প্রজাতন্ত্র, জয়পাল সিং মুণ্ডা এবং কয়েকটি প্রশ্ন
লড়াই করে অর্জিত প্রজাতন্ত্রের স্বপ্ন প্রতিটি আদিবাসী ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন জয়পাল সিং মুণ্ডা। অথচ আমাদের বাবুবৃত্তির ইতিহাসচেতনায়, জয়পালের নাম কোথায়?
দিন দুয়েক আগে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত সুহাস পালসিকরের একটি প্রবন্ধ ঘেঁটে দেখছিলাম। অভিজ্ঞ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পালসিকর লিখেছেন এক নবতম সংকটের কথা। পঁচাত্তর-তম প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে দ্বিধাবিভক্ত ভারতবর্ষ। একদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রজাতন্ত্র, যার ভিত্তি সাড়ে সাত দশকের সাংবিধানিক কাঠামো এবং অন্যদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে আগ্রাসী হিন্দুত্বের ন্যারেটিভ, যা গিলে খেতে চায় সাংবিধানিক শাসনের সমস্ত অর্জন। এই দুই ভারত আপাতত সম্মুখসমরে।
এই লেখা যখন লিখছি, তখন পালসিকরের ওই অমোঘ লাইনগুলো মাথায় রেখে বারংবার মনে পড়ে যাচ্ছে একটা ভিডিও। বিগত বছরের নভেম্বর মাসের একটি ভিডিও। ঝাড়খণ্ড নির্বাচনের আগে তৈরি করা একটি নির্বাচনী বিজ্ঞাপন। একটি পরিবার, যারা দীর্ঘদিনের ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সমর্থক, তাঁদের বাড়ি দখল হয়ে যাচ্ছে। দখল কারা করছেন? ফেজটুপি পরা, দাড়ি রাখা একদল লোকজন। তাঁদের ধর্ম আলাদা করে বলে দিতে হয় না।
আদ্যোপান্ত রূপকধর্মী এই বিজ্ঞাপনের টার্গেট অডিয়েন্স কারা, তা আর বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না। প্রায় ২৭% আদিবাসী জনসংখ্যার ঝাড়খণ্ডে, বিজেপির টেক্সটবুক উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্বের ন্যারেটিভ কার্যত অকেজো। তাই মরিয়া অনুপ্রবেশের তত্ত্ব। উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপির আগুণখোর নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মার একের পর এক বক্তৃতা। যোগ্য সঙ্গ দিচ্ছেন যোগী আদিত্যনাথ। দুইয়ের বক্তব্যে মিলেমিশে যাচ্ছে কী ভাবে আদিবাসীদের হাত থেকে জমিয়ে ছিনিয়ে নিচ্ছেন বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীরা। লাভ জিহাদের টোপে পড়ে বে-ঘর হচ্ছেন একের পর এক আদিবাসী মহিলা।
আরও পড়ুন- ভারতের সংবিধানটা হাতে লিখেছিলেন, প্রেমবিহারী নারায়ণকে মনে রাখিনি আমরা
