালা থেকে এসপ্ল্যানেড, খিদিরপুর থেকে এসপ্ল্যানেড ৩৬ নম্বর রুট। নানা রুটে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ডিউটি করতে হয়েছে আমাদের।

সোহিনী: কত বেতনে শুরু সেসময়?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: ৮৪ সালে যখন কাজে ঢুকি, সেসময় বেতন ছিল অনেক কম। হাজার-বারোশো টাকা পেতাম হয়তো। তার পর আস্তে আস্তে ষষ্ঠ পে কমিশন হয়েছে। এখনও ষষ্ঠ পে কমিশনের আওতাতেই বেতন পান ট্রামকর্মীরা। কিন্তু এ রাজ্যের বাইরে বিহার, ওড়িশার মতো বহু রাজ্যেই সরকারি পরিবহণ কর্মীরা কিন্তু সপ্তম পে কমিশন অনুযায়ী বেতন পান। কিন্তু এ রাজ্যের ট্রাম কোম্পানির কর্মীদের কপাল খোলেনি।

সোহিনী: কীভাবে আসা এই কাজে?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: আমার বাবা কাজ করতেন নোনাপুকুর ওয়ার্কশপে। ওখানে ট্রামের মেইনটেনেন্স থেকে ইলেকট্রিক, ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদির দফতর ছিল। ট্রামের রেনোভেশনও হত সেখানেই। বাবা মারা যান ৮৪ সালের এপ্রিলে। ওই বছরেরই ডিসেম্বরে আমি বাবার নমিনি হিসেবে চাকরিটা পাই। তখন ট্রামের বেশিরভাগ চাকরিই হত নমিনিতে। পরীক্ষা-টরিক্ষার বালাই ছিল না। সেই থেকেই চলছে ট্রামের সঙ্গে আমার এই দীর্ঘ সফর।

Exclusive interview of a retired tram conductor named Gavin Clifford Rosario regarding his 40 years of experience in tram service Robibarer Royak

সোহিনী: কেমন ছিল সেসময়ের ট্রামযাত্রা? যাত্রীসংখ্যা কেমন ছিল?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: তখন ট্রামে কী ভিড়!সত্যি কথা বলতে, পুজোর সময় সবচেয়ে বেশি ভিড় হত ট্রামে। যাত্রী সামলাতে নাকানি-চোবানি খেতে হত। পুজোর আগে থেকেই বাজারের ভিড়ের ছাপ পড়ত ট্রামের কামরায়। পুজোর সময়েও বলা যায় প্রায় সারা রাতই ট্রাম চলত। বালিগঞ্জ থেকে লাস্ট ট্রাম ছাড়ত সাড়ে দশটার সময়, ২৪, ২৫, ২৬ নম্বর। সেই লেট লাস্ট কার ধর্মতলা, হাওড়া কিংবা জোকায় পৌঁছতো রাত বারোটা-সাড়ে বারোটা নাগাদ। তখন শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিল ট্রামের সেসব রুট। এগডালিয়া, হিন্দুস্তান পার্ক, দেশপ্রিয়, কত বড় বড় সব বড় প্যান্ডেল ঘেঁষে ছুটত কলকাতা শহরের ট্রাম। বালিগঞ্জ, গড়িয়াহাট এসব এলাকায় প্রচুর ভিড় হত তখন।

সোহিনী: ভাড়া কত ছিল সেসময়?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: কতই বা ভাড়া ছিল তখন। ২০ পয়সা, ৩০ পয়সা, ৪০ পয়সা। পরে তা বেড়ে বেড়ে শেষপর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ৭ টাকায়। বেশ কয়েকটা এসি ট্রামও চলত কলকাতায়। তার ভাড়া ২০ টাকা। কম দূরত্ব হোক বা বেশি, একই ভাড়া। সম্ভবত এখনও কলকাতার সবচেয়ে সস্তার গণপরিবহণ ট্রাম।

