বিষ দিয়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল? আরতি মুখোপাধ্যায় মানে আজও বিতর্ক...

দক্ষিণ কলকাতা। অন্য কলকাতার খোঁজ মেলে এখানে। উত্তর কলকাতা যেমন দাঁড়িয়ে আছে বনেদিয়ানার বিশাল ঐতিহ্যকে গায়ে মেখে, দক্ষিণ কলকাতাও তেমনি এগিয়ে চলেছে আধুনিকতার গর্বকে সঙ্গে করে।' আশ্বিনের মাঝামাঝি/ উঠিল বাজনা বাজি... পুজোর সময় এলো কাছে - পূজোর সময় নাকি প্রেমের সময়? এ যেন কল্লোলিনীর বুকে আশ্বিনেই নেমে এসেছে অকালবসন্ত। শহর জুড়ে যেন আজ প্রেমের মরশুম। আলোয় মাখামাখি অষ্টাদশী কিশোরীর মুখ। অনেকক্ষেত্রে ক্ষণস্থায়ী হলেও পুজো প্রেমের যে একটা আলাদা মাধুর্য আছে সে কথা স্বীকার করতেই হয়। চেতলা অগ্রণীর পুজো প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসছে - " তখন তোমার একুশ বছর বোধহয়, আমি তখন অষ্টাদশী ... ।"- সুরের ছন্দে মিশে যাচ্ছে দুটো জীবনের ছন্দ। প্রেমের উষ্ণতায় তাপমাত্রা বাড়ছে শহরের। পুজোর রোশনাইকে পুঁজি করে পাটভাঙ্গা শাড়ি আজও খুঁজে ফিরছে পাঞ্জাবির গন্ধকে। পুজোর ঢাকের বোল আর দশমীর ধুনুচি নাচের মধ্য দিয়েই হয়তো একসময় পরিণতি পাবে চারদিনের আলতো চোখের চাহনি অথবা আঙ্গুলের নরম স্পর্শ।

দক্ষিণ কলকাতার চেতলা, যে চেতলা সাক্ষী এক কালজয়ী শিল্পীর লড়াই, বঞ্চনা এবং একসময় অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার। হ্যাঁ, এই চেতলার মাটি থেকেই উত্থান ঘটেছিল গায়িকা আরতি মুখোপাধ্যায়ের। আরতির পথপ্রদর্শক ছিলেন গানের শিক্ষক সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়। অবশ্য আরতির বাবা মাও মেয়েকে নিরন্তর উৎসাহ যুগিয়েছেন। এমনকি বাবার মৃত্যুর পরেও আরতির মা সাংসারিক টানাপোড়েনের আগুন লাগতে দেননি আদরের মেয়ের গায়ে। আরতির প্রথম প্লেব্যাক গাওয়ার সুযোগ এসেছিল একপ্রকার গল্পের মতো - চেতলায় অনুষ্ঠিত ' মুরারি সংগীত সম্মেলন' জেতেন আরতি। প্রতিযোগিতার বিচারক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের সৌজন্যে প্রথম প্লেব্যাক গাইলেন তিনি। এরপর ' গল্প হলেও সত্যি' ' ছুটির ফাঁদে' ' আনন্দ আশ্রম' - এর মতো ছবিতে এক নতুন কন্ঠের সাক্ষী থাকলেন শ্রোতারা। জন্ম হলো এক নতুন তারকার - নাম তার আরতি মুখোপাধ্যায়।

সালটা ১৯৫৮। মারফি - মেট্রো গানের প্রতিযোগিতায় প্রথম হলেন আরতি মুখোপাধ্যায়। এরপরেই তার জীবনের শুরু হলো এক নবতম অধ্যায়। ছোট থেকেই গানের জগতে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। ফলে মান্না দে-র স্নেহধন্য ছিলেন আরতি। মান্না দে -র কাছেই প্রথম শোনেন মারফি মেট্রো প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ায় স্বয়ং লতা মঙ্গেশকর দেখা করতে চেয়েছেন তার সাথে। আরতি কি তখনও জানতেন পরবর্তী সময়ে এই লতার কারণেই গানের জগতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হবে তার? না, প্রথম দর্শনেই অমায়িক লতারও যথেষ্ট ' কাছের মানুষ' হয়ে ওঠেন আরতি। এমনকি লতার সঙ্গে একসময় ডুয়েটও গেয়েছেন তিনি।' সাহারা' ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে লতার সঙ্গে গাইলেন আরতি, বয়স তখন সবে পনেরো। সেই কিশোরী বয়সেই লতার সঙ্গে স্টেজ শেয়ার - ক্যামেরার পিছনে এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা বইকি।