প্রজাতন্ত্রের প্রাক্কালে এই সমস্ত কথা ফ্ল্যাশব্যাকে মনে পড়ে যাওয়ার একটা সুবিধা আছে। রাজনীতির ছাত্র হিসাবে রাজনৈতিক ইতিহাসের যে সাত-দশকের যাত্রা, তাকে বেশ দাঁড়িপাল্লায় ফেলে মেপে নেওয়া যায়। এই যে আদিবাসীদের নিয়ে এত কথাবার্তা, এই যে জোর করে তাঁদের হিন্দুয়ানির চেষ্টা, তা কি আদৌ সম্ভব হত জয়পাল সিং মুণ্ডা না থাকলে? অথচ আমাদের সমষ্টিগত ইতিহাসের চেতনায়, তাঁর স্থান কোথায়? স্কুলপাঠ্য ইতিহাসের বইতে আদিবাসী মানেই স্রেফ বিরসা মুণ্ডা। বড়জোর সিধু-কানু। অথচ, সংবিধান প্রণেতা হিসাবে কন্সটিটিউশন অ্যাসেম্বলিতে যিনি সোচ্চারে বললেন আদিবাসী অধিকারের কথা, তিনি রয়ে গেলেন অন্ধকারে।
জন্ম ছোটোনাগপুরে। সেই জমানায় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ। ভালোবাসতেন হকি খেলতে। ভালোবাসার টানে চাকরি ছাড়লেন। দেশের প্রথম অলিম্পিক সোনাজয়ী হকি টিমের অধিনায়ক। তাঁর সহ খেলোয়াড় ছিলেন ইফতিকার আলি খান পটৌডি এবং হকি কিংবদন্তী ধ্যানচাঁদ। তাঁর জন্যে নিয়ম বদলেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। সে যুগে একবার সিভিল সার্ভিস ছেড়ে দিলে আর ফিরে আসা যেত না। অথচ, ব্যতিক্রম হয়েছিল জয়পালের ক্ষেত্রে।
ব্যক্তিগত সাফল্যের শ্রেষ্ঠ পর্যায়ে পৌঁছেও জয়পাল থেমে থাকেননি। নিজের চাওয়াপাওয়ার উপরে রেখেছিলেন নিজের কৌমের স্বার্থ। ফলত রাজনীতি। আদিবাসী মহাসভার প্রেসিডেন্ট হলেন। সারা দেশজুড়ে আদিবাসী সমস্যার সমাধানে সক্রিয় প্রচার শুরু করলেন। উদ্দেশ্য একটাই। আদিবাসীদের স্বর পৌঁছে দেবেন রাজনৈতিক অলিন্দে। দিলেনও। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস সমর্থিত স্বাধীন প্রার্থী হিসাবে পৌঁছালেন কন্সটিউট অ্যাসেম্বলিতে। নিজের প্রথম ভাষণেই বললেন সেই কথাগুলো যা শোনার জন্যে অপেক্ষা করেছিলেন লাখ লাখ মানুষ। ‘আমি সেই সমস্ত মানুষের হয়ে কথা বলতে চাই, যারা ছ'হাজার বছর ধরে উপেক্ষিত। অথচ আজকের স্বাধীনতার যুদ্ধ যাঁদের ছাড়া অসম্ভব। আমরাই এই দেশের প্রকৃত ভূমিসন্তান, অথচ বছরের পর বছর আমাদের দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে পিছিয়ে পড়া, অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িয়ে থাকা একটি কৌম বলে। আজ আমি উঠে দাঁড়িয়ে বলতে যাই আমি একজন গর্বিত জংলি। যে নামে ডেকে আমাদের অপমান করা হয়, আমি গর্বিত সেই নামের অধিকারী হতে পেরে।’ শুধু তাই নয়, ১৯৪৮ সালে যখন কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে মদ বন্ধের দাবীতে তীব্র বিতর্ক চলছে, জয়পাল সিং মুণ্ডা বলেছিলেন কী ভাবে স্রেফ সামান্য তাড়ি সম্বল করে গতর খাটিয়ে কাজ করে চাষ-আবাদ করেন। যে ফসলে পেট ভরে সারা দেশের।