সোহিনী: আগে কী ধরনের যাত্রীরা ট্রামে চড়তেন, এখন কারা চড়েন? তাঁদের মানসিকতা বদলে গিয়েছে বলে মনে হয়?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: অন্য শহর থেকে যখন কলকাতায় আসতেন মানুষ, ট্রামে চাপতেন। অবাক হতেন এটা দেখে যে ৬-৭ টাকা ভাড়ায় এত দূর পর্যন্ত যাওয়া যায়। মনে আছে, একদিন শ্যামবাজার থেকে ধর্মতলায় যাচ্ছি ট্রাম নিয়ে। সেদিন আমার ট্রামে দেশের চারটি মেট্রোপলিটন শহরের বাসিন্দারা উঠেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ থাকেন দিল্লি, কেউ মুম্বই তো কেউ চেন্নাই, কেউ আবার বেঙ্গালুরু। এত বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা এক ঝলকে বুঝে যাই ওরা লোকাল নয়। প্রথমেই ভাড়া শুনে অবাক হতেন ওঁরা। হিন্দি স্পিকিং লোক। শ্যামবাজার পর্যন্ত ভাড়া ৭ টাকা শুনে অবাক হয়ে যেতেন। বাইরের শহরের কাছে এ টাকাটা নেহাতই তুচ্ছমাত্র। কিন্তু এ শহরেই এমন মানুষজন রয়েছেন, যারা ৭ টাকা টিকিটের দাম না মিটিয়ে হাতে ৬ টাকা গুঁজে দিয়ে নেমে যান। তাঁরা দর কষাকষি করেন ওইটুকু টিকিটের দাম নিয়েও। বরং অন্য শহর থেকে আসা যাত্রীরা জোর করে হাতে সাত টাকার টিকিটে দশ টাকা গুঁজে দিতে চান। আমরা বলি— না, দশ টাকার তো টিকিট নেই। ওরা ট্রামের টিকিটের ছবি তুলে পরিবার-বন্ধুবান্ধবদের পাঠান। যেন সাত টাকা ভাড়ার গণপরিবহণ এক অপার বিস্ময়। তারা ট্রামে চড়ার ওই মুহূর্তটুকু উপভোগ করেছেন। আমি অবাক হয়ে দেখছি, কীভাবে এক শহরের সঙ্গে অন্য শহরের বন্ধুত্ব করিয়ে দিচ্ছে ট্রাম। তারা মোবাইল নম্বর পাল্টাপাল্টি করছেন, সেই বন্ধুত্ব এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ভবিষ্যতেও।

না, শুধু অন্য শহরের বাসিন্দারাই নয়। এই শহরেরও বহু চেনা মুখ, বন্ধুমুখ আমাকে দিয়েছে ট্রাম। রোজের যাতায়াতে অনেকেই পরিচিত থেকে বন্ধু হয়ে উঠত। নিয়মিত শুভেচ্ছা বিনিময়, ঠাট্টা, আড্ডা সবটাই চলত। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা, অফিসযাত্রী, সকলের উচ্ছ্বাস বলে দিত, এই কলকাতা মন থেকে ট্রামকে ভালোবাসে। এ শহরটার মানুষ ট্রাম ভালোবাসে। বিশেষত প্রবীণ এবং স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা তো বটেই। ট্রাম আসলে এ শহরের এক আরামযাত্রার আখ্যান বুনে দিয়েছিল। অটোযাত্রা তেমন আরামের নয়। বরং অটোচালকদের দৌরাত্ম্য বহু যাত্রীর কাছেই অসহ্য হয়ে উঠেছে যত দিন গিয়েছে। খুচরো নিয়ে ঝগড়া থেকে শুরু করে লাইনে দীর্ঘ অপেক্ষা, সবই অটোযাত্রার সঙ্গী হয়ে গিয়েছে। বাসে যাতায়াতও খুব একটা আরামদায়ক নয়। প্রায়শই রেষারেষি, বৃষ্টি হলে কাচ বন্ধ করে দেওয়ায় দমবন্ধ পরিস্থিতি, ভিড়, এসব বাসেরও নিত্যসঙ্গী। তার চেয়ে ভালো ট্রাম। ট্রাম একমাত্র গণপরিবহণ, যেখানে পাখা রয়েছে।

Exclusive interview of a retired tram conductor named Gavin Clifford Rosario regarding his 40 years of experience in tram service Robibarer Royak

