স্বপ্নবীজ পুঁতে চলে মেয়ের দল
International Womens Day 2024: জল-জমি-জঙ্গল টিকিয়ে রাখার, ভাষা-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ের উঠোনে মিশেছে মেয়েদের অন্দরের লড়াই। গত দেড় বছরে বনবস্তিগুলোতে, গ্রামসভা থেকে তৈরি হচ্ছে শিক্ষাকেন্দ্র।
‘আমরা মেয়েরা’ — এটুকু বললেই আমাদের মাথায় মেয়েদের সম্পর্কে একটা ছবি তৈরি হয়। এবং সেই ছবিখানার মধ্যে নিশ্চয়ই থাকে মেয়েরা ঠিক কী করতে পারে, আর কী করতে পারে না; কী তাদের করা উচিত আর কী তাদের করা উচিত নয় তার লম্বা ফিরিস্তি। অর্থাৎ বলতে চাইছি, ‘মেয়ে’ শব্দটার সঙ্গে যে ছবি আটকে থাকে তার মধ্যে দুটো খোপ। একদিকে ‘হ্যাঁ’, আর একদিকে ‘না’-এর তালিকা। একজন মেয়ে তার গোটা জীবন জুড়ে প্রতিটা দিন দুই খোপের মধ্যেই অভিযোজিত হয়। খোপের আড়-বহরের হিসেবে বানিয়ে নেয় জীবনের মানচিত্র। চাওয়া-পাওয়ার জ্যামিতিও দুমড়ে-মুচড়ে ঢুকিয়ে দেয় ওই দুই খোপে। অথচ ভেবে দেখলে বোঝা যায়, এই খোপ-তালিকা তাদের আজন্ম অভিজ্ঞতা, জীবনবোধ, প্রতিদিনের সংঘর্ষ এসবের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়নি। উল্টে, বড় হওয়ার যাত্রাপথে সে তার জীবনকে এই দুই খোপের মধ্যে সাজাতে শেখে। তাকে সাজাতে শেখানো হয়। শেখায় তার পরিবার, তার পরিপার্শ্ব, সমাজ এবং শেষপর্যন্ত এই গোটা একটা রাষ্ট্র-ব্যবস্থা। আর যারা খোপের মধ্যে নিজেদের জীবনকে মানিয়ে নিতে পারে না, তাদের এক অদৃশ্য দেওয়াল ভাঙতে হয়। মেয়েরা লিঙ্গ-পরিচয়ের এই দেওয়াল নানাভাবে ভেঙেছে ও ভাঙছে। ভাঙার অভিঘাত বইছে সমস্ত শিরায়-হৃদয়ে-মস্তিষ্কে। যারা ভাঙে তাদের একটাই বিশ্বাস; ভাঙার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে তারা দেখতে পায় অশ্রু নদীর সুদূর পারে ‘মুক্তির আকাশ’। মুক্তি অর্থাৎ স্বাধীনতা। ত, সেই স্বাধীনতা নিয়ে আমরা কোথায় যাব, ঠিক কতদূর যাব— সেই প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে হয় ভাঙার যুদ্ধ চলাকালীনই। স্বাধীনতার ভিতর দিয়েই আসে সৃষ্টির কামনা। সেই কামনা ক্রমশ গুল্ম-লতার মত জরায়ুর অন্ধকার থেকে হৃদয়, এবং হৃদয় বেয়ে ওঠে মস্তিষ্কে। সে সমাজের চাপিয়ে দেওয়া পরিচয় যেমন ভাঙে, আবার তার শরীর ও চৈতন্যের সমস্ত উর্বরতা দিয়ে নতুন এক সমাজের বাতাবরণ নিয়ে আসে।
এই কথাগুলো, নিছক কাহিনি নয়, কোনও বায়বীয় স্বপ্ন-কল্প নয়। আমাদের বঙ্গদেশের সমাজ-বাস্তবতায় এমন বহু ঘটনাই ঘটে চলেছে। মেয়েদের ভাঙা-গড়ার তেমনই এক ঘটনার ভিতর ঢুকে দেখা যাক সেখানে কী ঘটছে। আমরা চলে যাই উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন বনবস্তি বা বনগ্রামগুলোতে।
ডুয়ার্সের সমতল জুড়ে এখন যেসব বন রয়েছে তা মূলত ব্রিটিশ সাহেবদের হাতে তৈরি। তার আগে ছিল ঘাসবন ও অন্যান্য গাছ-গাছালি। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ জুম চাষ করতেন। ব্রিটিশরা ভারতে আসার পর সমস্ত বন, পাহাড়, সমতলভূমি দখল করতে থাকে। তারা বন থেকে জুমিয়াদের তাড়িয়ে দেয়। নতুন গাছপালা লাগানো হয়, তৈরি হয় নতুন বন। ঔপনিবেশিক শাসকের মুনাফার মাধ্যম হিসেবে শুরু হয় অর্থকরী বনসৃজন। কিন্তু, নতুন বন তৈরি করতে গিয়ে এক বাস্তবিক সমস্যার মুখে পড়তে হয় সাহেব বাবুদের। গাছ কাটা, ঝুরনি করা, গাছের যত্ন নেওয়ার জন্য শ্রমিক দরকার। এমন শ্রমিক যারা এই