পাহাড়-সমুদ্র বোরিং! দু'হাত বাড়িয়ে আপনাকে ডাকছে অরণ্যসুন্দরী

Forest near Kolkata: বর্ধমান মানেই শুধুমাত্র মিহিদানা আর রাজবাড়ি নাকি। বর্ধমান মানে ভালকি মাচান অরণ্যসুন্দরীও। হাতের কাছেই কলকাতা থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে রয়েছে স্বপ্নের জঙ্গল।

পাহাড় না সমুদ্র, বেড়াতে যাওয়ার নাম করলেই এই বস্তাপচা প্রশ্ন শুনে শুনে ক্লান্ত হয়ে পড়েন অনেকেই। সত্যিই তো, পর্যটন মানেই কি পাহাড় বা সমুদ্র। কেন মরুভূমি, উপত্যকা কত কিছুই তো রয়েছে এই ভূভারতে। তবে তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বোধহয় জঙ্গল। তবে পশ্চিমবাংলার কাছাকাছি জঙ্গল বলতে হয় ডুয়ার্স, নাহলে সুন্দরবন। সুন্দরবন আবার খাঁড়ি, তাতে নদীর মজা যত, জঙ্গলের মজা তত নয়। তাই বলে কি হাতের কাছে মনপসন্দ জঙ্গল নেই নাকি! আলবাত আছে।

জঙ্গলের বুনো গন্ধ আর নির্জন প্রকৃতির সান্নিধ্য যাদের পছন্দ, তাদের জন্য হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে ভালকি মাচান জঙ্গল। কী, নামটা বিশেষ চেনা ঠেকল না তো কানে? শুনে দক্ষিণ ভারতের কোনও এক নাম মনে হলেও এই জঙ্গলের ঠিকানা কিন্তু আমাদের একদম বাড়ির পাশে। যেখানে গেলে মিলবে অপরিসীম সবুজের ঘিরে থাকা। জঙ্গল আবার প্রাণী ছাড়া হয় নাকি! কিন্তু প্রাণী মানেই কিন্তু শুধুমাত্র বাঘ-সিংহ নয়। বরং আরও অনেক কিছু। নাম না জানা সব বুনো গাছ, নাম না জানা পাখি-ফুল-প্রজাপতি। এমনকী গেকো কিংবা তক্ষকের মতো সরিসৃপও। সেসব কিছু মিলিয়েই জঙ্গল, যা সপ্তাহান্তে আপনার হাতে তুলে দেবে এই ভালকি মাচানের অরণ্য।

আরও পড়ুন: লাল কাঁকড়া আর নির্জনতা, এই সমুদ্রে এলে তাজপুর-মন্দারমণি ভুলতে বাধ্য!

বর্ধমান মানেই মিহিদানা আর রাজবাড়ি নাকি। বর্ধমান মানে ভালকি মাচান অরণ্যসুন্দরীও। হাতের কাছেই কলকাতা থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে রয়েছে স্বপ্নের জঙ্গল। যেখানে শাল-পিয়ালের বন মাদকতায় আচ্ছন্ন করবে আপনার সর্বাঙ্গ। কিন্তু যাবেন কীভাবে ভাবছেন তো? ভালকি মাচান যাওয়ার রাস্তা জলের মতো সোজা।

A Weekend trip to Valki Machan where history nestled with forest vey near to Kolkata

ট্রেন যদি আপনার প্রিয় যাতায়াতের মাধ্যম হয় তাহলে হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে উঠে পড়ুন বর্ধমানগামী যে কোনও ট্রেনে। নামতে হবে মানকর রেলস্টেশনে। সেখান থেকে রিকশায় চড়ে পৌঁছে যেতে হবে ভালকি মাচান। তবে মনে রাখবেন সব ট্রেন কিন্তু মানকরে থামে না। সেক্ষেত্রে বর্ধমানে নেমে গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে যান গন্তব্যে। বাস বা অন্যান্য সড়কপথেও পৌঁছে যেতে পারেন ভালকি মাচান। তার জন্য ২ নম্বর জাতীয় সড়ক ঘরে দুর্গাপুরের রাস্তা ধরে পৌঁছতে হবে গলসি পর্যন্ত। গলসি থেকে ডানদিকের রাস্তা ধরলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে মানকর। আর তার পরের রাস্তা তো আপনার জানাই।

A Weekend trip to Valki Machan where history nestled with forest vey near to Kolkata

জনপদ থেকে দূরে এই অরণ্যসুন্দরী। হরেক রকম গাছ-ফুলে ভরা চারপাশ। বাংলোর নামটিও যথাযথ। শালবন আর এই বনবাংলোর মাঝে নেই কোনও বেড়া বা কাঁটাতার। জঙ্গলের মধ্যে দ্বিতল একটি বাড়ি। বর্ধমান বন বিভাগের গুসকরা বনাঞ্চলের প্রায় ১৪৫০ হেক্টর জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে এই ভালকিমাচান জঙ্গল। তবে অখ্যাত হওয়ার দরুণ পর্যটকের ভিড় এখানে কম। বনবাংলোর পাশেঅ একটি দিঘি, সেই দিঘিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে একটি গোলবাগান। গাছে গাছে ফুলে ফুলে ঢাকা সে বাগানে পর্যটকগের জন্য বসার জায়গা করে রাখা হয়েছে। দিঘিতে চাইলে মাছ ধরতে পারেন। দিঘির বুকে নৌকাবিহারও করতে পারেন ইচ্ছা হলে। তার জন্য রয়েছে টাইটানিক ও হর্ষবর্ধন নামে দুটি নৌকা। সেই দিঘির আশপাশে ভিড় করে অসংখ্য পাখি। রাত বাড়লে ছেঁকে ধরে ঝিঁঝিঁর ডাক।