সোহিনী: তরুণ প্রজন্মের কাছে কি আজ আর ট্রামের সেই আবেদন নেই বলে মনে হয়?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: তরুণ প্রজন্মের জীবনের লয়টাই দ্রুততার। ম্যাগির মতোই তাঁরা সব কিছুই দু'মিনিটে চায় এখন। তাদের হাতে সময় নেই। ফলে তাঁদের যাতায়াতের জন্য অনেক বেশি পছন্দ বাইক, গাড়ি নিদেনপক্ষে অটো। ট্রামে চড়ার ধৈর্য তাদের নেই। অনেককেই ট্রামে উঠে বলেই বসে এত স্লো, চল নেমে যাই, অটো বা ট্যাক্সি ধরি। সেই সময়ের তরুণ প্রজন্ম, যারা নিত্য যাতায়াত করত ট্রাম ধরে, তাঁদের থেকে এই সময়ের কচিকাঁচাদের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটা তো বদলেইছে। তার পরেও যে একেবারে স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের ট্রামে পাই না, তা বলা যায় না। এখনও অনেক ছোটরাই ট্রামে ওঠেন। নিত্য যাতায়াতের জন্য ট্রামকে বেছে নেন।

সোহিনী: ট্রামকে ঘিরে কোনও বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: কত অভিজ্ঞতা। বয়স হয়েছে, সব কিছু আর গুছিয়ে মনেও করতে পারি না। খালি খেই হারিয়ে ফেলি। প্রথমে ঘোড়া, তার পর স্টিম ট্রাম পেরিয়ে আজকের এই ইলেকট্রিক ট্রামের পত্তন। আস্তে আস্তে রুট বাড়ল। নতুন রুট। বামফ্রন্ট আমলে জোকা রুট আরম্ভ হল। উদ্বোধনে এসেছিলেন রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। সেদিন টিকিট কেটে ট্রামেও চড়েছিলেন তিনি। ৩৬ নম্বর রুট ছিল মোস্ট সিনিক রুট। কত বলিউড সিনেমার শুটিং যে সেখানে হয়েছে। সেই যে বিদ্যা বালানের ছবি 'কাহানি', তার শুটিংও হয়েছিল ওই রুটের ট্রামেই। রেসকোর্স, ভিক্টোরিয়া, ফোর্ট উইলিয়ামস, কত সবুজ। প্রচুর প্যাসেঞ্জার হত সেসময়। কিন্তু আমফান থেকে বন্ধ হয়ে গেল সেই রুটও। মাঝেরহাট ফ্লাইওভার ভেঙে যাওয়ার পর সরকার অর্ডার দিল, শহরের কোনও ব্রিজের উপরে উঠবে না ট্রাম। তাতে নাকি ঝুঁকি। সেসময় রাজাবাজার, শিয়ালদহ প্রায় সব রুটেই কোনও না কোনও ব্রিজ পড়ত। বালিগঞ্জ থেকে ২৪ নম্বর রুটে ধর্মতলা হয়ে খিদিরপুর। সেই রাস্তায় পড়ত দুটো বড় ব্রিজ। একটা কালীঘাট, অন্যটা খিদিরপুর ব্রিজ। ৩৬ নম্বর রুটেও পড়ত খিদিরপুর ব্রিজ। খিদিরপুর ডকে বড় বড় কন্টেনার যায়, গাড়ি যায় ব্রিজ ধরে। কিন্তু অসুবিধা ট্রামে শুধু। প্রয়োজনে তো একটা বগির ট্রামও চালানো যেত। কিন্তু চালানো হল না। এত এত রুট এক এক করে বন্ধ হয়ে গেল। আমি যখন চাকরিতে ঢুকি, তখন কলকাতা শহরের বুকে চলাফেরা করত প্রায় চারশো ট্রাম, প্রায় ৫৫টা রুট তখন। আর আজ যখন অবসর নিলাম, মাত্র ২টো রুট চলে কলকাতায়। চল্লিশ বছরের চাকরি। গড়িয়াহাট থেকে এসপ্ল্যানেড,এসপ্ল্যানেড থেকে শ্যামবাজার। আরেকটা রুট চলত টালিগঞ্চ থেকে বালিগঞ্জে, ২৪, ২৯। সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। মুদিয়ালির ওখানে কীসব ড্রিঙ্কিং ওয়াটার পাইপ বসানোর চক্করে দাঁড়ি পড়ল আরও একটা রুটে। প্রচুর যাত্রী হত কিন্তু ওই লাইনে। এখনও কত লোক আমাদের এসে জিজ্ঞেস করেন, কবে চালু হবে ওই রুটের ট্রাম আবার। বালিগঞ্জ টার্মিনাস যেটা, বিজন সেতুর পাশে, সেখানে তিনটে লাইন। জামিল লেনে পিসি সরকারের বাড়ি হয়ে ওই এলাকাটায় একটা সময় এত গাড়ি ছিল যে রুট জ্যাম হয়ে যেত। সব এখন ফাঁকা। ট্রেন থেকে নেমে আলিপুর কোর্ট যাওয়ার জন্য কত যাত্রীর ভরসা ছিল সেসময় ট্রাম। প্রায় তিন চার মিনিট অন্তর অন্তর ট্রাম ছাড়ত তখন। সে সব আজ বন্ধ।