১৯৮৩ সাল। সঙ্গীতকে ভালবেসে প্রথম ধাক্কা খেলেন আরতি মুখোপাধ্যায়। তার আগেই তিনি পৌঁছে গিয়েছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে।' দাদার কীর্তি' ' ধন্যি মেয়ে' প্রভৃতি ছবির গানগুলিতে কণ্ঠ দিলেন তিনি। না, এখানেই শেষ নয় - রাহুল দেববর্মনের সঙ্গে ' মাসুম' ছবিতেও কাজ করলেন আরতি মুখোপাধ্যায়। বস্তুতপক্ষে এরপরই আরতির সঙ্গীত জীবনের শুরু হলো এক প্রচণ্ড কালবৈশাখী, যার ফলে বেসামাল হয়ে গেল তার সুরসাধনা।' মাসুম' ছবিতে কাজ করার পর রাহুল দেব বর্মন পুজোর অ্যালবামে কাজ করার জন্য আরতিকে অফার দেন। সালটার ১৯৮৩। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে কাজটি শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। পিছনে কি কোন ষড়যন্ত্র? উত্তর অমিল। আরতিও প্রথম থেকেই ছিলেন প্রচারবিমুখ, ফলে তাকে বাদ দেওয়ার মূল কারণ তিনি অনুসন্ধানের চেষ্টা করেননি কোনদিনই। এই ঘটনার পর থেকেই একের পর এক ধাক্কায় ভেঙ্গে পড়ল আরতির গানের প্রতি সেই তীব্র প্যাশন, একসময় গানের ভুবন থেকে হারিয়ে গেলেন এই বঙ্গতনয়া।' আনন্দ আশ্রম' ছবিতে ' কথা কিছু কিছু' গানটি সেই সময়ের সুপার-হিট। অথচ সেই আরতি মুখোপাধ্যায় বাদ পড়লেন ছবির হিন্দি ভার্সনে।না,এক্ষেত্রেও কারণ অজানা। জনশ্রুতি অনুযায়ী আরতির ক্রমোন্নতিতে এক সময় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন লতা-আশার মতো গানের জগতের সুপারস্টাররা। তাহলে কি পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে ছিলেন তারা? নাকি ইন্ড্রাস্ট্রির ভিন্ন সমীকরণ দায়ী এর জন্য? এমনকি আশার কারণেই রাহুল দেব বর্মন কাজ করতে পারেননি আরতি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে, নিন্দুকেরা এমন অভিযোগও করে থাকেন। আবার এমন কথাও শোনা গেছে, আরতি যেন আর কোনোদিন না গাইতে পারেন সেই ব্যবস্থা করতে কেউ বা কারা বিষ দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল তাঁকে। যদিও এই অভিযোগের সারবত্তা কতটুকু সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।

' পদ্মানদীর মাঝি' নাটকে একদিনে প্রায় ৩৫টি গান রেকর্ড করেছিলেন আরতি। অথচ সেই মাঝির গানের তরী আজ দিশেহারা, দিগভ্রান্ত।' বসন্ত বিলাপ' 'ধন্যি মেয়ে' প্রভৃতি ছবিতে একের পর এক হিট গানের জন্মদাত্রী তিনি। অথচ সেই আরতি মুখোপাধ্যায় আজ কোথায়? আজকের শ্রোতারা ভুলেছে তাঁকে। এ কি আমাদের ব্যর্থতা নয়? আত্মমূল্যায়নের প্রয়োজন আছে নিশ্চয়। লতার কারণে কাজ হারানো, আশার কারণে রাহুল দেববর্মনের সঙ্গে দূরত্ব - যে প্রলয় ঝড়ে অচিনপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল ' পদ্মানদীর মাঝি' - র নৌকা, সেই ঝড়ের নাম কি? লতা? আশা? নাকি অন্য কিছু? নাকি সবই গুজব? উত্তর খুঁজবেন পাঠকরা। আজ শুধু আরব সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে অস্তাচলের সূর্য আর মনখারাপ করা গোধূলিবেলাকে সঙ্গী করে আরতি যখন ফিরে যান অতীতের দিনগুলোতে, তখন তার কানে বেজে ওঠে - ' তখন তোমার একুশ বছর বোধহয়... আমি তখন অষ্টাদশী।

More Articles