দেশের ২৩ হাজার কোটি টাকা তছরুপ দিনের আলোয়! হিজাব বিতর্কে যা চাপা পড়ে গেল

ঋষি অগরওয়াল নামক কোনো ব্যক্তির বিষয়ে কিছু শুনেছেন?অভিযোগ এই ব্যক্তি যে দেশের আঠাশটি ব্যাঙ্কের সাথে তেইশ হাজার কোটি টাকার প্রতারণা করেছেন। হ্যাঁ, দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কিং প্রতারণা। মেহুল চোকসি, নীরব মোদীদের প্রতারণার ঘটনাও ম্লান হয়ে যাবে এই প্রতারণার সামনে। অথচ দেশের সংবাদমাধ্যমের একাংশে এই ঘটনা দেখাই যাচ্ছে না। তোলপাড় হচ্ছে হিজাব বিতর্ক নিয়ে। উদ্দেশ্যটা সহজেই আপনার বোধগম্য হওয়া উচিত। চলুন, একটু বিশদে এই ঘটনার সম্বন্ধে জানা যাক।

ফেব্রুয়ারির শুরুর ঘটনা। সিবিআই এবিজি শিপয়ার্ড নামক একটি জাহাজ প্রস্তুতকারক ও মেরামতকারি সংস্থার শীর্ষকর্তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ? ২২,৮৪২ কোটি টাকার প্রতারণার, আইসিআইসিআই, এসবিআই, আইডিবিআই সহ আঠাশটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে। কংগ্রেসের অভিযোগ, ভারতীয় জনতা পার্টি পরিচালিত সরকার ইচ্ছা করে এই ঘটনাকে রিপোর্ট করতে দেরি করেছে। যে অভিযোগ স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি অস্বীকার করেছে। অনেকেরই মনে থাকবে, ২০১৮ সালে হিরে ব্যবসায়ী নীরব মোদী এবং মেহুল চোকসি এগারো হাজার কোটি টাকার প্রতারণা করে এই দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

সমস্যার সূত্রপাত হয় যখন একদা দেশের বৃহত্তম প্রাইভেট জাহাজ প্রস্তুতকারক সংস্থা ২০১১-১২ অর্থবর্ষে তাদের সংস্থার ইতিহাসে সবথেকে ভাল ফলাফল করার পরেই ক্ষতির সম্মুখীন হতে শুরু করে। দুই বছরের মধ্যেই এবিজির অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে তাদের আয় কমে যায় প্রায় ৮২ শতাংশ। অথচ কয়েক বছর আগেও তাঁরা দেশের এবং বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার থেকে জাহাজ তৈরির বরাত পেতেন, সেই তালিকায় ছিল ভারতের নৌবাহিনীও।

কিন্তু এই পতনের কারণ কী? এসবিআই এর যে অভিযোগের ভিত্তিতে সিবিআইয়ের এফআইআর, তাতে ইঙ্গিত মিলছে যে, আন্তর্জাতিক বাজারের ধসের কারণে জাহাজের চাহিদা অনেকটাই কমে যায়। এবিজি গ্রুপের বৃহত্তম আয়ের উৎস এই এবিজি শিপয়ার্ডের সব বরাত বাতিল হতে থাকে, এবং জমতে থাকে তৈরি করে ফেলা জাহাজ। স্বাভাবিক ভাবেই আয় ঠেকে তলানিতে।

ইতিমধ্যেই দেনায় জর্জরিত এই সংস্থা ২০১৪ সালে কর্পোরেট ঋণ পুনর্গঠন প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার জন্যে আবেদন জানায়। সেই প্রকল্পে তাদের সুবিধাও দেওয়া হয়, কিন্তু সব রকমের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বম্বে শেয়ার বাজার বা বিএসইকে তাঁরা জানায় যে তাঁরা ঋণ শোধ করতে অক্ষম, এমন কি কর্পোরেট ঋণ পুনর্গঠন প্রকল্পের সুবিধা নিয়েও তাঁরা ঘুরে দাঁড়াতে অক্ষম। ব্যাঙ্কের কনসোর্টিয়াম জানায় এবিজি শিপয়ার্ড অলাভজনক সম্পদে পরিনত হয়েছে।

২০১৭ সালে আইসিআইসিআই দেউলিয়া কার্যক্রম শুরু করে এবিজির বিরুদ্ধে, জাতীয় কোম্পানী ল ট্রাইবুনালে। এপ্রিল ২০১৯ এ তাঁরা রায় দেন যে এবিজির সব সম্পদ বিক্রি করে ব্যাঙ্কদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সেই প্রক্রিয়া এখনও চলছে, জানিয়েছে এসবিআই।
 

একটু ব্যাঙ্কগুলির ক্ষতির পরিমাণ জেনে নিই। আইসিআইসিআই এবিজিকে ধার দিয়েছিলো ৭০৮৯ কোটি, আইডিবিআই ৩৬৩৯ কোটি, এসবিআই ২৯২৫ কোটি। মনে রাখবেন এই টাকা গুলি আপনার আমার টাকা থেকেই এবিজিকে ধার দেওয়া।

এই প্রতারণার সূত্রপাত কবে থেকে?