Exclusive interview of a retired tram conductor named Gavin Clifford Rosario regarding his 40 years of experience in tram service Robibarer Royak

মনে আছে, একদিন এক ভদ্রলোক ট্রামে উঠেছেন। উঠেই বিস্মিত মুখে বলে বসলেন, 'সো লাভলি সো গুড'। জানালেন, প্রায় তিরিশ বছর পরে ট্রামে উঠেছেন। তিনি আপাতত হায়দরাবাদের বাসিন্দা। কলেজে পড়তে রোজ ট্রামে যাতায়াত করতেন। সেই নস্টালজিয়াকে ফের ছুঁয়ে দেখতে পেরে আবেগে ভাসলেন। কত ছবি তুললেন, ভিডিও করলেন। ট্রাম আসলে এ শহরের একটা আইকন। যেমন কলকাতা মানে ভিক্টোরিয়া মেমরিয়াল, কলকাতা মানে টানা রিকশা, তেমনই ট্রাম। সেই ট্রামকে কলকাতার বুক থেকে পুরোপুরি উপড়ে নেওয়া আসলে সম্ভব নয়। ট্রাম আসলে গরিব মানুষের পরিবহণ। তার উপর ট্রাম থেকে কোনও রকম দূষণ ছড়ায় না।

সোহিনী: লন্ডনে ট্রাম চলে,কানাডায় ট্রাম চলে, কলকাতার রাস্তাতেই কেন অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেল ট্রাম? কী মনে হয়?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: অনেক বছর আগে যখন বালিগঞ্জ থেকে ডিউটি করতাম, সে প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগের কথা। সেসময় আমার প্রায়ই মনে হত, বাইপাস দিয়ে যদি ট্রামগুলোকে আপডাউন করানো যেত, তাহলে কত যাত্রী হত, ভিড় হত। সরকার আজ ইএম বাইপাসে মেট্রো বসিয়ে দিয়েছে। একটু ভাবতে পারলে হয়তো ট্রামকে নিয়েও এমন কোনও কাজ করা যেত। নতুন মডেলের ট্রাম এনে আরও যাত্রী টানা যেত। প্রয়োজনে আরেকটু গতিবৃদ্ধি করা যেত কিন্তু সরকার বড় অবহেলা করেছে গোটা ব্যাপারটা নিয়ে। প্রায় প্রতিটা ডিপোতে ৫০-৬০ খানা ট্রাম বসে বসে পচে যাচ্ছে। ভাবলে দুঃখ লাগে। অথচ এত ভালো পরিকাঠামো ছিল আমাদের। বাইরের দেশে তো আখছার ট্রাম চলছে। অন্যান্য বহু দেশে ট্রাম ছিল না, দুবাইয়ের মতো শহরে ট্রাম বসানো হচ্ছে। এসি ট্রাম চলছে শহরের বুক ধরে। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে ট্রাম চলে, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। গোটা বিশ্বের সেসব ট্রামের ছবি-ভিডিও দেখি আর ভাবি, কেন আমাদের দেশেও এমনটা হতে পারে না!