বনাঞ্চল চেনে, জানে। সাহেবরা নেহাৎ সস্তা শ্রমের জন্যই জুমিয়াদের ফেরত নিয়ে এল। জঙ্গলে বা জঙ্গল লাগোয়া অঞ্চলে কিছু জমি-জমা দিয়ে তৈরি হল তাঁদের বস্তি। শর্ত একটাই, বিনা হাজিরায় বনের সমস্ত কাজ করতে হবে সাহেব ও সাহেবদের তৈরি বনদপ্তরের নির্দেশে। আজও উত্তরবঙ্গের বনবস্তিগুলো জুড়ে রয়েছে মেচ, রাভা, গারো, ধীমাল, লেপচা, রাই, লিম্বু, দুকপা, ভোটে ইত্যাদি নানা সম্প্রদায়ের মানুষ। পাশাপাশি রয়েছে জঙ্গলমহল থেকে বন-শ্রমিক হয়ে আসা ওঁরাও, মুর্মু, সাঁওতালি ও অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়।
আরও পড়ুন: উন্নয়নের নামে বনভূমি ধ্বংস! কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যে যে দাবি নিয়ে পথে নামল বনগ্রাম
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও বিনা মজুরিতে বনের কাজ করত বনবস্তির মানুষ। একসময় বনবস্তির অধিবাসীদের আন্দোলন চলেছিল এই বিনা হাজিরার কাজ বা বেগার প্রথার বিরুদ্ধে। আন্দোলনের চাপেই বন্ধ হয়েছিল সেই প্রথা। সুদীর্ঘ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তারা নিজেদের বন-জঙ্গল-সংস্কৃতি, নিজেদের শিকড়-মাটি, ও জীবন-জীবিকার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।
মোটামুটিভাবে এই প্রেক্ষাপটের উপরে দাঁড়িয়ে গত দেড় বছর ধরে বনগ্রামগুলোর লড়াইয়ে অভাবনীয় বাঁক-বদল ঘটেছে। জল-জমি-জঙ্গল টিকিয়ে রাখার, ভাষা-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ের উঠোনে মিশেছে মেয়েদের অন্দরের লড়াই।
গত দেড় বছরে বনবস্তিগুলোতে, গ্রামসভা থেকে তৈরি হচ্ছে শিক্ষাকেন্দ্র। এই শিক্ষা কেন্দ্রের মূল কান্ডারী গ্রামের মেয়েরা। সেখানে তারা শেখাচ্ছে গ্রামের ইতিহাস। নতুন প্রজন্মকে চেনাচ্ছে এবং নিজেরাও চিনছে বন-জঙ্গল-পাহাড় নদী। নিসর্গের সঙ্গে জীবন, জীবনের সঙ্গে গ্রাম-সমাজ-অর্থনীতির যোগসূত্র খুঁজে দেখছে তারা। শুধুমাত্র অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা এবং শিক্ষার বিনিময় আরও অর্থ উপার্জন এই ছকের বাইরে বেরোচ্ছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষা-ব্যবস্থার পাথর খুঁড়ে তুলে আনছে চাপা পড়ে থাকা জ্ঞান। যা আদিবাসী কৌমসমাজের অভিজ্ঞতা-জারিত, প্রজন্ম-লালিত। শুধু শিক্ষা বা জ্ঞানের পরিসরেই আটকে নেই তাদের কাজকর্ম। মেয়েরাই ডাক দিচ্ছেন গ্রামসভার, মিটিংয়ে যাচ্ছেন। নিজেদের গ্রাম, গ্রামের পাশে থাকা জঙ্গল-মাঠ-নদী-ক্ষেত-খামারের বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক চালাচ্ছে। গ্রামের ভালো-মন্দের খবর রাখছে, নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। বুঝে নিচ্ছে নিজেদের জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার। কোনও কোনও গ্রামে মেয়েরা দল বেঁধে চাষবাস ও মাছ ধরার কাজ করছে । স্বল্প পরিসরে যতটা সম্ভব নিজেদের খাবারের নিরাপত্তা, জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।