অক্লান্ত পরিশ্রম আর উদাত্ত বাগ্মিতার জোরে, জয়পাল সিং মুণ্ডা হয়ে উঠেছিলেন আদিবাসীদের ‘মারাং গোমকে।’ ইংরেজি ভাষায় যার অনুবাদ হল গ্রেট লিডার। আজীবন লড়ে গিয়েছেন, আদিবাসী অস্মিতার জন্যে। আদিবাসীদের নিজস্ব পরিচিতির জন্যে। যে পরিচিতি আজকের ভারতে বারংবার আক্রমণের মুখে পড়ছে। সাঁওতাল পরগণাজুড়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে বনবাসী কল্যাণ আশ্রম। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদতে তৈরি এই আশ্রমের নাম বারংবার শোনা গিয়েছে ঝাড়খণ্ড নির্বাচনের সময়। শুধুমাত্র বিজেপির হয়ে ভোট সংগ্রহই নয়, এই আশ্রম কাজ করে আদিবাসীদের তাদের ‘শিকড়ে’ ফিরিয়ে আনার কাজও করে থাকে। এই কথিত এবং কল্পিত শিকড় আসলে হিন্দুয়ানির শিকড়। সারা দেশজুড়ে যে আরেসেস-বিজেপির ‘ঘর ওয়াপসির’ দাবিদাওয়ায় বাদ যায়নি আদিবাসীরাও। দু হাজার একুশ সাল থেকে ঝাড়খণ্ড জুড়ে ক্রমাগত জোরদার হচ্ছে সরণা কোড বিলের দাবী– যে কোড বিল আদিবাসীদের ভিন্ন ধর্মালম্বীর স্বীকৃতি দেবে– আর সেই কোড বিল ঠেকাতেই আরেসেস-সহ একাধিক সংগঠন পালটা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আদিবাসীদের মধ্যে সংগঠন তৈরি করে। লাভ জিহাদের মত তৈরি হয়েছে খ্রিষ্টধর্ম-বিরোধী নানা প্রচার। চলতি প্রজাতন্ত্রের মাসেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ সুপ্রিমো মোহন ভাগবত আদিবাসীদের মধ্যে ঘর ওয়াপসির গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেন দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত ঘর-ওয়াপসির ঘোরতর সমর্থক ছিলেন। তিনি নাকি বলেছিলেন, ঘর-ওয়াপসি না হলে আদিবাসীরা দেশদ্রোহী হয়ে উঠবে।
প্রজাতন্ত্র তাই দ্বিধা-বিভক্ত। একদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে, বহুত্বের কাঠামো। অপরদিকে হিন্দুয়ানির তীব্র আগ্রাসন, যা গিলে ফেলতে চাইছে যাবতীয় ভিন্নতা, বৈপরীত্য। গোটা দেশজুড়ে শুধু তৈরি হবে এক অভিন্ন হিন্দু পরিচিতি। সেই পরিচিতি মাথায় করে ঘুরবে সাধারণ মানুষ। ব্লু-প্রিন্ট মোটামুটি এই। কিন্তু, সফল হচ্ছে কি? চলতি ঝাড়খণ্ড নির্বাচন প্রমাণ করে দিয়েছে, ঘৃণ্য অনুপ্রবেশের রাজনীতি ব্যর্থ। প্রায় ৬০ এর কাছাকাছি আসন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে ঝাড়খণ্ড জনমুক্তি মোর্চা। দলিত-আদিবাসী ভোটের কাছে পর্যদুস্ত হয়েছে। যে চম্পাই সোরেনকে তুরুপের তাস বানিয়ে আদিবাসী ভোট দখল করতে চেয়েছিল বিজেপি, সেই চম্পাই সোরেন ব্যর্থ। মানুষ ভরসা রেখেছে হেমন্ত-কল্পনাতে। তাঁরা ভোলেননি, হেমন্ত জেলে থাকার সময় কী ভাবে সংগঠনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন কল্পনা। কী ভাবে আদিবাসী অধিকারের প্রশ্নটিকে মিলিয়ে দিয়েছেন নারী অধিকারের সঙ্গে।
প্রজাতন্ত্র তাই শেষ হয়ে যায়নি। শত ঝড়ঝাপটা সামলে তাকে দু হাতে আগলে রেখেছেন এ দেশের দলিত-আদিবাসী-মুসলমান। বহুকাল আগে যাঁদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, বাবাসাহেব আম্বেদকর এবং জয়পাল সিং মুণ্ডারা।