সোহিনী: এই যে কলকাতা শহর জুড়ে ট্রামের এত রমরমা, তা কবে থেকে পাল্টে গেল মনে হয়? কবে থেকে শুরু হল ট্রামের পালাবদল? কেন ট্রামের যাত্রী কমে গেল এ শহরে?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: বহু কারণ। বহু যাত্রীই ট্রামডিপোয় এসে টাইমটেবিল চান। জানতে চান, কখন ট্রাম ছাড়বে, কখন ছাড়ে। ট্রেন টাইম টেবিল মেনে চলতে পারে, কারণ ওদের লাইন ফাঁকা। ট্রামের বিষয়টা তেমন নয়। ট্রাম ট্র্যাফিকের সঙ্গে চলে,প্রতিটা সিগন্যাল তাদের মেনে চলতে হয়। ট্র্যাফিক থমকে গেলে ট্রামকেও থমকে যেতে হয়। বহু সময় ট্রাম লাইনের উপর অটো, ট্যাক্সি বা প্রাইভেট কার উঠে পড়ে। ট্রাম থমকে যায়। বিশেষত অটো। ট্রাম অটোর শত্রু। নোনাপুকুর রুটে বহু সময় দেখেছি জায়গা থাকলেও ইচ্ছা করে ট্রাম লাইনের উপরে দাঁড়িয়ে যায়। ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি চালায় সেখানে দাঁড়িয়ে। ডিপোতে আসেন যাত্রীরা। ট্রামের খোঁজখবর নেন। আমরাও বলতে বাধ্য হই, গাড়ি ঢুকলে পাবেন। অপেক্ষা করতে হবে। বহু ক্ষেত্রেই যাত্রীদের হাতে সেই সময়টা থাকে না। আসলে যাত্রীরা আর ভরসা করতে পারছেন না ট্রামের উপরে। কখন গাড়ি আসবে, কখন ছাড়বে! যার জন্য যাত্রী দিনে দিনে কমেছে ট্রামের। ট্রামের কোনও ধরাবাঁধা কাঠামো নেই। হ্যাঁ, প্রথম ট্রাম আর শেষ ট্রামের ক্ষেত্রে কখনও সময়ের নড়চড় হয় না। ঠিক সময়ে গাড়ি ছাড়বেই। সাড়ে ৬টায় গড়িয়াহাটের প্রথম ট্রাম গড়িয়াহাট ডিপো থেকে ছাড়ে। শেষ ট্রাম ছাড়ে রাত ন'টায়, ওটা আপনি সময়েই পাবেন। বহু রোজের যাত্রীরাই কিন্তু ওই সময়ের ট্রাম ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু এর মাঝের যে সময়, তা ট্রামের পক্ষে রক্ষা করা সত্যিই মুশকিল। এ কারণে ভরসা উঠে যাচ্ছে ট্রামের থেকে। শুধু তা-ই নয়। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কলকাতা শহরে ট্রাম সেভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। একেকটা ট্রামের বয়স ষাট-সত্তর বছর। তাতে ভয়ঙ্কর শব্দ হচ্ছে। এতগুলো বছরে ডিজাইনের ক্ষেত্রেও কোনও উন্নতি নেই। সেটাও একটা কারণ নিশ্চয়ই।

সোহিনী: ট্রাম বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে এত হইহই, কী মনে হয় শুধুই নস্টালজিয়া নাকি কলকাতার মানুষ আজও ট্রামের প্রয়োজন বোধ করে কোথাও?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: অবশ্যই আছে। আজও বহু নিত্যযাত্রী নিয়মিত ট্রাম চড়েন। বিশেষত স্কুলের পড়ুয়া।অফিসযাত্রীরাও আছেন তার পাশাপাশি, যারা নিয়ম করে ট্রামে চড়েন। সরকার যখন ঘোষণা করল, কলকাতা শহরে ট্রাম রাখা হবে না। তুলে দেওয়া হবে চিরতরে। বিশ্বাস করবেন না, সেই ক'দিনে হুড়মুড়িয়ে সেল বেড়ে গেছিল। অনেকেই নিজেদের সন্তানকে ট্রাম চড়াতে নিয়ে এসেছেন, চেয়েছেন তারা যেন ট্রামের অভিজ্ঞতাটুকু জীবনে একবার অন্তত পায়। কেউ কেউ তো কলকাতার বাইরে থেকে এসেছেন, বয়স্ক মা-কে শেষবার ট্রামে চড়াতে। তিনি হয়তো কুড়ি-তিরিশ বছর আগে ট্রামে চড়েছেন। শেষবারের মতো আর একবার ট্রামে চড়তে চান। আসলে মানুষ ট্রাম ভালোবাসে। ট্রামকে ঘিরে এই নস্টালজিয়া ভালোবাসে। এই যে ২৫ নম্বর রুট, সেই রাস্তায় অনেক স্কুল পড়ে। তারপর বহু রাস্তাই তো কলকাতার বুকে ওয়ানওয়ে। সেখানেও কিন্তু ভরসা ট্রাম। কলেজস্ট্রিটের কথাই ধরুন না। সকাল ৯টার পর থেকে সমস্ত বাস-গাড়ি বিবেকানন্দ রোড থেকে আমহার্টস্ট্রিটের দিকে ঘুরে যায়। তখন সোজা কলেজস্ট্রিট পৌঁছতে ভরসা কিন্তু একমাত্র ট্রামই।