বনগ্রামগুলোতে অধিকার আন্দোলন, কিংবা গ্রামসভার স্বায়ত্তশাসনের প্রক্রিয়ায় এতদিন মহিলারা সক্রিয় ছিলেন না। সেই অর্থে আন্দোলনের জোয়ারে আন্দোলিত হয়নি মেয়েদের জীবন। প্রথম সারিতে কেবল পুরুষ তার সম্পদের ওপর অধিকার দাবি করেছে। মহিলারা পুরুষের সঙ্গী হিসেবেই থেকে গেছে। কিন্তু, রোজের বেঁচে থাকার জন্য পরিবারের ভিতরে সবচেয়ে বেশি শ্রমদান করে মেয়েরাই। জঙ্গল থেকে কাঠ কাটা, নদী থেকে মাছ ধরা কিংবা, ক্ষেত- খামারের কাজে নিবিড়ভাবে মিশে আছে মেয়েদের নুন-ঘাম। তা সত্ত্বেও, শ্রমের ইতিহাস অথবা সমাজ পরিবর্তনের সামগ্রিক ইতিহাসে মেয়েদের নুন-ঘামের কথা বিস্মৃত কেননা, সভ্যতার সেই ইতিহাসও লেখা হয়েছে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকেই।
ডুয়ার্সের বনবস্তিগুলোতে বেশ কিছু সম্প্রদায় মাতৃ-অনুসারী ছিল ঠিকই। তবে, শিক্ষাকেন্দ্র শুরুর প্রাক্কালে বনগ্রামগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ মোটেই সহজ ছিল না। শিক্ষাকেন্দ্রের সম্পূর্ণ দায়িত্ব মেয়েরা নেওয়ায় আন্দোলনে তাদের ভূমিকা জোরালো হয়েছে। অন্যান্য সামাজিক পরিসরেও তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। গ্রামসভাতেও বাড়ছে মেয়েদের যাতায়াত। তারা নিজেদের জীবনের অধিকার বুঝে নেওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাইছে জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার। মেয়েদের ওপর পুরুষের শোষণ মিলে যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের শোষণ, রাষ্ট্রের ভেতরে থাকা প্রান্তিক মানুষের ওপর হয়ে চলা শোষণের সঙ্গে। এক বিন্দুতে মিলিতে হচ্ছে সমস্ত শোষণের যন্ত্রণা। আর ঠিক সেই বিন্দু থেকেই নতুন করে শুরু হচ্ছে অধিকারের লড়াই।
ভারতবর্ষে বনাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে মেয়েদের এই স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা গিয়েছিল চিপকো আন্দোলনে। এছাড়া লাতিন আমেরিকার মেহিকোয় গড়ে ওঠা জাপাতিস্তা আন্দোলনে একইভাবে মেয়েদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। সেখানেও আদিবাসী মেয়েরা বন-প্রকৃতি বাঁচাতে সরব হয়েছে। তারা একই কন্ঠে উচ্চারণ করেছে মেয়েদের অধিকার ও সম্প্রদায়ের ভাষা-সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার কথা।
লিঙ্গ পরিচয় ভেঙে, পুরুষতন্ত্রের আগল ভেঙে মেয়েরা যত এগিয়ে আসছে তত বেশি করে ঘন হয়ে উঠছে সমাজ পরিবর্তনের সূচক বিন্দু। শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের লাবণ্য তাদের শরীরে-মনে, সমাজে। এমনকি তাদের লড়াই-ই বাঁচিয়ে রাখতে পারে প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ।
আরও পড়ুন: শত সংঘাতের পরেও সুন্দরবন জানে, বাঘ না বাঁচলে বাঁচবে না সাধের জঙ্গল
বনগ্রামে মেয়েদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্র-ব্যবস্থার ভেতরে থাকা পুরুষতন্ত্রকে শুধু ভাঙছে না, তারা পুরনো কৌমসমাজের যাবতীয় সম্পদ খুঁজে আনছে। নতুন তৈরি করছে তাদের বেঁচে থাকার গল্প। দু'হাতে বাঁচিয়ে রাখছে নিসর্গ প্রকৃতি। এ-ও যেন এক সমুদ্রমন্থন। মেয়েরা দলে দলে চলেছে স্বাধীনতার দিগন্ত অভিমুখে। তারা খুঁজে নিচ্ছে স্বাধীনতা পরবর্তী স্বশাসন। মেয়েদের স্বশাসনের চেতনায় অনুরণিত হচ্ছে বন-জঙ্গলের অন্ধকারে পড়ে থাকা প্রান্তিক মানুষের স্ব-শাসন। মেয়েদের শরীর-মনের ভেতর এবং বাইরের সমাজ — এই দুইয়ের মধ্যে স্ব-শাসনের স্রোত ঘুরে চলেছে অবিরাম। স্রোত যত বেশি হয় তত উঁচু হয় ঢেউ। বনগ্রাম ছাড়িয়ে সেই ঢেউ বৃহত্তর সমাজের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে যেতে পারে। জঙ্গলের মাটিতে এই স্বপ্নবীজ পুঁতে চলেছে মেয়েদের দল।