এই ঘটনা সামনে আসে যখন ২০১৮ সালে আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াঙ্গকে ব্যাঙ্কের কনসোর্টিয়াম এবিজির নিরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ করে। তাঁরা তাদের রিপোর্ট পেশ করে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে। তাদের রিপোর্টে উঠে আসে ২০১২ এর এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের জুলাই মাসের সময়টা। এসবিআই জানাচ্ছে, অভিযুক্ত ঋষি অগরওয়াল ( তৎকালীন চেয়ারম্যান এবং এমডি), সনথনম মুথাস্বামী (এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর), অস্বিনী কুমার ((ডিরেক্টর), সুশীল কুমার অগরওয়াল (ডিরেক্টর), এবং রবি ভিমল নেভেটিয়া (ডিরেক্টর), এই পাঁচ জন মিলিত ভাবে বেআইনি কাজ করেছেন। সেটা ব্যাঙ্কের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করা হোক, বা টাকা ধার নিয়ে তাকে অনৈতিক ভাবে বরাদ্দ করা বা খরচ করাই হোক, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিস্তর। এসবিআই এর অভিযোগপত্রে এমন ও বলা হয়েছে যে ব্যাঙ্কের যারা আধিকারিক, এবং সরকারী কর্মচারীদের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হোক।

অভিযোগপত্রে তাঁরা আরও লিখেছে যে, ব্যাঙ্ক গুলি থেকে টাকা ধার নিয়ে এবিজি তাদের সিঙ্গাপুরের সহায়ক কোম্পানির মাধ্যমে দেশের বাইরে এই টাকা পাঠিয়েছে, এবং সম্পত্তি কেনাবেচাও করেছে।

এসবিআই প্রথম অভিযোগ দায়ের করে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে। যদিও এখানে সবথেকে বড় প্রশ্ন, আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াঙ্গ রিপোর্ট পেশ করে জানুয়ারি মাসে, সেক্ষেত্রে এসবিআই এতদিন অপেক্ষা কেনো করলো সেটা একটা বিশাল প্রশ্ন তৈরি করছে।

মার্চ ২০২০ তে সিবিআই এফবিআই এর প্রথম অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে কিছু প্রশ্ন তুলে ধরে। প্রথমেই জানতে চাওয়া হয়, এসবিআই এতদিন কি করছিল? কেনো কোনো অভ্যন্তরীণ তদন্ত হয়নি? যে প্রশ্নের সদুত্তর এখনও পাওয়া যায়নি।

বিরোধী দল প্রশ্ন তুলছে, এতদিন আগে থেকে যখন এই প্রতারণার ঘটনা সামনে এসেছে, তাহলে কেনো এতদিন সময় লাগলো দুনিয়ার সামনে এই ঘটনা আসতে? ২০১৯ সালে রিপোর্ট এসে গেছে, তাহলে কী ভাবে ২০২২ পর্যন্ত গড়াল এই প্রক্রিয়া?

সরকার যদিও বলছে যে এই ধরনের প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত ৫২-৫৪ সপ্তাহ সময় লাগে পুরো রিপোর্ট তৈরি করতে। এবিজির এই অ্যাকাউন্টটি অনেক বড়, তাই এত সময় লেগেছে।

বিষয়টির এখন সবে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, হয়েতো ঋষি অগরওয়ালদের বিচার হতে হতে আরো কয়েক বছর। কিন্তু ব্যাঙ্কগুলির এই বিশাল ক্ষতির জের তো প্রত্যেক বারই সাধারণ মানুষকে পোহাতে হয়! ক্ষমতাশালীরা প্রভাব খাটিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে দেনা করেন, তার পর প্রভাব খাটিয়ে সেই টাকা ফেরত না দিয়ে দেশ থেকে ফেরার ও হয়ে যান, কিন্তু সাধারণ মানুষকে সুদের অঙ্ক বেশি গুনতে হয়, দেনা পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, অথচ দেশের ইতিহাসের সবথেকে বড় প্রতারণার ঘটনা দেশে আলোড়ন ফেলে না, ভোটের ইস্যু হয়না, মন্ত্রীর ইস্তফা চাওয়া হয় না। এমনকী এসব তদন্তও কতটা নিরপেক্ষ তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকে যায়। দেশের একজন সাধারণ ঋণখেলাপিকে যে ভাবে হেনস্থা করা হয় তার খবর প্রায়শই সংবাদপত্রের পাতায় উঠে আসে। রাঘববোয়ালদের ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য নয় কেন!

More Articles