Exclusive interview of a retired tram conductor named Gavin Clifford Rosario regarding his 40 years of experience in tram service Robibarer Royak

সোহিনী: মনে হয় ট্রাম উঠে গেলে সত্যিই কলকাতার যানজট উধাও হয়ে যাবে? ট্রাম তুলে দেওয়ার নেপথ্যে যে কারণ দেখানো হচ্ছে— যানজট, ট্রাম লাইন দুর্ঘটনার কারণ, মাঝপথে যাত্রী নামানোর জন্য দুর্ঘটনা- এগুলো কতটা যথাযথ মনে হয়?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: ইদানীং পুলিশ বলছে, ট্রামের জন্যই নাকি জ্যাম হচ্ছে। এই অজুহাতে পুজোর আগে আগে আজকাল ট্রাম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ বছর অক্টোবর ৯ তারিখ থেকে ট্রাম বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। কিন্তু এই সময়টাই সবচেয়ে বেশি আয় হত ট্রামে, মারাত্মক ভিড়ও হত। সত্যি বলতে, সারা বছরের আয়কে ছাপিয়ে যেত পুজোর সময়ের আয়। এ বছর তিন সপ্তাহ প্রায় গাড়ি বন্ধ রাখা হয়। অথচ আমরা সমস্ত কনডাক্টর, ড্রাইভাররা কিন্তু নিয়ম মেনে ডিপোতে হাজিরা দিয়েছি। এসে বসে থেকে থেকে বাড়ি ফিরে গিয়েছি। যাত্রীরা ডিপোয় এসেছেন। ট্রাম কখন ছাড়বে, আদৌ ছাড়বে কিনা, কেন বন্ধ ট্রাম— এমন নানা প্রশ্ন করেছেন অথচ আমাদের কাছে উত্তর নেই। আমাদের ডিউটি করতে হবে। এদিকে ট্রাম চলবে না। অন্য কনডাক্টরদের কথা বলতে পারব না, আমাদর লজ্জা করত বসে বসে বেতন নিতে। যাত্রীদের মুখের উপর গাড়ি বন্ধ বলতে খারাপ লাগত। পুলিশের অর্ডার, গাড়ি বন্ধ। এ বড় দুঃখের। আমাদের হাতে তো কিছুই নেই। কিন্তু হ্যা অপরাধবোধ হত খুব বসে বসে মাইনে নিতে। শুধু তো আমাদের কথা নয়, ট্রাম কোম্পানিরও তো দু-চার পয়সা আয় হত বলুন!