A Weekend trip to Valki Machan where history nestled with forest vey near to Kolkata

জঙ্গলটি ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে বহু গল্প। জানা গিয়েছে, একদা নাকি কোনও এক দম্পতি তার দুধের সন্তানটিকে এই জঙ্গলে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলেন। তাকে আশ্রয় দেয় এক মা ভালুক, তাকে স্তন্যপান করিয়ে বড়ও করে তোলে সে। পরে সে এক সদগোপ বাড়িতে বড় হয়। কিন্তু ভালুক-মা তাকে ভোলেনি। প্রতি রাতে তাকে দেখতে আসত সে। শিশুটি মানুষের ভাষা শিখলেও হাঁটত নাকি পা টেনে টেনে ভালুকের মত। তাই তাকে ডাকা হত ভল্লুপদ নামে। ভালুক মায়ের আশীর্বাদে সে একদিন রাজা হল। তার রাজ্যের নাম হল ভালকি।

অনেকেই বলেন, একসময় এ জঙ্গলে ভালুকের দেখা পাওয়া ছিল জলের মতো সোজা। এখানকার তদনীন্তন রাজা নাকি ভালুক শিকারের জন্য বানিয়েছিলেন মাচা। সেখান থেকেই জায়গার নাম হয় ভালকি মাচান। লজের পাশে সেই মাচান আজও রয়েছে অবিকৃত। মাচান মানে ইঁটের মিনার যাকে বলে। চারদিকে চারটি ইঁটের তৈরি মিনার আজও রয়েছে সেখানে। তার মধ্যে একটি আবার বেশ উঁচু। কেউ কেউ বলেন, মিনারগুলো শত্রুদের লক্ষ করার জন্য ব্যবহার হত একসময়। অনেকে আবার বলেন, বিমান চলাচলের দিক নির্দেশ করার জন্য় ব্যবহার করা হত সেটিকে।। চারটি স্তম্ভের মাঝখানে স্বল্প পরিসরে লোহার জালে ঢাকা একটি কুয়োর মত দেখা যায়। অনেকের মতে এটি নাকি সুড়ঙ্গ পথ। স্তম্ভের আশপাশে অবশ্য কোনও সিঁড়ি নেই। অন্তত দেখা তো যায় না। কেউ কেউ মনে করেন এই পথ নাকি বিপ্লবীরা ব্যবহার করতেন সে সময়ে।

আরও পড়ুন: তিব্বতে নয়, এ দেশেও রয়েছে অন্য মানস! গেলেই আয়ু দ্বিগুণ?

সেই রাজা ভল্লুপাদ, অর্থাৎ ভালুক-মা যাকে বড় করেছিল, তাঁর প্রপৌত্র ছিলেন রাজা মহেন্দ্রনাথ। তিনি তাঁর রানি অমরাবতীর স্মৃতিতে প্রাচীন গোপভূমে অমরাগড় নামে একটি দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন। এই গড় বা দুর্গের কোনও চিহ্ন এখন আর নেই। অমরাগড়ে রয়েছে শিবাখ্যা দেবী ও দুগ্ধেশ্বর শিবের পুরনো মন্দির। ইতিহাস অবশ্য বলছে, উগ্রক্ষত্রিয় বর্ধমানের রাজারা বর্গী আক্রমণের ভয়ে তাদের রাজত্ব সীমানার চারিদিকে অনেকগুলি গড় তৈরি করেছিলেন যেগুলির মাথায় বসে পাহারা দেওয়া হত। ভালকির এই মাচানটিও সেরকমই একটি গড় ভিন্ন আর কিছু নয়। নিশ্চয়ই আশে পাশের শক্তিগড়, পানাগড় এইসব এলাকাতেও এমন গড় রয়েছে। অবশ্য স্থানীয় মানুষজনের বিশ্বাস যে এই মাচানটি এখানকার রাজারাই ব্যবহার করতেন। নিরাপত্তার কারণে এই ওয়াচটাওয়ার থেকে দুর্গাপুরের বর্তমানে সিটি সেন্টার পর্যন্ত সুড়ঙ্গ পথ ছিল।

আর এইসব উপকথা-ইতিহাসের মিশেলে প্রাচীন স্থাপত্য কিন্তু এই জঙ্গলের উপড়ি পাওনা বটেই। চাইলে ঘুরে আসতে পারেন অমরাগড়ের শিবাখ্যা দেবী ও দুগ্ধেশ্বর শিবের পুরনো মন্দির থেকেও। বর্ধমানের আশপাশে আরও বেশ কিছু জায়গা রয়েছে দেখার মতো। হাতে বেশি সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন সেগুলোও। কলকাতার থেকে মাত্র তিন ঘণ্টা দূরের এই জঙ্গলে অনেকেই আসেন দিনের ট্রিপে। পিকনিক করতে আসা মানুষের ভিড়ও কম নয়। তবে যারা দু-একটা দিন জঙ্গলের আদরে কাটাতে চান, তবে আপনার প্রথম পছন্দ অবশ্যই হবে আউসগ্রাম পঞ্চায়েতের সাজানো অরণ্যসুন্দরী রিসর্ট। ছাড়াও যমুনাদিঘিতে রয়েছে রাজ্য মৎস উন্নয়ন নিগমের রিসর্ট৷ থাকতে পারেন সেখানেও। সাধারণ ভাবে মৎস্য দফতরের রিসর্টগুলিতে দারুণ মাছ খাওয়ার সুযোগ মেলে। সব মিলিয়ে এই স্বপ্ন-অরণ্য কিন্তু হতেই পারে আপনার সপ্তাহান্তের ঠিকানা। যেখানে প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটবে অপূর্ব এক অবসর।

 

More Articles