ট্রামের জন্য কলকাতা শহরে যানজট হচ্ছে বলা হলেও বাস্তবটা কিন্তু উল্টো। বরং ট্রাফিকের জন্যেই ট্রাম স্লো হয়েছে কলকাতায়। বহু সময়েই তো সকালে গড়িয়াহাট থেকে ধর্মতলায় ডিউটি করেছি। আমি ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় মিলিয়ে দেখেছি— সকালে যখন রাস্তা ফাঁকা থাকে,তখন মাত্র ২০ মিনিটে গড়িয়াহাট থেকে পৌঁছে যায় ট্রাম। অটো নেই, বাস নেই। দোকান বন্ধ । বিকেলের সময় সেই গড়িয়াহাট থেকে ধর্মতলা পৌঁছতে ৪০ মিনিট-৫০ মিনিট লেগে যায়, কখনও কখনও এক ঘণ্টাও। কারণ ট্র্যাফিক। যাত্রীদের আমি বলি, ট্রাম স্লো নয়। ফাঁকা রাস্তায় ভালোই চলে ট্রাম। আগে যখন আমাদের সেপারেট লাইন ছিল, তখন ট্রামের স্পিড আরও ভালো ছিল। কিন্তু আজকাল ট্র্যাফিকের জন্য ট্রাম স্লো হচ্ছে, ট্রামের জন্য ট্র্যাফিক নয়। কত সময় হয়েছে, ট্রাম লাইনের উপরে গাড়ি পার্ক করে চলে গিয়েছে। আধঘণ্টা-৪৫ মিনিট ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। লালবাজার ট্র্যাফিক পুলিশ বহুবার সাহায্য করেছে লাইন ক্লিয়ার করতে। ওদের ফোন করে বলতাম। কিন্তু এমনও হয়েছে এক ঘণ্টাও জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে ট্রামকে। অগস্ট মাসে আরজি কর ঘটনার পর প্রতিবাদের জেরে ট্রাম পরিষেবা ভয়ঙ্কর অসুবিধার মুখে পড়েছে। মিছিলের জেরে সমস্ত রাস্তা বন্ধ। এদিকে টিকিট কেটে বসে রয়েছেন যাত্রী। যেতে পারছেন না। সরকারি গাড়িতে তো টিকিট রিফান্ড হয় না। আমরা বলেছি বসে থাকুন, রাস্তা ফাঁকা হলে আপনাদের পৌঁছে দেব। যাঁদের হাতে সময় আছে, তাঁরা বসে থেকেছেন এসি গাড়িতে। প্রতিবাদ উঠলে ট্রাম গন্তব্যে পৌঁছেছে।

সোহিনী: অনেকেই বলেন, ট্রামের জন্য দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন বাইকারোহীরা, মানেন?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: হ্যাঁ, আজকাল অনেক জায়গাতেই এটা শুনতে পাই। কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, এ শহরের যেখানে যেখানে ট্রামলাইন নেই, সেখানে কি বাইক দুর্ঘটনা ঘটছে না? রোজই তো খবরের কাগজে পড়ি, বাইকারদের রেকলেস হওয়ার ঝুড়ি ঝুড়ি ঘটনা। মা ফ্লাইওভার থেকে নিত্য বাইক দুর্ঘটনার খবর কানে আসে। কেন? সেখানে কি ট্রাম চলে? তবে কেন দোষারোপ? এসব আসলে ট্রাম তুলে নেওয়ার বাহানা। এখন ঢালাই করার পর ট্রাম লাইন আগের চেয়ে অনেক স্মুদ হয়েছে, অনেক ভালো হয়েছে। জংশন, অর্থাৎ যেখানে ট্রাম লাইন ডানদিক বাঁদিক ঘোরে, সেগুলো আগে অসমান ছিল। কিন্তু এখন ঢালাইয়ের পরে রাস্তা দারুণ। নিজে বাইক চালাতে গিয়ে দেখেছি, ট্রাম লাইনের মাঝখানটা কিন্তু দুর্দান্ত স্মুদ। আমি নিজে কতসময় ট্রাম লাইনের ওই অংশটা ধরে বাইক চালিয়েছি। আমি ভাবি, এত এত টাকা ট্রামের পিছনে বিনিয়োগ করার পর সত্যিই কি ট্রাম তুলে দেওয়ার কোনও মানে হয়!

Exclusive interview of a retired tram conductor named Gavin Clifford Rosario regarding his 40 years of experience in tram service Robibarer Royak

সোহিনী: চল্লিশ বছর ধরে ট্রামের সঙ্গে সহবাস আপনার, ট্রাম বাঁচাতে সরকারের কী কী উদ্যোগ দরকার ছিল বলে মনে হয়? কেন ট্রাম তুলে দিতে হচ্ছে?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: কেন রাখতে চায় না সেটা সরকার জানে। কিন্তু আমার মনে হয়, ট্রামকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে ট্রাম বাড়াতে হবে। পুরনো রুটগুলো খুলতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ট্রামকে আপডেট করতে হবে। সময়সীমা মেনে চলার চেষ্টা করতে করতে হবে। ইউ হ্যাভ টু রিগেইন পিপল'স এক্সপিরিয়েন্স। প্রয়োজনে কনজাস্টেড জায়গা থেকে ফাঁকা জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত ট্রাম। ভাবুন তো, বাইপাসে ট্রাম হলে কত রেভিনিউ হত। সরকারের বিরুদ্ধে বলার কোনও জায়গা নেই। শুধু আবেদন করি, ট্রাম মুছে ফেলবেন না। ট্রাম হেরিটেজ।

সোহিনী: হেরিটেজের স্বার্থে সরকার জয় রাইড বাঁচিয়ে রাখতে চায়। দার্জিলিংয়ে যেমন টয় ট্রেনের জয় রাইড হয়, কলকাতার বুকেও নাকি তেমনই আনন্দযাত্রা করবে ট্রাম। পর্যটন বাড়বে তাতে। এ ব্যাপারে কী মত আপনার?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: আমার মনে হয় জয় রাইড ভিত্তিহীন। এ শহরের মানুষ জয় রাইডের জন্য ট্রাম চায় না। তারা প্রয়োজন, নিত্যযাত্রার জন্য ট্রাম চায়।

সোহিনী: রোজের ট্রামযাত্রা থেকে তো অবসর, এতদিনের দায়িত্ব থেকে ছুটি। কীভাবে সময় কাটছে আপনার?

গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও: দেখতে দেখতে প্রায় সাত দিন হয়ে গেল। সত্যি বলতে, আমি খুব মিস করছি ওই জার্নিটা। প্রতিদিন যখন ট্রাম নিয়ে ডিপো থেকে বেরোতাম, সেটা ছিল আমার কাছে একেকটা নতুন নতুন অ্যাডভেঞ্চারের মতো। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ, পরিচয়। সকালে কাজে বেরোনোর সময়েই মনে মনে ভাবতাম, আজ কেমন যাত্রী পাবো, কত নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ হবে। ব্যক্তিগত ভাবে চেষ্টা করেছি সবসময়, যাত্রীদের সঙ্গে সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা বজায় রাখতে। কারণ আমি তো শুধুমাত্র একজন কনডাক্টর নই, ট্রাম সংস্থার প্রতিনিধিও। আমার ভালো লাগত এই আলাপ, কথাবার্তা, জমে ওঠা গল্প। সেই সব কিছুই মিস করছি এখন খুব। আমার স্ত্রী একজন স্কুলশিক্ষিকা। সকালে বেরিয়ে যান, ফিরতে ফিরতে বিকেল। আমার ছেলে পড়ে লা মার্টিনিয়ার, লখনউতে। আর আমার মেয়ে মনিপাল থেকে এমবিএ করছে। গত বছর শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর থেকে সে দাদুর কাছেই থাকে। ফলে আমি ঘরে একা। আমার সত্যিই সময় কাটছে না। খবরের কাগজও শেষ। কত টিভি দেখা যায়, কত মোবাইল ঘাঁটা যায় বলুন তো।

কয়েক দিন আগেই আমার সহকর্মীরা আমাকে ফেয়ারওয়েল দিয়েছেন। সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে গেছিলাম। এই যে সহকর্মীদের সঙ্গে এতদিনের যোগাযোগ, যাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ। সেখান থেকে সরে এসে এই একাকিত্ব, তা খানিকটা হলেও যন্ত্রণা দিচ্ছে তো বটেই। পাশাপাশি ট্রামের ভবিষ্যতও ভাবায়। কালই কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সরকার চাইলে ট্রাম তুলে দিতেই পারে। সেই ক্ষমতা সরকারের রয়েছে। তবু ট্রামের একজন প্রাক্তন কর্মী হিসেবে আমি সরকার, দিদির কাছে আবেদন জানাই, ট্রাম ওঠাবেন না। এ শহরের মানুষ ট্রামকে পছন্দ করে। ভালোবাসে। জয় রাইড নয়, নিত্য প্রয়োজনে এ শহরের বুকে থাকুক ট্রাম। ট্রামে সফর করা সব কলেজ পড়ুয়ার হাসিমুখ, ট্রামে ওঠার সেই যে আনন্দ— তা আর কতদিন থাকবে, তা আসলে একমাত্র সরকারের হাতেই রয়েছে।

কলকাতার বুকে শুধু নস্টালজিয়া নয়, নিত্যযাত্রীদের জরুরি গণপরিবহণ হয়ে ওঠার চেষ্টাটুকু নিয়েই এ শহরের বুকে আবার ছুটবে ট্রাম, সেই প্রত্যাশাটুকুকে সঙ্গে করেই গ্যাভিন ক্লিফোর্ড রোজারিও সাহেবের সঙ্গে আড্ডা গুটোয় ইনস্ক্রিপ্ট।

More Articles